তুমি এলে
তুমি এলে সূর্যোদয় হয়।
পাখি জাগে সমুদ্রের ঘাটে
গন্ধের বাসরঘর জেগে ওঠে উদাসীন ঘাসের প্রান্তরে
হাড়ের শুষ্কতা, ভাঙা হাটে।
তুমি এলে চাঁদ ওঠে চোখে
সুস্বাদু ফলের মতো পেকে পরিপূর্ণ হয়
ইচ্ছা, প্রলোভন,
ঘরের দেয়াল ভেঙে ঘরে ঢুকে পড়ে দুর
ভ্রমনের বন।
তুমি এলে মেঘ বৃষ্টি সবই মুল্যবান।
আমাদের কাঠের চেয়ার
যেদিকে শহর নেই, শ্রাবণের মেঘমল্লার
মাতাল নৌকার মতো ভেসে যায় ভবিষ্যৎহীন।
পৃথিবী পুরনো হয়
পৃথিবীর ছাইগাদা, ছন্নছাড়া দৃশ্যের বিভুঁয়ে
শতাব্দীর শোক-তাপ জ্বর-জালা ছুঁয়ে
রয়ে যাই আমরা নবীন।
নিজের মধ্যে
গাছতলা ভরে গেছে ডেয়ো পিঁপড়েয়।
মাঝখানে মুনিঋষির মতো
নিজের মধ্যে নিজে।
ধূপ, ধুনুচি, ত্রিশূল
ত্রিশূলে টাঙানো ডমরু
গলায় রুদ্রাক্ষ, মাথায় বটঝুরি জট,
কিচ্ছু নেই।
শুধু খানিকটা আগুন পাঁজরার আড়ালে
পুড়বার মতো
কিছু কাঠ-কোঠরা
ইচ্ছে-অনিচ্ছের, লোভ-লালসার।
মুনিঋষির মতো বসে আছি গাছতলায়
ডেয়ো পিপড়েদের খুনখারাপি কামড়,
ক্ষতবিক্ষত অন্ধকারে
নিজের মধ্যে নিজে।
পাওয়া না-পাওয়ার কানামাছি
রঙীন রুমালে চোখ দুটো বাঁধা
নিজের সঙ্গে নিজের অষ্টপ্রহর- কানামাছি খেলা
ভারী চমৎকার ধাঁধা।
যাকে ছোঁবার তাকে না ছুঁয়ে
আকাশ ধরতে হাত বাড়িয়ে আমি ধুলো মাটির ভূয়ে।
হাত বাড়ালে হাতে জলের বদলে শামুক
অথচ ভেতরটা পরাগসুদ্ধ ফুলের জন্যে আপাদমস্তক কামুক।
সিদুর রঙের কিছু দেখলেই মন উসখুস, ইচ্ছেয় আগুন
বিশ্বাসের বাকলে সত্যিই এল ফাল্গুন?
কাছে যাই, কাছে গেলেই সব অদলবদল, যথেচ্ছাচার কান্ড
রক্তপাতের শব্দে শিউরে ওঠে গাছপালা নদীনালাময় দেশ
চেনা ব্রক্ষ্মণ্ড।
তবু তো ছুতে হবে কিছু, কাউকে-না কাউকে
পুকুরপাড়ের নিমগাছ কি সাগরপারের ঝাউকে।
পা নিয়েই সমস্যা, কোথায় রাখি, হয় পাঁক
নয় অনিশ্চিতের বালি
ভিক্ষের ঝুলিটা তবু যা হোক ভরছে নানারকম ভালো এবং মন্দে
সমৃদ্ধ কাঙালী।
মনে হচ্ছে কোথাও নেই
অথচ আমার চেয়ার টেবিলে আমি ঠিকই আছি
রঙীন রুমালে চোখ দুটো বাঁধা
নিজের সঙ্গে পাওয়া না-পাওয়ার কানামাছি।
প্রশ্ন
ছটাক খানেক বুকে,
একটা গোটা আকাশ এবং
জলের স্থলের গা ভর্তি রং
সব পড়েছে ঝুঁকে।
কাকে কোথায় রাখি?
