কে খেয়েছে চাঁদ
দাঁতে কামড়িয়ে কে খেয়েছে চাঁদ?
সন্ধেবেলায়?
মহাশুন্যের ছড়ানো টেবিলে
পড়ে আছে যেন ছিরিছাঁদহীন ভাঙা বিস্কুট।
কে খেয়েছে চাঁদ?
ক’দিন আগেও কোজাগরী শাড়ি লুটিয়ে হেঁটেছে
বর-বর্নিনী।
যমুনার মতো চিকন অঙ্গ
বুকে তরঙ্গ, কাঁখে তরঙ্গ
আকাশের ঘাটে স্নান করে গেছে লজ্জা ভাসিয়ে
কলসী ভাসিয়ে।
কে খেয়েছে চাঁদ?
কার তৃষ্ণার উনোনে আগুন জ্বলে উঠেছিল?
আগুন দিয়ে কে মেজেছিল দাঁত?
ইচ্ছা-সুখের কালো ভীমরুল
কাকে কামড়িয়ে করেছিল লাল?
কে কয়েছে চাঁদ?
রত্নের থালা কে এটোঁ করেছে জিভের লালায়?
আলোর কুসুম ছিঁড়ে ছিঁড়ে মালা
কে গেঁথেছে মিহি মনের সুতোয়?
ফুসলিয়ে তাকে নদীর আড়ালে কে নিয়ে গিয়েছে?
সন্ধেবেলায়?
কে খেয়েছে চাঁদ?
দিও
আজ সব খুলে দিও,
কোনো ফুল রেখো না আড়ালে
ভু-মধ্যসাগরও যদি চাই, দিও
দু’হাত বাড়ালে।
দ্বিপ্রহরে যদি চাই
গোধুলি বেলার রাঙা ঠোঁট
গোধুলিতে জ্যোৎস্না যদি চাই
কাঠের চেয়ারে বসে
যদি বলি হতে চাই
কীর্তিনাশা নদী
সমস্ত কল্লোল দিও
কোনো টেউ রেখো না আড়ালে।
ভু-মধ্যসাগরও যদি চাই, দিও
দু’হাত বাড়ালে।
দেবতা আছেন
দেবতা আছেন কোথাও কাছাকাছি
পায়ের চিহ্ন বনে
বনের চিহ্ন তারঁই তুলির টান
সরল রেখাঙ্কনে।
জানি না ঘর বসত-বাটী ডেরা
আছেন জানি শুধু
প্রতিদিনের কাঠে ও কেরোসিনে
উঠোন-ভর্তি দুঃখে ও দুর্দিনে
তাঁরই ব্যথার অগ্নিকণা ধু ধু ।
তুমুল হাওয়া, তরল রক্তপাত
চতুর্দিকে দাঁড়কাকেদের দাঁত
স্তুপীকৃত করাত-চেরা বুক।
কুরুক্ষেত্রে ভাঙা রথের চাকা
মৃত মানুষ জ্যান্ত শকুন ঢাকা
তীর ধনুকে ঝলমলিয়ে হাসে
তাঁহারই কৌতুক।
দেবতা আছেন কোথাও কাছাকাছি
হয়তো বোধে, হয়তো ক্রোধে, ক্ষোভে
অবিশ্বাসেও হয়তো কারু-কারু
তাঁরই ডাকে বজ্র ডাকে মেঘে
রৌদ্র ওঠে প্রকিজ্ঞায় রেগে
দৃপ্ত হাঁটে দীর্ঘ দেবদারু।
দেবতা আছেন কোথাও কাছাকাছি
জানি না ঘর বসত-বার্টী ডেরা।
প্রতিদিনের খড়ে এবং কুটোয়
তার ভিতরেই বিদীর্ণ প্রায় তাঁহার
দুঃখী চলাফেরা।
‘আমি তোমারে করিব নিবেদন
আমার সকল প্রাণমন’
ধুপকাঠি বেচতে বেচতে
ধুপকাঠি বেচতে বেচতে কতদুর যেতে পারে একাকী মানুষ?
