Site icon BnBoi.Com

এক মুঠো রোদ – পূর্ণেন্দু পত্রী

এক মুঠো রোদ - পূর্ণেন্দু পত্রী

অনির্বচনীয়

নীল তারার আকাশে কত গান যে গায় পাখি
কত যে পাখি সাগর-ছোঁয়া ডানায় রোদ ভরে
এখানে আসে-আমার কাছে আমার উঠোনেই
বধূর মতো কোমল দুটি করুণ চোখ তুলে।

বধূও আসে কাজল রাতে কাজলদিঘী জল
যখন ঢাকে চাঁদের মুখ কলমীবন ছুয়ে,
তখন আমি তাকাই শুধু তাকাই বহু দূর
তখন এই হৃদয় যেন হৃদয় কোনো গানের।

কেন যে গান-কেন যে সুর- কেন যে মন, হায়,
হাওয়ার মতো ভরিয়ে দেয় ধানের মিঠে মাঠ,
তবু যে কেন দু চোখে জল, বুকে যে কেন জ্বালা
জানিনে কেন তবুও ঠিক জীবনখানা নেই।

জীবন কই-জীবন বৈ- কেমনে বাঁচা যায়
বাঁচার স্বাদ, বাঁচার সাধ পিদিমে মেটে নাকো,
আরো যে চাই প্রাণের আলো-গানের আত্মদানের
উজাড়-বিষ সন্ধ্যা ভোর আলোয় উন্মনা।

সে আলো জ্বালি- সে প্রাণে ঢালি মরণ অঙ্গীকার
সে ক্ষতবুক কিনার জুড়ে শিবির প্রতিরোধের।
আবার যবে আলোর দিনে হীরণ-শিহরণ,
সুখের ঘর গড়বে বধূ অনির্বচনীয়।

ওগো তুমি বলে দাও

আহা! এই পৃথিবীতে উজ্জীবিত কত না সুন্দর
কত না সুন্দর এই পৃথিবীর অথৈ হৃদয়,
সূর্যোদয়ে কত শোভা কত শোভা গোধূলি সন্ধ্যায়
নক্ষত্র ব্যাপ্তির রূপ বিরহী গগনে উন্মুখর।

সুন্দর দেখেছি কত আশ্বিনে এবং অঘ্রাণে
কতদিন হেমন্তের হাওয়ায় হাওয়ায় ওড়া চুলে,
কমিষ্ঠা কন্ঠার চোখে কত দূর জীবনের সুর
সুন্দর দেখেছি কত রৌদ্রমুগ্ধ ফসলের ঘ্রাণে।

কত যে আলোর গানে একদিন দেশের যৌবন,
ফাঁসীর দড়িতে কত বুক পাতে আলোকিত প্রাণ,
শৃঙ্খলে ঝংকার ওঠে- হৃদয়ে কি আকাঙ্গা উদ্দাম
অসি’সার দেহে মনে প্রেমে প্রচন্ড উন্মেষ।

আমি যে সুন্দর ভালোবাসি
সুন্দরের কাছে মুক্তি চাই।
আমার এ মরুভূমি-মন হৃদয়ের প্রচন্ড দাহন
সুন্দরের সুখেই বিলাই।

আমি যে শান্তিকে ভালোবাসি
কোথায় শান্তির পারাবার?
ওগো তুমি বলে দাও তবে এ আঁধারে পথ পাবো কবে
আলোকের উদার ঝংকার।

ওগো তুমি বলে দাও
কোন পথে জাগবে জীবন।
কোন পথে প্রাণের মিছিল মানুষে মানুষে দৃঢ় মিল
জীবনে নতুন স্বপন।

ওগো তুমি বলে দাও কতকাল পরে
আবার পাখির গান ফিরে পাবো আমাদের ঘরে।
আবার হৃদয় মন মুগ্ধ করে জীবন তন্ময়
আবার সন্ধ্যায় ভোরে কথাকাব্য ফিরে পাবো হাসিতে খুশীতে।

