বিষন্ন জাহাজ
আমরা যেখানে বসেছিলাম
তার পায়ের তলায় ছিল নদী
নদীতে ছিল নৌকা
আর দূরে একটা বিষন্ন জাহাজ।
আমি যখন তোমার
তুমি যখন আমার ঠোঁটে বুনে দিচ্ছিলে
যাবজ্জীবনের সুখ
ঠিক সেই সময়ে ডুকরে কেঁদে উঠল জাহাজটা
ভোঁ বাজিয়ে।
তারপর থেকে রোজ
আমাদের যাবজ্জীবন সুখের ভিতরে
একটু একটু করে ঢুকে পড়ছে সেই বিষন্ন জাহাজ
তার সেই ভয়ঙ্কর আর্তনাদ বাজিয়ে।
বৃক্ষরোপণ
মেঘ দেখেছে, ঢেউ দেখেছে
আর দেখেছে কাছের অন্ধকার
পাড়া-পড়শী কেউ দেখেনি, সবটা গোপন
বৃক্ষরোপন
সেদিন তোমার মর্মমূলে।
ভীষণ ভূমিকম্পে দুলে
হঠাৎ যেদিন ছিটকে যাবে সকল খেলা
লুকোচুরির
মস্ত ছুরির একক ঘায়ে ভাঙবে যখন
দখলদারির দালান-কোঠা
রঙীন সুতোর সমস্ত ফুল
এবং বোঁটা
প্রকাশ্য রোদ বৃষ্টি তাপে,
তখনো দুই স্পর্শকাতর মনের খাপে
বৃক্ষরোপণ
সেদিন তোমার মর্মমূলে।
বোধ
আমাকে ছুঁয়েছো তুমি
শরীর পেয়েছে প্রিয় রোদ।
আমার যা-কিছু ভেসে গিয়েছিলো
কুয়াশার পারে
সব ফিরে পেয়ে যাব এই তৃপ্ত বোধ
আমাকে করেছে নীল পাখি।
যখন তোমার ফুলবাগানে
কালকে তোমার ডাল ভেঙেছি, ফুল ছিঁড়েছি।
অপরাধের হাওয়ায় ছিল ত্বরিৎগতি
সেই কাঁপুনি ঝাউ পাতাতে, ক্ষয়ক্ষতি যার গায়ের ধুলো
এমন মাদল, যার ডাকে বন আপনি দোলে
পাহাড় ঠেলে পরাণ-সখা বন্ধু আসে আলিঙ্গনে
সমস্ত রাত পায়ে পরায় সর্বস্বান্ত নাচের নেশা।
দস্যু যেমন হাতড়ে খোঁজে বাউটি বালা কেউর কাঁকন,
জলে যেমন সাপের ছোবল
আলগা মাটির আঁচল টানে
দ্বিধাকাতর দেয়াল ভাঙে নোনতা জিভে
কালকে তোমার ফুলবাগনে তেমনি আমার নখের আঁচড়
লজ্জা দিয়ে সাজানো ঘর লুট করেছে।
কালকে তোমার ডাল ভেঙেছি, ফুল ছিঁড়েছি ।
ঝাঁপ দিয়েছি সর্বনাশের গোল আগুনে
উপরে কাঁটা নীচের কাঁটা শুকনো শেঁকুল
তার ভিতরে লুকিয়ে আঁটা সন্নেসীদের কাতান বঁটি
ধর্ম-কর্ম-নিয়ম-নীতি।
ঝাঁপ দিয়েছি উপোস থেকে ইচ্ছা-সুখের লাল আগুনে
পড়বে কিছু পালক পুড়ুক
অশ্বমেধের ভস্ম উডুক বাতাস চিরে।
আলগা মুঠো, পাক, না কিছু খড়ের কুটো।
হ্যাংলা পাখি যা খেতে চায় ঠুকরিয়ে খাক।
লেপ তোষকের উষ্ণ আদর না যদি পাই
একটুখানি আঁচল পেলেই গায়ের চাদর।
অনেক দিনের হাপিত্যেশে নীচে শোকের কালি
বুকের মধ্যে অনেকখানি জায়গা খালি শয্যাপাতার
তুলোর বালিশ ধুলোয় কেন মাখায় থাকুক।
কালকে তোমার ডাল ভেঙেছি, ফুল ছিঁড়েছি।
কালকে ভীষণ গোঁয়ার্তুমি ঝাপটে ছিল পিঠের ডানায়
রক্তনদী কানায় কানায় উথাল-পাথাল
কামড়ে ছিঁড়ে নিংড়ে খাবে, ইচ্ছে চুরি
সমস্ত ফুল বৃন্ত কুঁড়ি, ডালপালা মুল
এমনকি তার পরাগ শুদ্ধ গর্তকেশর।
কালকে হঠাৎ প্রচণ্ড ঝড় ঝাঁকড়া চুলে
শাদা হাড়ের দরজা খুলে রক্তে ঢুকে
খেপিয়েছিল পাঁকের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা জন্তুটাকে।
বাঁধ মানে না, ব্যাধ মানে না এমন দামাল
একটুখানি রক্তমাখা মিষ্টি হাসির গন্ধ পেলেই
পলাশ যেমন এক লহমায় রাঙা মশাল জ্বালায় বনে
তেমনি জ্বালায় নিজের চোখে বাঘের চোখের অগ্নিকণা
মুখস্থ সব অরণ্যানীর পথের বাঁকে
আক্রমণের থাবা সাজায় সংগোপনে,
বনহরিনীর চরণধবনি কখন আসে কখন ভাসে।
সেই কাঙালই সব কেড়েছে কালকে তোমার
কালকে তোমার ডাল ভেঙেছি, ফুল ছিঁড়েছি।
আজকে দেখি খালি মুঠোয়
অন্য রকম কষ্ট লুটোয় ছটফটিয়ে।
বাসর-ভাঙা বাসি ফুলে উড়ছে মাছি
কেবল স্মতি গন্ধ আছে, তাইতে আছি গা ডুবিয়ে।
ডুবতে ডুবতে সব চলে যায় অন্য পারে
সুর্য থেকে সন্ধ্যা ঝরে শিশির-কাতর।
আরো অনেক ডুবতে থাকে হয়তো ছায়া, হয়তো ছবি
বৃহৎ শাড়ি যেমন ডোবে বালতি খানেক সাবান জলে।
আষ্টেপৃষ্ঠে কোমর দড়ি কেউ কি বাঁধে দিগন্তকে ?