তাকে তো পেরোতে হবে বহু বন, বহু অগ্নি খাণ্ডব দাহন।
কিছু বন চিনি আমি, পেঁচারা যেখানে বসে কেবলই ধ্বংসের কথা বলে
মগডালে পা ঝুলিয়ে মড়কের হাসি হাসে উলঙ্গ বাদুড়।
দ্বাদশী চাঁদের চেয়ে কয়েকটা চিতাবাঘ পেলে তারা বড় খুশী হয়।
কিছু গাছ চিনি আমি, যাদের মজ্জায় রক্তে রয়ে গেছে আদিম সকাল।
বাইসনের মুন্ডু ছাড়া আর কোনো উৎসবের নাচ যারা দেখেনি কখনো
কিছু গাছ চিনি, যারা এখনো শোনেনি কিংবা শুনে ভুলে গেছে
পৃথিবীতে প্রেম নামে একটা শব্দের চাবি কত দরজা খোলে
অহংকার শব্দটিকে ঘিরে কত বাউন্ডুলে নক্ষত্রেরা আগুন পোহায়
বিষাদ শব্দের মধ্যে বয়ে যায় কি রকম আত্মঘাতী সাদা ঝর্ণাজল।
তারা শুধু কয়েকটি চৌকিদার ও দারোগাকে চেনে
চেনে কিছু শিকারীকে, বন্দুকের নল, কিছু আহত পাখির সরু ডাক।
কাড়া নাকাড়ার চেয়ে আর কোনো মর্মস্পর্শী সুর তারা শোনেনি কখনো।
মানুষ একাকী হেঁটে পার হবে অরন্যের আগুনে গহ্বর
প্রতিভার মতো আলো, মেধার মতন খর রোদে
পৃথিবীকে প্রসারিত করে দেবে বহুদুর পর্বত সিন্ধুর পরপারে
এমন পথিক তারা কখনো দেখেনি, দেখে অট্রহাসি হাসে।
এই সব আহাম্মক গাছ মারা গেলে
কাঠ হয়, ইস্কুলের বেঞ্চি হয়, ব্ল্যাক বোর্ড, জলচৌকী হয়।
ইলেকট্রিক টাঙানোর খুঁটি হয় মাঠে খালে বিলে
ঘুণে জর্জরিত হয়, খসে খসে পচে মাটি হয়।
ধুপকাঠি বেচতে বেচতে যারা একা পৃথিবীর আঁশটে গন্ধ কাদাজলে হাঁটে
মৃত্যুর পরেও তারা কিছুকাল, চিরকাল বেঁচে থাকে স্মরণীয়তায়
মৃত্যুর পরেও বুদ্ধ যেরকম বেঁচে আছে বোধে, সাঁচীস্তুপে।
না
তোমার কাছে চেয়েছিলাম অনির্বচনীয়তা
দাওনি।
আকাশ ভর্তি মেঘ করেছে, মেঘের হাতে তানপুরা
গাওনি।
পায়ের কাছে পৌঁছে দিলাম নৌকা বোঝাই বন্দনা
দাওনি।
গোপন কথা জানিয়েছিলাম, দুত ছিল রাজহংসেরা
পাওনি।
চাইবে বল রক্তকমল ভিজিয়ে দিলাম চন্দনে
চাওনি।
তোমার কাছে চেয়েছিলাম অনির্বচনীয়তা
দাওনি।
পাখি বলে যায়
ওপারে আমার ডিঙি পড়ে আছে, এপারে জল।
অনর্গল
পাতা ঝরে পড়ে। বৃদ্ধ বটের দীর্ঘশ্বাস
মেটে আকাশ
কালো থাবা নাড়ে, যেন গোগ্রাসে গিলবে সব
অর্বাচীন
পাখি বলে যায় আজ দুর্যোগ ক্ষমতাসীন।
ওপারে আমার ভিঙি পড়ে আছে, এপারে চর ধুলি কাতর
পথের দুধারে দুঃখিত বন, ঝাপসা চোখ।
ভীষণ শোক
যে-ভাবে কাঁদায়, সেইভাবে নামে নির্বিকার
মেঘলা দিন।
পাখি বলে যায় আজ দুর্যোগ ক্ষমতাসীন।
ওপারে আমার ডিঙ্গি পড়ে আছে, এপারে ঘাট
খোলা কপাট
ঘরে ডেকে আনে সেই হাওয়া যার হৃদয় নেই।
চারিদিকেই
মনে হয় যেন মরণপন্ন কারো অসুখ
চেতনাহীন।
পাখি বলে যায় আজ দুর্যোগ ক্ষমতাসীন।
পান খাওয়ার গল্প
সবুজ পাতায় প্রথম মাখালে চুন
আট-পহরের ঘাঁটা বিছানায় ধপ ধপে সাদা চাদর
তারপর সেই সাদা চাদরে জাঁতিকাটা ফালা ফালা সুপরি
বহু যুগের ক্ষুধায় কাঁদতে কাঁদতে যে মরেছে তার কঙ্কাল,
আরেকবার বাঁচার ইচ্ছেয় যার হাড়ের ফুটোগুলো
এখনো বাঁশীর মতো ব্যাকুল
অর্থাৎ আমি,
খানিক পরেই আমার পাশে এনে বসাল তোমাকে
কেয়া-খয়েরের কুঁচি
গা ফেটে বেরোচ্ছে ঋতুবতী রমণীর নরম গন্ধ
এমন গন্ধ যে ঘুমোতে দেয় না নিশ্বাসকে
এমন নরম যাতে ভাসিয়ে দেওয়া যায় সর্বঙ্গ।
তিনদিক থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে কে যেন মুড়ে দিল আমাদের
আর, হরিণের হলুদ মাংসে যেমন ব্যাধের তীর,
তেমনি একটি কঠিন লবঙ্গ ভেদ করে চলে গেল
তোমার মধ্যে আমাকে
আমার ভিতরে তোমাকে।
আমি বললাম, সুখী
এই বনগন্ধকেই তো শরীর ছিঁড়ে খুঁজেছি সারাটা গ্রীস্ম।
তুমি বললে, সুখী
তোমার চৌচির ডালপালাকে দেব বলেই তো সাজিয়েছি আমার বসন্ত।
আমাদের সামনে তখন অনন্তকাল।
আমাদের জিভের লালায়, দাঁতের কামড়ে, হাতের থাবায়
পৃথিবীর যত বন, তার গন্ধের ফেনা
যত পাখি, তার পশমের রোদ
যত নদী, তার নুড়ি পাখরের গান।
অমরতার ময়ুর নাচ দেখাবে বলে
যখন একটু একটু করে পেখম মেলছিল রক্তে
ঠিক তখুনি, দুটি আকীর্ণ শরীরের গোপন ভাস্কর্যকে ভেঙে-চুরে,
কেউ একজন চিবিয়ে খেতে লাগল আমাদের খিলিশুদ্ধ।
আমরা রক্তপাতের মতো গড়িয়ে পড়ছি তার ঠোঁটের কশ বেয়ে।