লাল নীল সবুজ
আমার অনেক বন্ধুবান্ধুব।
কেউ লাল, কেউ নীল, কেউ সবুজ।
লাল বন্ধুরা দশদিগন্তের পাহাড়-পাথর ঠেলে হাঁটে
সমস্ত রক্তপাত ডিঙিয়ে আসবে এক অভ্রভেদী ভোরবেলা
তাকে স্বাগত জানাবে যে, সেই শাঁখের ঠিকানায়।
নীল বন্ধুরা নগ্ন হয়ে নেমে যায় সপ্তসিন্ধুর জলে
সমুদ্রগর্ত থেকে নক্ষত্রলোকের ঘাটে বেড়াতে যাবে মানুষ
তাকে পারাপার করবে যে, সেই অলৌকিক নৌকোর খোঁজে।
আর সবুজ বন্ধুরা হারিয়ে গেছে হলুদ বনে।
শোকাভিভূত
শোকাভিভূতের ন্যায় বেলা বয়ে যায়।
বিশুদ্ধ গন্ধের মতো কোনো নারী দেখেছো কোথাও?
তার করতলে নাকি কয়ে গেছে মানুষের শোকের ওষুধ?
বাতাসকে এই কথা বলা মাত্র সমস্ত বাতাস
হো-হো হেসে লুটোপুটি খায়
বাগানবিহীন এই কলকাতার দেয়ালে-চাতালে।
ভীষণ ভ্রমের মতো কোনো স্বপ্ন দেখেছো কোথাও?
তার ছায়াতলে নাকি রয়ে গেছে মানুষের সুখের ওষুধ?
মানুষকে এই কথা বলা মাত্র সমস্ত মানুষ
টেরি কেটে ছুটে যায় যে যার নিজের গর্তে
নির্দিষ্ট শ্মশানে।
শোকাভিভূতের ন্যায় বেলা বয়ে যায়।
সিঁড়ি
কত রকম সিঁড়ি আছে ওঠার এবং নামার
চলতে চলতে থামার।
সরল সিঁড়ি শীতল সিঁড়ি
পদোন্নতির পিছল সিঁড়ি
অন্ধ এবং বন্ধ সিঁড়ি
কদম ফুলের গন্ধা-সিঁড়ি
ওঠার এবং নামার
চলতে চলতে থামার।
কত রকম সিঁড়ির ধাপে কত রকম জল
পা পিছলোলে অধঃপতন
ভাসতে পারো মাছের মতন
ডুব সাঁতারে মুঠোয় পেলে সঠিক ফলাফল।
কত রকম জলের ভিতর কত রকম মাছ।
চুনো পুঁটি রাঘব বোয়াল যার যে রকম নাচ।
পেট চিরলে আংটি কারো
কারো শুধুই আঁশ
দীর্ঘতর ফুসফুসে কার ভরাট দীর্ঘশ্বাস।
সিঁড়ির নীচ জল এবং সিঁড়ির উপর ছাদ
মেঘও পাবে মানিক পাবে
বজ্রধ্বনির খানিক পাবে
পুড়তে চাইলে রোদ
জ্যোৎস্না থেকে চাইতে পার সার্থকতাবোধ।
অনেকরকম সিঁড়ি আছে ওঠা নামা হাঁটার
ঊর্ধ্বে অভিষেকের তোরণ
নিচের ঝোপটি কাঁটার।
স্থির হয়ে বসে আছি
স্থির হয়ে বসে আছি, তবু কলরোল।
মাছি জানে, ছাই-হওয়া সিগারেট জানে, কতখানি স্থির।
করতলে ভাগ্যরেখা, ইতিহাসে রাজার গৌরব, মাটিতে সমাধি
জলের ভিতরে গুড় আত্মহত্যা শুয়ে থাকে যতখানি স্থির,
মানুষের ছা-পোষা সংসারে
বদ্ধমূল নানাবিধ ভ্রানি-র মতন স্থির হয়ে বসে আছি, তবু কলরোল।
কাউকে দেখিনা, শুধু জনশূণ্য পথে একা হাওয়া হাঁটে, গাছ মাথা নাড়ে
কাউকে দেখি না, শুধু বিমানের সাদা ডানা, বিধ্বস্ত গর্জনে
লজ্জিতা নারীর মতো মেঘ সরে যায়, ঘন ছায়া নামে বনে
পৃথিবী হঠাৎ
দরিদ্রের মতো ম্লান, কাক কেঁদে ওঠে।
লিখি না, আঁকি না, কোনো ভাঙাগড়া খেলাধূলা নেই
তবু কলরোল।
ডাকাডাকি আকাশে মাটিতে, ক্রমাগত অনবরতই
সভাসমিতির খাম, আমন্ত্রন ও অভিবাদনে ক্রমাগত অনবরতই
দাঁড়ানো, দৌড়ানো, ছুটোছুটি
দোলাদুলি ঢেউয়ে লোকালয়ে।
ট্রেনের টিকিট যারা কেটে আনে কাউকে চিনি না।
রিজার্ত কামরার সুখ, অতিথিশালার চাবি, আয়না, বাথরুম
যথেচ্ছ ভ্রমণ সেরে ভোরবেলা না-ভাঙার ঘুম, দীর্ঘ স্বপ্নের তালিকা
ক্রমাগত অনবরতই কেউ ডাকে, করস্পর্শে মনে হয় আত্মীয়স্বজন
যেতে হয়, থেকে যাই, কার কাছে থাকি তা জানি না।
যে সম্রদ্রে কোনদিন ওলোট-পালোট হয়নি চুল
যে পাহাড় বহুদিন বিবাগী বন্ধুর মতো দুরদেশে ছিল
তারই কাছে স্টপেজ, স্টেশন, মেলামেশা, অঢেল আমোদ।
মধ্যরাতে ছৌ-নাচ, মানুষের ভগ্ন দেহে দেবতার মুখোশ পেখম
কাড়া-নাকড়ার শব্দে কেঁপে ওঠে দশদিক, চতুর্থ প্রহর
মন্দিরে মন্ত্রের মতো ধ্বনি জাগে, যাগযজ্ঞে আছি মনে হয়
ঝর্ণা নামে রক্তস্রোতে, অব্যক্ত ও অব্যাহতিহীন কলরোল শুধু কলরোল।
আত্মপ্রকাশের এক গাঢ় ইচ্ছা
হটাৎ আকাশ ছুঁয়ে ফুটে উঠবার এক গাঢ়তর অসুখ ও জ্বর
বুকের ভিতরে এনে জড়ো করে ক্রমাগত, অনবরতই,
রাশীকৃত গাছপালা, শুকনো হাড়, শিকড়-বাকড়,
নৌকোর ভাঙা দাঁড়, অফুরন্ত কালো জল ও সুর্যকিরণ।
স্থির হয়ে বসে আছি তবু কলরোল।
হে প্রসিদ্ধ অমরতা
হে প্রসিদ্ধ অমরতা
কী সুন্দর তোমার ভ্রুকুটি
ঘরের বাহিরে ডেকে এনে
ভাঙো ঘর, স্থিরতার খুঁটি।
ধবংসের আগুনে জলে ঝড়ে
তুমি রাখো মায়াবী দর্পণ
মহিমার স্পর্শ যারা চায়
রক্তপাতে তাদের তর্পণ
হে প্রসিদ্ধ অমরতা
কী উজ্জল তোমার পেরেক
বিদ্ধ ও নিহত হয় যারা
কেবল তাদেরই অভিষেক।