সমস্ত ক্ষতের মুখে একরাশ যন্ত্রণা সরিয়ে
সমস্ত দুঃখের দেশে বাঁচবার নিঃশ্বাস ছড়িয়ে
সমস্ত মায়ের মুখে স্নেহময়ী ছবি এঁকে এঁকে
আবার বসন্ত হাওয়া কথা কবে প্রতি ঘরে ঘরে-
জীবন শুকায়ে গেলে করুণাধারায় ভরে ভরে।

ভাঙা চোরা পথে পথে আবার নতুন সব সুর
নতুন উৎসব কিংবা শেষরাত্রে সেতারের দ্রুতস্পন্দ্য মীড়ে
সমস্ত বাংলার মাঠে ঘাটে ঘাটে উঠোনে দাওয়ায় নীড়ে নীড়ে
কচি কচি ঘাসে ঘাসে বধূর ব্যাকুল চোখে মুখে
শক্তিমান পুরুষের বিদ্যুতের মতো চেতনায়
মুক্তির আনন্দ মাতে-শতধারে উচ্ছল বর্ষায়।

ওগো তুমি বলে দাও মরণ শাসানো এই দিনরাত্রি থেকে
পুঞ্জ পুঞ্জ অমাবস্যা থেকে
কবে যে সুন্দর হবো কবে যে উজ্জ্বল হবো
শরতের নীলের মতন।

কবে যে রৌদ্রের মতো শান্তি দিয়ে সাজাবো পৃথিবী
পৃথিবীর বুক জুড়ে মুঠো সুন্দরের গান।
ওগো তুমি বলে দাও কতকাল পরে
দিকে দিকে আমাদের স্বর্ণচ্ছটা জীবন নির্মান।

কী করে ভালোবাসবো

কী করে ভালোবাসবো বল কী করে ভালোবাসবো বল সখী,
মরুভূমির মতন যদি প্রাণের দাহে অহরহই জ্বলি,
হৃদয়ে যদি গভীর ক্ষত বালুচরের মতন গ্রাস করে,
কী করে ভালোবাসবো বল কী করে ভালোবাসবো বল সখী।

দগ্ধ যদি বুকের টানে আমার সব হাসিরা ঝরে যায়,
আমার সব সকাল আর রাত্রি যদি কাঁদনে ছলোছলো,
আমার সব সূর্যমুখী পাপড়ি ছিড়ে ধুলোয় যদি মেশে,
কী করে ভালোবাসবো বল কী করে ভালোবাসবো বল সখী।

আমার সুখ সাধের ঘরে পিদিম যদি না জ্বলে কোনোদিন,
আমার দূর মাঠের শেষে দুগোছা ধান না যদি পায় রোদ
আমার আম-মউল-স্বাদ হাওয়ায় যদি বারুদ-বিষ ছড়ায়,
কী করে ভালোবাসবো বলকী করে ভালোবাসবো বল সখী।

প্রতিটি অনাহারের রাতে সাপের ফনা দারালো তলোয়ার,
প্রতিটি রোগশোকের দিনে বেদনা যেন শিকারী কোনো রাহু
প্রতিটি মরা মনের ডালে শুকনো সব কুন্দকলি কাঁদে,
মুক্তমাখা পাপিয়ারও সুখের গান শিকলে গাঁট বাঁধা।

কী করে ভালোবাসবো আজ কী করে ভালোবাসাবো বল সখী,
আঁধার -ঘোর আমার ঘরে যদি না কেউ বীরের মতো এসে
জ্বালিয়ে যায় আগুনে এই পাষাণপুরী মনের মণি-মানিক,
কী করে ভালোবাসবো তবে কী করে ভালোবাসবো বল সখী।

প্রার্থী

আমাকে একটু আলোক দাও: রোদ মাতাল ভোর
একটু দাও মুক্ত হাওয়া রুদ্ধশ্বাস এ বুকে,
আমি কী দেব, কি দিতে পারি তোমাকে শক্তিমান
তোমাকে দিই কখানা ভাঙা পাঁজরে যত জ্বালা।

