- বইয়ের নামঃ তুমি এলে সূর্যোদয় হয়
- লেখকের নামঃ পূর্ণেন্দু পত্রী
- প্রকাশনাঃ PPP
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আত্মচরিত ০১
যখন ছ’সাত বছর বয়স
ঈশ্বর আকাশে কাঁপতেন কখন কী করে বসি
তাঁর নিপুণ সংসারে।
এক একটা আস্ত পুকুর এবং গগুুষে গিলে
আবার অন্য পুকুরে রুই কাতলার ভিতরে ডুবসাঁতার।
জল থেকে উপড়ে আনা শালুক ছিল
অবিকল রাজকন্যের মুখ।
এখন চল্লিশ।
এখন রক্তক্ষরণের শব্দে বুকের নিশ্বাস নিভে যায়।
যখন সাত-আট বছর বয়স
ঝকঝকে চোখ বলিদানের কাতান
বুকে ঢাক ঢোল কাঁসর ঘন্টা দিনরাতের পুজো পার্বণ
পা দুটো রাণা প্রতাপের চৈতক
চৈত-বোশেখের ঝড়ে কেবল ছুটছে ব্রক্ষান্ডের গায়ে লাথি মেরে।
ঈশ্বর সারাটা দুপুর আকাশে থাকতেন পাহারায়,
পাছে ঐ দুর্দান্ত বয়সটা আকাশের পথ চিনে ফেলে।
এখন চল্লিশ।
এখন নিশ্বাসের ভিতর কেবল স্বপ্নের দরজা ভাঙে।
যখন আঠারো বছর বয়স
দীর্ঘকার এক মন্দির তুলেচিলাম নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে
তার ভিতরে ধুপ, ধুপের ভিতরে পুস্পগন্ধ, পুস্পের ভিতরে নারী
নারীর ভিতরে আকাশময় ওষ্ঠ, ওষ্ঠের ভিতরে কেবল প্রবহমান চুম্বন।
এখন চল্লিশ।
এখন স্বপ্নের ভিতরে ঈশ্বরের তুমুল অট্রহাসি।
আত্মচরিত ০২
বৃষ্টি এলে ষোলো বছর বয়সটা ভিজতে ভিজতে
ফিরে আসে আবার।
পায়ের তলায় বন্যার জল, রুপোর মল পরা ঢেউ
মখমল মাটি, শামুক, কাটা, পায়ের রক্তের দাগ,
সব ফিরে আসে আবার।
কার যেন ভিজে চুলের ডাকাডাকি, আকাশময়
যেন একটাই কাজর-পরা চোখ।
চাঁপা ফুলের গন্ধ পুড়তে থাকে দুপুরবেলার রোদে
আমি তার হাহাকারের হাত ধরে ঘুরে বেড়াই।
সেই হাহাকার কতবার তোমার ভেজানো ঘরের দরজার
শিকল ধরে দিয়েছে টান
আঁচলটুকু ধরতে দিয়ে বাকি সব লুকিয়ে রাখতে
লজ্জার কৌটোয়,
চোখের আয়নায় একটু মুখ দেখতে দিয়ে বাকি সব।
সেন্টমাখানো রুমাল কোমরে গুঁজে
স্বপ্নে বেড়াতে আসতে রোজ ।
স্বপ্নে আঁচলহীন ছিলে তুমি।
স্বপ্নে লজ্জাহীন ছিল গোপন চিঠির খসড়াগুলো।
দিনের আলোয় তাদের অশ্নীলতা
ছেঁড়া পাতা হয়ে উড়ে যেতো বাজবরণের ঝোপে।
বৃষ্টি এলে ষোলো বছর বয়সটা ফিরে আসে আবার
আবার আকাশময় এক কাজলপরা চোখ।
আত্মচরিত ০৩
স্মরণাতীত জীবন মনে পড়ে।
মাথায় আঁটা বটের পাতার মুকুট,
খোলামকুচি ধুলোর তেপান্তরে
ছুটছে তার পক্ষীরাজ ছুটুক।
রাজার ছেলে ময়লা পেন্টুলুন
তল্তাবাঁশের কঞ্চি ধনুর্গুণ
ধুলোয় তার বিপুল রাজ্যপাট
বুকের মধ্যে রাজকুমারীর খাট।
কাজল চোখে বিস্ময়ের ঘোর
আকাশে আঁকা মনের ঘর-দোর।
পালক পড়ে পিছন পানে পলক পিছন পানে যেই
কত সকাল সাঁঝের দেখি বর্ণ গেছে হিমে ভিজে বর্ণমালা নেই।
তখন ছিল পিদিম জ্বালা ঘর
বয়স ছিল সোহাগে তৎপর।
বয়সে ছিল মৌমাছিদের ক্ষুধা
মুড়ির সঙ্গে গুড় মিশলেই সুধা।
চোখের সঙ্গে চোখ মিললেই ঝড়।
প্রতিদিনই পালকী-চাপা বর।
তখন ছিল নিত্য খোঁজাখু্বঁজি
আকাশ-পাতাল সিন্দুকের চাবি
কড়ির বয়েম। কেবল ভাবাভাবি
ভীষণ কিছু হারিয়ে যাচ্ছে বুঝি।
গাছ খুঁজতে ফুলের থোকা থোকা
ফুল খুঁজতে গিয়ে বিষম বোকা
ফুলের মতো ফুটল কবে ঐ
কাল যে ছিল এক সাঁতারের সই।
হরিণ কবে চাউনি দিল ওকে?
