কাকে দিয়ে যাব
কাকে দিয়ে যাব এই জলরাশি, দুকুল প্লাবন
কাকে দিয়ে যাব ভাঙা তীর
বিপদসংকুল বাঁশী যদি বাজে মধ্যরাত চিরে?
কে নেবে অঞ্জলি ভরে এই জল, পিছল সংসার
অসুখের মতো এই রক্তচিহ্নহীন ধুসরতা?
সুয়ে, শুয়ে, ভেঙে পড়ে বৃক্ষ, তরুলতা
যাদের শিকড় ছিল মাটির গভীরে বদ্ধমুল,
রক্তজাত ফুল
আকাশকে উপহার দিয়েছে প্রত্যেক শুভদিনে
পৃথিবীকে উপভোগ্য স্নেহ ও মমতা।
মহীরুহ শুয়ে আছে ঘাসে,
সোঁদা গন্ধ সরল বিশ্বাসে।
কাকে দিয়ে যাব এত ক্ষত, অক্ষমতা?
যে নেবে সে জয়ী হবে জানি
যে নেবে সে বিপন্নও হবে।
কেউ ভাল না বাসলে
কেউ ভাল না বাসলে আর লিখব না
কবিতা।
কত ভালবাসা ছিল বাল্যকালে।
পুকুর ভর্তি এলোচুলের ঢেউ
কলমীলতায় কত আলপনা
কত লাজুক মুখের শালুক
যেন সারবন্দী বাসরঘরের বৌ।
এক একটা দুপুর যেন
রূপসীর আদুল গা
রাত্রি কারো চিকন চোখের ইশারা।
সর্বনাশের ভিতরে কত ছোটাছুটি ছিল
বাল্যকালে
জ্যোৎস্নার আঁচল ধরে কত টানাটানি ছিল
বাল্যকালে
জরির পাড় বসানো কত দিগদিগন্ত ছিল
বাল্যকালে।
কেউ ভাল না বাসলে আর লিখব না
কবিতা।
কেবল আমি হাত বাড়ালেই
হাওয়া তোমার আঁচল নিয়ে ধিঙ্গীনাচন করলো খেলা
সকাল বিকেল সন্ধেবেলা
চোখের খিদের আশ মেটালো লস্পটে রোদ রাস্তা ঘাটে
যখন হাঁটো সঙ্গে হাঁটে
বনের পথে হাঁটলে যখন কাঁটাগাছে টানলে কাপড়
চ্যাংড়া ছোঁড়ার ফাজলামিকে ভেবেছিলাম মারবে থাপড়।
একটা নদীর লক্ষটা হাত, ভাসিয়ে দিলে সর্বশরীর
লুটপাটেতে ছিনিয়ে নিলে ওষ্ঠপুটের হাসির জরির
জেল্লাজলুস।
কেবল আমি হাত বাড়ালেই, মাত্র আমার পাঁচটা আঙুল,
তোমার মহাভারত কলুষ।
রক্তে মাংসে মনুষ্যজীব, সেই দোষেতেই এমন কাঙাল।
কিন্তু তোমার খবর নিতে আমার কাছেই আসবে ছুটে
অনন্তকাল।
ক্রেমলিনে হঠাৎ বৃষ্টি
অকস্মাৎ ক্রেমলিনের চুড়ো থেকে বৃষ্টি ছুটে আসে।
সুতীব্র শীতের ঢাল, শত শত তীর, পথে হঠাৎ ঘেরাও।
কে তুমি হে? কোন দেশী?
জারের প্রাসাদ ভেঙে কোথা যেতে চায়?
