- বইয়ের নামঃ জেগে আছি, বীজে বৃক্ষে ফুলে
- লেখকের নামঃ পূর্ণেন্দু পত্রী
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অথচ তোমার মুখে আলো
সময়ের ছারখার, অথচ তোমার মুখে আলো।
কালকেউটে এখুনি কামড়ালো
কাকে যেন, কাকে?
এবারও কি লখিন্দর পাবে বেহুলাকে?
ও বৌ ক্রমশ নীল, আরো নীল, রক্তে হিমকণা
ও বৌ আমাকে ছেঁড়ে আগুনের কুড়ি লক্ষ ফণা
ও বৌ আমার হাড়ে বিঁধে যায় কার তুরপুন?
স্মৃতি ঘুম, ঘুমই স্মৃতি
চেতনাসাম্রাজ্যে ঘন ঘুম।
ও বৌ এ কার চোখ, সব দৃশ্যে সাদা অন্ধাকার?
নীলের সবুজ ছিল, সবুজের লাল অহঙ্কার
প্রকৃতি, প্রকৃতি খেলা, এক বর্ণে বহুর বিন্যাস।
জীবন, জীবন মৃত্যু, জয়-পরাজয় নৃত্য, কথাকলি, রাস
তা তা থৈ থৈ
অসি-ত্ব উন্মূখ, তবু সে বৃহৎ ভূমিকম্প কই?
ও বৌ এ কার স্পর্শে, ভস্ম যেন, কার ভস্মাধার?
এখন খাণ্ডব মানে দাহ শুধু, পুড়ে কাঠ-হাওয়া?
খাণ্ডব অরণ্য নয় আর?
ও বৌ ক্রমশ নীল, আরো নীল, দীনতার নীল
বিশুদ্ধতা ভেঙে যায়, নতোমুখ নিজস্ব নিখিল
নীল, নীল
নীল।
সময়ের ছারখার, অথচ তোমার মুখে আলো।
কালকেউটে এখুনি কামড়ালো
কাকে যেন, কাকে?
যেখানেই আত্মদীর্ণ নীল লখিন্দার
বেহুলা কি সেখানেই থাকে?
অষ্টাদশ শতকের মতো ঘুম
কার ডাকে জেগে উঠে
মেঘের গলায় গাঢ় মালকোষ শুনে
আবার ঘুমিয়ে গেছে এই নদীজল।
অথচ নদীর পাড়ে অবিরল চড়-ইভাতির
পেয়ালার পিরীচের ফ্রাই-প্যান কাঁটা-চামচের
মাছের মাংসের স্যালাডের
মাছ ও মাংসের মতো উত্তেজক জানালের ভিডিও টেপের
জিনস মিডি হাইহল মাসকারার গ্লো-গ্লীটারের
হাই-ফাই জমাট সিম্ফনী।
দেশে দেশে দিকপাল ক্ষমতালোভীর মতো প্রতিযোগিতায়
দাঁতালো কামড় ছুঁড়ে সারা বেলা পরস্পর যুদ্ধে নাজেহাল
হাড়গিলে কুকুরের ঝাঁক।
খাক বা না খাক
চিকেনের মিহি হাড়ে পেয়ে গেছে অবিকল পাটলিপুত্রের
সোনার যুগের স্বাদু ঘ্রাণ।
তাজা বিরিয়ানী থেকে যেন কিছু জাফরান খুঁটে নেবে বলে
গাছের নরম ডালে নেমে আসে কাঙাল দুপুর।
আহ্নিক গতিতে সূর্য বাঁকে।
সূর্য যত বাঁকে তত মানুষের ছায়া দীর্ঘ হয়
কোনো কোনো মানুষের ছায়া ফুলে-ফেঁপে ক্রমে পাহাড়-পর্বত
কোনো কোনো মানুষের ছায়া বহু গোল চৌকো নক্শার উল্লাসে
বাগদাদের উড়ন্ত কার্পেট।
কার ডাকে জেগে উঠে
মেঘের গলায় গাঢ় মালকোষ শুনে
অষ্টাদশ শতকের মতো ঘুমে পুনরায় ঘুমিয়ে পড়ছে
এই নদীজল।
আত্মচরিত
এক একদিন ঘুম ভাঙার পর
মাথায় বেঠোফেনের অগ্নিজটাময় চুল।
আর মুখের দুপাশে মায়াকভস্কির হাঁড়িকাঠের মতো চোয়াল।
এক একদিন ঘাড়ের উপর আচমকা লাফিয়ে
কুরে কুরে খায় কান্না, দীর্ঘশ্বাসে দীর্ঘশ্বাসে
যেন ইভান দি টেরিবলের দুমড়োনো চেরকাশভ।
ভাগ্যরেখাহীন রাজপথের আলকাতরায় উপুড় হয়ে আছে
আগামীকালের শোক-তাপ, আর সেই সব চিৎকার
রক্তপাতের রাতের গোলাপ হওয়ার জন্যে যারা উন্মূখ।
ঐ রাজপথের দুপাশে দিনে দশবার হাঁটতে হাঁটতে