আমাকে একটু বর্ষা দাও: দুমুঠো কাটি ধান
একটু দাও ফাল্গুনে রোদ আঁধার ঘোর ঘরে
আমি কী দেব, কি দিতে পারি তোমাকে মহাব্রতী
তোমাকে দিই কোটরাগত দুচোখে যত দাহ।

আমাকে একটু শক্তি দাও: শারের মতো ঋজু
একটু দাও সুখের ছোঁয়া খসা মনে
আমি কী দেব, কি দিতে পারি তোমাকে মহাপ্রাণ
তোমাকে দিই ঘৃণার ক্ষতে রক্তজবার ঝাড়।

আমাকে একটু শান্তি দাও: ফুলের মতো স্বাদ
একটু দাও অবসরের উদয়মুখী আশা।
আমি কী দেব, কি দিতে পারি তোমাকে জ্যোতির্ময়
তোমাকে দিই আকাশ মাটি কাঁপানো কন্ঠস্বর।

লোকসংগীত

লোকসংগীতে মেলে জীবনের ভাষা
মানুষের কথা শুনি লোকসংগীতে
নির্ভীক কোনো কবিকন্ঠের গান
ম্রিয়মাণ মন জাগায় আচন্বিতে।

যুলে ফলে জলে তরঙ্গায়িত দেশ
গ্রীষ্ম বর্ষা শরতে কি শোভা মাখে,
দরদী বোনেরা ভাইকে বিজয়ী করে
যমের দুয়ারে কাঁটা দেয় লাখে লাখে।

লাজবতী বৌ দু’বেলা উপোসে ধুঁকে
স্বামীকে মাতায় খুশীর অন্নদানে
অনাহারী চোখে কত রাত জননীও
শিয়র জেগেছে পুত্রের কল্যাণে।
অশীতিবর্ষ বৃদ্ধ পাঁজর জুড়ে
কত যে কামনা মাশিকের মতো গাঁথে,
দেহ মন ভাঙে তবু প্রচন্ড আশা
জীয়নকাঠির স্পর্শে হৃদয় পাতে।

লোকসংগীতে নতুন সূর্য দেখা
নতুন আলোক ভরে যায় প্রাণে মনে
সুখের গানের ভরসায় চোখ তুলে
অশ্রূর দানা ঝরে পড়ে জাগরণে।

লোকসংগীতে বিপুল অঙ্গীকার
জীবনকে চেনো জীবনকে আরো জানো,
এই যে স্বার্থসিদ্ধির চোরাবালি
এই যে পাথর নিষ্ঠুর হাতে ভাঙো।

লোকসংগীতে স্বর্গসুখের সাধ।
কঁকিয়ে কান্না নিশ্চুপ নির্বাক।
ঘর বাঁধবার বিদো্রহী আছো নাকি?
আকাশ-পাতাল দুকুল ছাপানো ডাক।

আবহমান কে বুনেছো সোনার ধান?
কে রুপনারায়নে দিয়েছো অথৈ পাড়ি?
মাটির দেয়াল কে গেঁথেছো গাঁয়ে গাঁয়ে?
কে তাঁত চালাও বোনো রামধনু শাড়ী?

একসুরে তালে কথা কও কথা কও
ভয়কন্ঠে তোলো তো জয়োল্লাস,
কৃষ্ণচুড়ায় বসন্ত জেগে আছে
সে-কথা শুনতে কান পাতে মরা ঘাস।

লোকসংগীতে বিদীর্ণ মরা মাটি
সমুদ্রে ওঠে সীমাহীন কলতান,
বন্দীশালায় বাউলকন্ঠ জলে
মনের আগল ভেঙে পড়ে খান্ খান্।

লোকসংগীত গভীর উজ্জীবন
কঁকিয়ে কান্না নিশ্চুপ নির্বাক
ঘর বাঁধবার বিদ্রোহী আছো কেউ?
আকাশে পাতালে আছড়ে পড়ে এ ডাক।

Exit mobile version