আমি গুপ্তচর নই, বৃষ্টিকে বোঝাই কানে কানে;
ওরে তোর অস্ত্রশস্ত্র থামা,
উৎসুক অতিথি, যদি তুলে নিস হুকুমৎনামা
একটু ভিতরে যাই
পাথরের পাহারার ঘোমটা তুলে তাকাই খানিক
অনির্বচনীয়তার প্রতিমাকে ছুঁয়ে দেখি
কত মাটি, কতটা মানিক।
নদীতেই নদী থাকবে, গাছ থাকবে গাছে
রাজার মুকুটে মুক্তো, রাজ্যপাট শৃঙ্খলা সংসার
সব থাকবে যে যেখানে আছে।
শুধু তোরা সুদুরে পালালে
কিছু স্মতি, কিছু গন্ধ মেখে নিয়ে যেতে পারি
আমার রুমালে।
দোভাযিয়া ইভানোভা কাছে এসে যেই ছাতা খোলে,
তুলে নেয় বৃষ্টি অবরোধ,
ক্রেমলিনের নীলাকাশে রোদ।
জনৈক ক্ষিপ্তের উক্তি
এই তো আমার ক্ষিপ্ত হবার সময় এলো।
মুঠোখানেক বৃষ্টি নিয়ে রোদকে ছুঁড়ে মারতে পারি
গঙ্গাজলকে বলতে পারি, সরে দাড়াঁও, ওপার যাবো।
ও কলকাতা হে কলকাতা
নেয়াপাতি ডাবের মাথা
সবকটাকে ঝুনো করে উকুন দিয়ে চষতে পারি।
এই তো আমার ক্ষিপ্ত হবার সময় হলো।
হাড়ের মধ্যে শুকাচ্ছে ঘি
পাঁজরা খুলে কার হাতে দি
চোখ জ্বেলেছে যজ্ঞশালা এবার তবে জপেই বসি
উপবীতটা হারিয়ে গেছে জলে কিংবা জনস্রোতে
নইলে দেখতে ব্রক্ষ্মশাপে ভস্ম হতো বিশ্বভূবন।
এই তো এলো ক্ষিপ্ত হবার বিকেলবেলা।
হাতের মুঠোর রঙের শিশি পাঁচটা আঙুল পাঁচটা তুলি।
বুলিয়ে দিলেই আকাশটা লাল
বাতাসটা নীল কালচে সকাল
সবাই যেমন রগড় খুঁজছে তেমনি রগড় জুড়তে পারি।
গেরস্থ হে, ঘুমোতে যাও, বিছানা আছে হ্যাংলা হয়ে।
এখন আমি ভাঙবো তালা
সিধকাঠিতে বুকের জ্বালা
আকাশ জোড়া সোনার থালা না যদি পাই মরতে পারি।
তাজমহল ১৯৭৫
বহুদিন একভাবে শুয়ে আছো, ভারতসম্রাট।
বহুদিন মণিমুক্তো, মহফিল, তাজা ঘোড়া, তরুণ গোলাপ
এবং স্থাপত্য নিয়ে ভাঙাগড়া সব ভুলে আছো।
সর্বান্তঃকরণ প্রেম, যা তোমার সর্বোচ্ছ মুকুট, তাও ভুলে গেছো নাকি?
পাথরের ঢাকনা খুলে কখনো কি পাশে এসে মমতাজ বসে কোনোদিন?
সুগন্ধী স্নানের সব পুরাতন স্মৃতিকথা বলাবলি হয় কি দুজনে?
জানি প্রতি জোৎস্নারাতে তোমার উঠোনে বড় ঘোর কলরব
ক্যামেরার কালো ভীড়, আলুথালু ফুতিফার্তা, পিকনিক, ট্রানজিসটারে গান
তবু তো যমুনা সেই দুঃখের বন্ধুর মতো কাছাকাছি ঠিকই রয়ে গেছে।
হারানো উদ্যানে গাঢ় মেলামেশা মনে পড়ে গেলে
দুজনে কি কোনোদিন বেরিয়েছ নিমগ্ন ভ্রমণে
আকাশ ও ধরণীর চুম্বনের মতো কোনো স্থানে?
বহুদিন একভাবে শুয়ে আছো, ভারতসম্রাট।
দেওয়ান-ই-খাসের ধুলো ভারতের যতটুকু সাম্প্রতিক ইতিহাস জানে
তুমি তার সামান্য জান না, আছো ভ্রান্তিতে ও ভয়ে।
আওরঙ্গজেবের ঘোড়া মারা গেছে
এবং সে নিজে, কেউ বলেনি তোমাকে?
সবচেয়ে দুর্ধর্ষতম বীরত্বেরও ঘাড়ে একদিন মৃত্যুর থাপ্পড় পড়ে
সবচেয়ে রক্তপায়ী তলোয়ার ও ভাঙে মরচে লেগে
এই সত্যকথাটুকু কোনো মেঘ.কোনো বৃষ্টি, কোনো নীল নক্ষত্রের আলো
তোমাকে বলেনি বুঝি? তাই আছো ভ্রান্তিতে ও ভয়ে,
শব্দহীন গাঢ় ঘুমে, প্রিয়তমা পাশে শুয়ে, ভুলে গেছে সেও সঙ্গীহীন
তারও চোখে নিদ্রা নেই, সে এখনো মর্মান্তিক জানে
তুমি বন্দী, পুত্রের শিকলে।
বহুদিন একভাবে শুয়ে আছো, ভারতসম্রাট।
আওরঙ্গজেবের ঘোড়া মারা গেছে, মারা যেতে হয়।
এখন নিশ্বাস নিতে পারো তুমি, নির্বিঘ্ন প্রহর
পরষ্পর কথা বলো, স্পর্শ করো, ডাকো প্রিয়তমা!
সর্বান্তঃকরণ প্রেম সমস্ত ধ্বংসের পরও পৃথিবীতে ঠিক রয়ে যায়।
ঠিক মতো গাঁথা হলে ভালোবাসা স্থির শিল্পকলা।