বুকের মধ্যে হেসে উঠল
শিকল-পরা পাখি।
মানুষের কেউ কেউ
সবাই মানুষ থাকবে না।
মানুষের কেউ কেউ ঢেউ হবে, কেউ কেউ নদী
প্রকাশ্যে যে ভাঙে ও ভাসায়।
সমুদ্র সদৃশ কেউ, ভয়ঙ্কর তথাপি সুন্দর।
কেউ কেউ সমুদ্রের গর্ভজাত উচ্ছৃঙ্খল মাছ।
কেউ নবপল্লবের শুচ্ছ, কেউ দীর্ঘবাহু গাছ।
সকলেই গাছ নয়, কেউ কেউ লতার স্বভাবে
অবলম্বনের যোগ্য অন্য কোনো বৃক্ষ খুঁজে পাবে।
মানুষ পর্বতচুড়া হয়ে গেছে দেখেছি অনেক
আকাশের পেয়েছে প্রণাম।
মানুষ অগ্নির মতো
নিজে জলে জালিয়েছে বহু ভিজে হাড়
ঘুমের ভিতরে সংগ্রাম।
অনেক সাফল্যহীন মরুভুমি পৃথিবীতে আছে টের পেয়ে
ভীষণ বৃষ্টির মতো মানুষ ঝরেছে অবিরল
খরা থেকে জেগেছে শ্যমল।
মানুষেরই রোদে,
বহু দুর্দিনের শীত মানুষ হয়েছে পার
সার্থকতাবোধে।
সবাই মানুষ থাকবে না।
কেউ কেউ ধুলো হবে, কেউ কেউ কাঁকর ও বালি
খোলামকুচির জোড়াতালি।
কেউ ঘাস, অযত্নের অপ্রীতির অমনোযোগের
বংশানুক্রমিক দুর্বাদল।
আঁধারে প্রদীপ কেউ নিরিবিলি একাকী উজ্জল।
সন্ধ্যায় কুসুমগন্ধ,
কেউ বা সন্ধ্যার শঙ্খনাদ।
অনেকেই বর্ণমালা
অল্প কেউ প্রবল সংবাদ।
যে টেলিফোন আসার কথা
যে টেলিফোন আসার কথা সে টেলিফোন আসেনি।
প্রতীক্ষাতে প্রতীক্ষাতে
সূর্য ডোবে রক্তপাতে
সব নিভিয়ে একলা আকাশ নিজের শূণ্য বিছানাতে।
একান্তে যার হাসির কথা হাসেনি।
যে টেলিফোন আসার কথা আসেনি।
অপেক্ষমান বুকের ভিতর কাঁসন ঘন্টা শাঁখের উলু
একশ বনেরবাতাস এস একটা গাছে হুলুস্থুলু
আজ বুঝি তার ইচ্ছে আছে
ডাকবে আলিঙ্গনের কাছে
দীঘির পড়ে হারিয়ে যেতে সাঁতার জলের মত্ত নাচে।
এখনো কি ডাকার সাজে সাজেনি?
যে টেলিফোন বাজার কথা বাজেনি।
তৃষ্ণা যেন জলের ফোঁটা বাড়তে বাড়তে বৃষ্টি বাদল
তৃষ্ণা যেন ধূপের কাঠি গন্ধে আঁকে সুখের আদল
খাঁ খাঁ মনের সবটা খালি
মরা নদীর চড়ার বালি
অথচ ঘর দুয়ার জুড়ে তৃষ্ণা বাজায় করতালি।
প্রতীক্ষা তাই প্রহরবিহীন
আজীবন ও সর্বজনীন
সরোবর তো সবার বুকেই, পদ্ম কেবল পর্দানশীল।
স্বপ্নকে দেয় সর্বশরীর, সমক্ষে সে ভাসে না।
যে টেলিফোন আসার কথা সচরাচর আসে না।
রামকিস্কর
খানিকটা পাথর দাও আর একটু বুক-খোলা মাঠ
হে কলকাতা, হে আমার রুগ্ন জীর্ণ মুহ্যমান শিল্পের সম্রাট
রক্তে নাচে ছেণী
বাতাসে উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে যুবতীর বেপরোয়া বেশী
কিংবা কারো কালো চুলে অকষ্মাৎ কালবৈশাখী
একটু পাথর পেলে আঁকি
মেঘ কিংবা ঝড়
পাড়াগাঁর অন্ধকারে রোদে জলে হিম রাতে স্থির আলো জ্বালে
ধুলোর সংসারে বসে যে সকল নিঃসম্বল পার্বতী ও পরমেশ্বর
কিংবা গাছ, গাছই ভালো, গাছের অরণ্যমুখী হাঁটা
আজানুলম্বিত বাহু, দীর্ঘকায়, দৃপ্ত পদক্ষেপ, রোদমাখা ঋষি
ফুলের মশাল হাতে, বাকলে ফাটল, গায়ে কাঁটা
অথবা গাছের মতো কিছু
সুর্যের নিকটবর্তী, নক্ষত্রলোকের চেয়ে যৎসামান্য নীচু
মানুষ বা মানুষের বুকের নদীর মহোৎসব
ভালোবাসা ফুটে আছে, হাড় মাংসে আলোড়িত টব
অথবা জীবন, এই জীবনের নিশ্বাস-প্রশ্বাস রক্ত স্বেদ
ক্ষুধা, তৃষ্ণা, খেদ
সাহস, সংগ্রাম,
অট্রহাসি, আর্তনাদ, গান
অনেক আগুনে পুড়ে তবুও বজ্রের ভঙ্গী যার।
অঙ্গ নয়, শুধু অঙ্গ নয়
আমার ছেণীতে নাচে চৈতন্যের প্রতি অঙ্গীকার।
একটু পাথর দাও হে কলকাতা রক্তে আকুলতা
বাতাসে উড়িয়ে দিই যুবতীর আঁচলের মতো কোনো প্রিয় সত্য কথা।