যখন মাংসের কিমার মতো থেতো,
হঠাৎ নিজেকে মনে হয় ম্যাকস্ ভন সিদো
বার্গম্যানের সেভেনথ সীল এর সেই মৃত্যুভেদী নায়ক
যার লম্বা মুখের বিষণ্নতায় পৃথিবীর দগদগে মানচিত্র।
এক একদিন ঘুম ভাঙার পর
চোখের ভিতরে বোদলেয়ারের প্রতিহিংসাপরায়ণ চোখ,
মনের ভিতরে জীবনানন্দের প্রেমিক চিলপুরুষের মন,
আর হাসির ভিতরে রেমব্রান্টের হিসেব না-মেলানো হাসির চুরমার।
আমারই তো অক্ষমতা
আমারই তো অক্ষমতা
তোমার গোলাপ জানি সারারাত খুলে রেখেছিল
সাদা অন্ধকারে লাল বাঁকা সিঁড়ি দিক নির্নয়ের
সবুজ কম্পাস।
আঙুরবীথির পথ পরীর ডানার মতো উড়ে গেছে
সংগীতের দিকে।
আমার দীক্ষার কথাছিলঐখানে।
পায়ে পায়ে এত সব শিকড়-বাকড়
নাট-বল্টু, জট্ গুল্মটান
পৌছতে পারিনি।
পরাধীনতার চেয়ে ঢের বেশি বেদনার ভার হয়ে উঠেছে এখন
নানাবিধ স্বাধীন শিকল।
অক্ষরের থেকে আলো
বীজের ভিতর থেকে প্রাণকোষ ছিড়ে নিংড়ে নিয়ে
খোসার উৎসব বেশ জমজমাট বাজারে-বন্দরে।
সমুদ্র আড়াল করে সার্কাসের তাঁবু।
অফিউসের বাঁশি
দিকপাল ক্লাউনেরা পা দিয়ে বাজায়।
আমারই তো অক্ষমতা
সৌররশ্মি দুহাতে পেয়েও
গড়িনি কুঠার।
একটি মৃত্যুর শোকে
একটি মৃত্যুর শোকে
আজকের ভোরবেলা ভরে গেল স্মরনীয়তায়।
অনেক দিনের পরে
রৌদ্রকেও মনে হল শিল্পসচেতন।
ঝাউবনে হাওয়ার বিলাপ:
শুনেছো তো,
মানুষটি জ্বরে ঘুমোতে গিয়েছে?
এতদিন আমাদের নাড়ী ও নক্ষত্রে মিলেমিশে
এতদিন আমদের পরবাস-যাপনের অলৌকিক পুরাণ শুনিয়ে
এতদিন প্রিয়মুখস্মৃতিগুলি সরু টানে এঁকে
দেবতার দুহিতাকে আমাদের রোজকার বৌ-ঝির সিঁথিতে সাজিয়ে
বর্ণকে মন্ত্রের ন্যায় নিনাদিত করে
ঘুমোতে যাওয়ার মতো
মানুষটি চলে গেল আরও বড় স্বপ্নের ভিতরে!
মৃত্যুর বর্ণাঢ্য শোকে
আজকের ভোরবেলা ভরে গেল শিল্পমহিমায়।
কলকাতা
কলকাতা বড় কিউবিক।
যেন পিকাশোর ইজেলে-তুলিতে
গর গরে রাগে ভাঙা।
কলকাতা সুররিয়ালিষ্ট।
যেন শাগালের নীলের লালের
গৃঢ় রহস্যে রাঙা।
কলকাতা বড় অস্থির।
যেন বেঠোফেন ঝড়ে খুঁজছেন।
সিমফনি কোনো শান্তির।
কলকাতা এক স্কাল্পচার।
রদাঁর বাটালি পাথরে কাটছে
পেশল-প্রাণের কান্তি।
কাঠের পায়ে সোনার নূপুর
পাগুলো কাঠের
আর নূপুরগুলো সোনার
এইভাবেই সাজানো মঞ্চে নাচতে এসেছি আমরা
একটু আগে ছুটে গেল যে হলুদ বনহরিনী
ওর পায়ের চেটোয় সাড়ে তিনশো কাঁটা।
সারাটা বিকেল ও শুয়েছিল রক্তপাতের ভিতরে
সারাটা বিকেল ওকে ক্ষতবিক্ষত করেছে
স্মৃতির লম্বা লম্বা পেরেক।
অথচ নাচের ঘন্টা বাজতেই
এক দৌড়ে আগুনের ঠিক মাঝখানে।
বাইরে যখন জলজ্যান্ত দিন
সিঁড়ির বাঁকে বাঁকে তখন কালশিটে অন্ধকার।
যে-সব জানলার উপরে আমাদের গভীর বিশ্বাস
তাদের গা ছুয়েই যতো রাজ্যের ঝড়-বৃষ্টির মেঘ।
অথচ এইসব ভয়-ভাবনার ভিতরেই আমাদের মহড়া
আমাদের ক্লারিওনেট
আমাদের কাঠের পায়ে সোনার নুপুর
আমাদের ডোন্ট-কেয়ার নাচ।