গোলাপসুন্দরী পড়ে
তোমাদের মনে হতে পারে ছেলেখেলা, ইয়ার্কি ফাজলেমির নশ্বরতাও হয়তো বা,
কিন্তু এই বুদবুদগুলো প্রকৃতপক্ষে আমার নিজস্ব অহঙ্কার!
হাওয়া, যে-কোনো ওড়াউড়িময় সৃষ্টির সম্পর্কে বিরুদ্ধতার জন্যে যে বিখ্যাত,
সরাসরি তার সঙ্গে এক গোপন পাঞ্জার লড়াইও বলতে পারো এটাকে।
সেই কারণেই আমার হাতের এনামেল বাটিতে সাবান জল
আর এখন আমি এই পাহাড়-সদৃশ হাসপাতালের খৃষ্টপূর্ব প্রাচীনতার সামনে
যার খোপে খোপে মৃত্যুর শৈশবের দিকে
শৈশবের মৃত্যুর দিকে যবনিকাহীন যাতায়াত।
এই বুদবুদগুলো শেষ পর্যন্ত কোথায় পৌছবে আমার জানা নেই
কিন্তু এদের উদ্দেশ্য এবং উপকারিতা সম্বন্ধে আমি শতকরা নিরানব্বই ভাগ সজাগ।
এই রঙীন অহঙ্কারময় খেলাটি আমি আশ্চর্যভাবে শিখে যাই বাল্যকালে
বাল্যকালের পক্ষে যে-সব গল্প প্রবন্ধ কবিতা উপন্যাস ছবি এবং গান অপরাধমূলক
তার প্রত্যেকটির মধ্যেই আমি দেখতে পাই এই সাবান জল
আর সাবানা জলের উপরে ঝুকে পড়া সেই সব মানুষদের
যাদের ক্ষতবিক্ষত মুকের ভাস্কর্য-রেখার উপরে, সমকালীন নয়,
ভবিষ্যৎ শতাব্দীর সুর্যরশ্মি অভ্যর্থনার আয়োজনে ব্যতিব্যস্ত।
বস্তুত এই সাবান জল আমি পেয়ে গেছি একপ্রকার উত্তরাধিকারসূত্রেই
এখনকার এই বুদবুদগুলোই শুধু আমার।
ভ্রাম্যমান অক্ষর!
যাও, আকাশে একটা নতুন এলাচ-গন্ধের দ্বীপ গড়ে এসো।
ভ্রাম্যমান অক্ষর!
ঐ বিশ্বাসহীন যুবকটিকে বলে এসো আকাঙ্খারই অন্য নাম জীবন।
ভ্রাম্যমান অক্ষর!
অসহ্য রক্ত-প্রবাহের পিছনে যে বিশ্বাসঘাতক অস্ত্র
তাকে জানিয়ে দাও একদিনএর প্রতিশোধ নেবে যুদ্ধের চেয়েও ভয়ঙ্কর সব গোলাপ
ডাকাডাকি কেন?
এত ডাকাডাকি কেন?
আমি তো রয়েছি জেগে সর্বসমক্ষেই।
ঐ তো আমার ছেঁড়া চটি জুতো পড়ে আছে
উদ্দাম সোপানে।
আমার তুলির দাগ তোমাদের কাগজে মলাটে
আমার রক্তের দাগও খুঁেজ পাবে ধুলোয় আগুনে।
জেগে আছি বীজে, বৃক্ষে, ফুলে।
তবু এত ডাকাডাকি কেন?
তোমাদের ঝলমলে শিকড়বিহীন মত্ত উল্লাসের চেয়ে
আমার নিভৃত এই অন্ধকার
ভাঙা সিড়ি
গোপন প্রদীপ
ঢের বেশি প্রেয়সীর মতো।
প্রশ্ন
কতটা গভীর হলে
নিরন্তর বেগবান নদী হওয়া যায়।
তুমি তার মাপ জানো নাকি?
মহান বৃক্ষের কাছে
একটি মানুষ এসে
একদিন প্রশ্ন করেছিল।
কতটা আগুন লাগে
নিখিলদহনে পুড়ে
পরিশুদ্ধ মানুষের অবয়ব পেতে
তুমি তার পরিমাণ জানো?
মানুষের কাছে এসে
এই প্রশ্ন করেছিল
কোনো এক ক্ষুধিত পাহাড়।
বিশাখার প্রশ্নে শ্রীরাধা
বিশাখা একি! এ যে সারা জ্বলছে উনোন!
চোখে যেন অগ্নিবৃষ্টি হয়েছে কখন, পুড়ে লাল
ঠোট নীল, চামড়া হলুদ
কপালে ফাটল, ভস্ম মুখে।
চাঁপাকলি আঙুলেরা কাটারি কুড়োলে কাটা ডাল।
মেঘময় কুন্তলের দশা দেখলে হাসবে আঁস্তাকুড়
মরা কচ্ছপের মতো মাথায় উপুড় বাসি খোঁপা
নদীতে আছাড় খেয়ে কপাল ভাঙার পরে নৌকারা যেমন
স্রোতে আত্মসমর্পিত ভেসে থাকা ছাড়া
ভূলে যায় গন্তব্য ও গমনাগমন
সেই হাল জ্বরে-পোড়া তোর শরীরের।
কদমতলার জন্যে তবু চোখ উড়াল ভ্রমর।
চন্দ্রাবলি, শোন!