নৌকাডুবির মতন গাঢ় আর্তনাদে
কেউ কি কাঁদে আঁধার-ভর্তি হলুদ বনে?
কালকে ছিল ঝলমলানো, আজকে বড় ময়লা ভুবন
এই ভুবনে আমার মতো করুণ কোনো ভিখারী নেই।
বুঝলে শুধু বুঝবে তুমি, তাকিয়ে দেখ
দুই হাতে দুই শুণ্য সাজি, দাঁড়িয়ে আছি
উচ্ছৃসিত পুষ্পরাজি যখন তোমার ফুলবাগানে।
সব দিয়েছেন
দেবার সময় সব দিয়েছেন তিনি।
সাগর জলে নোনা এবং
চায়ের জলে চিনি।
রূপ দিয়েছেন
ধূপ দিয়েছেন
মনকে অন্ধকূপ দিয়েছেন
চাঁদের আলোয় বিষ দিয়েছেন রাতে
তাঁরই কাচের বাসন ভাঙে সামান্য সংঘাতে।
দেবার সময় যা দিয়েছেন
নেবার সময় সবই নেবেন তুলে।
থাকবে কিছু রক্তফোঁটা
ঘনান্ধকার রাত্রে ফোটা
ব্যথাকাতর দু-একটি আঙ্গুলে।
সূর্য ও সময়
হয়তো সূর্যের দোষে আমাদের রক্ত আর ততখানি অগ্নিবর্ণ নয়।
নিমের পাতার মতো নুয়ে গেছে হাত আর হাড়
কবে কবে কমণ্ডলু ভরে গেছে কার্তিকের হিমে, হাহাকারে।
যে-সব পাখিরা আগে মারা গেছে আকাশের আলোর উঠোনে ধান খুঁটে
সেই সব পাখিদের পালকের শতচ্ছিন্ন আঁশ
সেই সব পাখিদের দুবেলার কথাবার্তা, দুঃখ, দীর্ঘশ্বাস
বাতাসের ভিড় ঠেলে এখন ক্রমশ এসে আমাদেরই কাছে ঠাঁই চায়।
সবই কি সূর্যের দোষে? সময়েরও বহু দোষ ছিল।
সময়ের এক চোখে ছানি ছিল অবিবেচনার
জিরাফের গলা নিয়ে সে শুধু দেখেছে দীর্ঘ অট্টালিকা, কুতুবমিনার
দেখেছে জাহাজ শুধু, জাহাজের মাস্থলের কারা কারা মেসো পিসে খুড়ো
দেখেনি ধুলো বা বালি, ভাঙা টালি, কাঁথা-কানি, খড়, খুদ-কুঁড়ো
দেখেনি খালের পাড়ে, ঝোপে-ঝাড়ে, ছেঁড়া মাদুরিতে
আরও কি কি রয়ে গেছে, আরো কারা ঊর্ধ্বমুখী সূর্যমুখী হতে চেয়েছিল
কালবৈশাখীর ক্রদ্ধ বিরুদ্ধতা ঠেলে।
সময়েরই দোষে
আমাদের বজ্র থেকে সমস্ত আগুন খসে গেল
যে রকম বাগানের ইচ্ছে ছিল পাথরের, কাঁকরের বর্বরতা ভেঙে
যে রকম সাঁতারের ইচেছ ছিল জলে স্থলে সপ্তর্ষিমণ্ডলে
ক্রমে ক্রমে সূর্য ম্লান
ক্রমে ক্রমে সময়ের সমস্ত খিলান
পোকার জটিল গর্তে, ঘুণে, ঘুনে জীর্ণ হল বলে
সোজা ঘাড়ে শাল ফেলে সে রকম হাঁটা চলা বাকী হয়ে গেল।
আবার এমনও হতে পারে
আমাদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত আলিঙ্গন, অঙ্গীকার, উষ্ণতার তাপ
কিছুই পায়নি বলে সূর্য ও সময়
প্রতিদিন নিজেদের সমুজ্জল প্রতিভাকে ক্ষয় করে করে,
বেদগানে যে রকম শোনা গিয়েছিল, তত অগ্নিবর্ণ নয়।