ঘুমিয়ে পড়ি হরিণ-হারা শোকে?
জলে সাঁতার জলে শালুক জলের মধ্যে গুলি-সুতোয় গোপন টেলিফোন।
এখন শুধু ডাঙায় হাঁটা জীবন থেকে হারিয়ে গেছে জ্বলের নিকেতন।
স্মরণাতীত জীবন মনে পড়ে।
হারিয়েছিলাম ঈশানকোণী ঝড়ে
বিদ্যুতের বিপুল টর্চ জেলে
পৌঁছে দিয়ে গেছে আকাশ ঘরে।
তখন ছিল হারিয়ে যাওয়ার সুখ
হারিয়ে গিয়ে বনের মধ্যে বন
পাতায় পাতা। দিগন্তে উৎসুক
দিন দুবেলার সবুজ নিমন্ত্রণ।
নরম মাটি, শক্ত গাছের ঘাড়ে
কাঠের বেঞ্চে, বাজবরণের ঝাড়ে
খোদাই করে লিখেছিলাম নাম ।
সরলতার ছুরিতে ক্ষুরধার।
চোখের ভাঁজে ভালো মানুষ ভান
রক্তে নাচে রঙীন অত্যাচার।
খাতার পাতা আকাশে ঘুড়ি খাতার পাতা হালকা জলে নৌকা হয়ে নাচে
দুপুর রোদে গা ডুবিয়ে খাতার পাতা পৌঁছে দেওয়া ঝড়-বাদলের কাছে।
তখন ছিল নানান না-এর বেড়া
দেউড়ি-দালান নিষেধ দিয়ে ঘেরা।
না যেখানে সেইখানেতেই ঘাঁটি
পাঁচিল ভেঙে সরল হাঁটাহাঁটি।
আঁচল দিয়ে আড়াল যত কিছু
চোখের চলা কেবল তারই পিছু।
ছুঁতে গিয়ে সরলো যদি কেউ
সাপের ফণা অভিমানের ঢেউ।
অভিমানের সকল জাগা জুড়ে
ক্রমশ বাড়ে একলা হতে থাকা
সন্ন্যাসীর রাগের রোদে পুড়ে
সরল তৃণ খড়্গসম ক্রোধ
একলা হওয়ার দুঃখজনক বোধ।
একলা গাছে একলা পাখি ডাকে।
একলা গাছে একলা ফোটায় ফুল
ছায়ার মধ্যে ছড়িয়ে এলোচুল
একলা এক রুপসী শুয়ে থাকে
বাগানজুড়ে, বসতবাটি, ভুঁই।
তাকে পেলেই একলা আমি দুই।
হারিকেনের আলোয় কাঁপে সজনে পাতায় শিরশিরোনো একলা হিমের রাত
পদ্য লেখার পাতায় কেবল জ্যেৎস্না হয়ে ফুটতে থাকে সকল অসাক্ষাৎ।
স্মরণাতীত জীবন মনে পড়ে।
কাঁসর-ঘন্টা বিপুল ঐকতান
হ্যাজাক-জালা চাতালে চত্বরে
রাসমঞ্চ, গাজন, পালাগান।
গানের মধ্যে গর্জে ওঠে মন
ভাঙতে হবে শিকল ঝনাৎঝন
খুলতে হবে গুপ্তধনের তালা।
বুকের মধ্যে ব্যখার ডালপালা
হাঁকিয়ে তোলে ঝাঁকড়া চুলের ঝড়।
ভিক্ষা নয়, ঘোষণা অতঃপর।
কে দেবে দাও বাড়িয়ে আছি মুঠো
ভালোবাসার সামান্য খড়কুটো।
কে দেবে দাও বাড়িয়ে আছি ক্ষুধা
স্পর্শ, গন্ধ, পরিতৃপ্তির সুধা।
কে দেবে দাও মেলেছি জাগরণ
সার্থকতা, সোনার সিংহাসন।
দিল কি কেউ?দেয়নি বুঝি সব।
ঘোচেনি আজো মনের আর্তরব।
প্রতিধ্বনি, প্রতিধ্বনি, তুমি তো ছিলে আবাল্যকাল সঙ্গী রাত্রিদিন।
কার কাছে কি পাওনা আছে জানিয়ে দিও, কার কাছে কি ঝণ।