ভালোবাসাবাসি নিয়ে খেলা হল ঢের
ঢের বাঁশী শোনা হল, ঢের হল গাগরী ভরণ।
আমার মিনতি, যদি না চাস মরণ,
কলসী নামিয়ে রাখ, খুলে ফ্যাল পায়ের নুপুর,
নীলাম্বরী, কাঁখে চন্দ্রহার।
যমুনা আকাশ-কন্যা, জলে গাঢ়, যৌবনেও গাঢ়
যমুনা কালকেও থাকবে কেউ তাকে খাচ্ছেনাকো শুষে
কদমতলাও থাকবে, কুঞ্জছায়া, নিখোঁজ কিংখাব
এবং অগুরু গন্ধে নিকানো দখিন হাওয়া তাও পাওয়া যাবে।
তার শ্যম থাকবে তোরই শ্যাম।
ডাকাতের বাঁশী শুনে পুড়ে-থাক হওয়া ব্যামো ছেড়ে
আজকে নে নিখাদ বিশ্রাম।
শ্রীরাধা শরীরের কথা রাখ,
শরীরেরই যত জ্বর-জ্বালা
নৌকাডুবি, খরা বানে-ভাসা,
বারোমাসে বারোশো মুখোশ।
আমি কি আমার এই শরীরের হাটে কেনা দাসী?
শুধু তার উঠোনেই ঝাঁট-পাট দিয়ে যাব ঋতু গুনে গুনে?
আমি যে ভূমিষ্ঠ সে কি শুধু শরীরের
সমান্তরাল হব একটুকু মিছরী দানা সুখে?
শরীরেরও কতটুকু যথার্য শরীর?
বিশাখা! যখন সূর্য ওঠে,
কিংবা সূর্য ডুবে যায়, যাবার আগের সন্ধিক্ষনে
রাজমহিষীর প্রাপ্য ভালোবাসা দিয়ে
রক্ত ওষ্ঠে দিগন্ত রাঙায়
তখন কে খুশি হল বল?
শরীরের অন্তর্গত চোখ? না শরীর?
নাকি ভিন্নতর কেউ
বুকের ভিতরে গুহা বানিয়ে আলোর স্তব যার?
বিশাখা। আহা! সে তো অন্য আলো!
আকাশের আত্মউন্মোচন।
সে আবীর যত মাখো, চোখ দিয়ে যত করো পান
অবসানহীন।
ঘরের আলোর মতো সে তো আর নিয়মের জ্বলার নেভার
ফাই ফরমাস খেটে গৃহস্থকে খুশি করবার
মাপা-জোপা আলো কিংবা আলো-কণা নয়।
সে এক দ্বিতীয় আলো
দৃষ্টির সুড়ঙ্গ বেয়ে তার অভিযান
চেতনা-শিখরে।
শ্রীরাধা। বিশাখা। তাহলে তুই একটু আগে বললি কি করে
ঢের ভালোবাসাবাসি, ডাকাতের বাঁশী?
সাজানো সংসার, স্বামী সমাজ-শৃঙ্খলা
ভিজে কাপড়ের মতো খুঁটিতে ঝুলিয়ে
আমি যার কাছে যাই সেই এক দ্বিতীয় আলোই।
কতটুকু মাছ-মাংসে শরীর সন্তুষ্ট হয় জানি
শরীরের খিদে মিটলে আরো বড় খিদে জেগে ওঠে।
আমার এ জীবনের কতটুকু ছারখার পুড়বার নশ্বর কঙ্কাল
কতটুকুপৃথিবীর রোদে-জলে মেঘে ঝড়ে চিরকাল লিখে রাখবার
স্বজন মহলে বাধ্য বিনোদিনী হয়ে বেশি সুখ
নাকি বিদ্রোহিনী হলে সমস্ত ললাট জুড়ে আকাশের আর্শীবাদ পাবো।
তারই মূল্যায়ন কিংবা সেই আত্মপরিচয় পেতে
সর্বস্বের বিনিময়ে আমি তার কাছে ছুটে যাই।
দ্বিতীয় আলোর মতো ঐ এক দ্বিতীয় পুরুষ।
তার কাছে পৌঁছলেই পেয়ে যাই নিজের শিকড়,
সংসারের কাটা-ছেঁড়া প্রত্যহের ছোট ছোট মরা
নিমেষে সেলাই এক জরির সুতোয়,
অসি-ত্বে অস্ফুট পদ্মে শত পুষ্প গেয়ে ওঠে গান।
জাগে জন্মান্তর, জাগে নতুন জন্মের নৃত্যতাল
যেন আমাকেই ঘিরে চর্তুদিকে শঙ্খের উৎসব
অন্বিস্ট রয়েছে যার, তার হাঁটা অগ্নি ছুঁয়ে ছুঁয়ে
রক্ত-রেখা পথে, শুধু তাকেই মানায় প্রতিশ্রুত
ঝড়ের রাতের অভিসার।