- বইয়ের নামঃ আমিই কচ আমিই দেবযানী
- লেখকের নামঃ পূর্ণেন্দু পত্রী
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আকস্মাৎ শান্তিনিকেতনে
আক্রান্ত পাখির মতো ঘুরে ঘুরে বিপুল রোদনে
চিত্রাঙ্গাদার কন্ঠে এই আর্ত গান।
একি শুধু নাটমঞ্চে ক্ষণিকের খণ্ডদৃশ্য নয়নাভিরাম?
একি শুধু ব্রতচারী অর্জুনের পায়ের পাথরে
কোন এক রমনীর সনির্বদ্ধ পা্রার্থনা, প্রণাম?
এই স্পষ্ট উচ্চারণ আমাদেরও কথা নয় বুঝি?
সামান্য নারীর মধ্যে সর্বান্তঃকরণে যারা খুঁজি
রাজেন্দ্রনন্দিনী,
যারা জানি পৃথিবীর কোনোখানে রয়ে গেছে]
করো দুটি প্রদীপের চোখ
আলো কিংবা আলিঙ্গন দিয়ে
অথবা সকল আলো নিঃশেষে নিভিয়ে
ধুয়ে মুছে দিতে পারে আমাদের নশ্বরতা, সর্বাঙ্গের শোক।
একটি ওষ্ঠের পদ্ম একবার যদি যায় খুলে
এই সব ট্রাম, ট্রেন, টিভি, টেরিলিন
এই সব ধুরব্ধর মাকড়সার মিহিজাল লালায় মৃসৃণ
এই সব আস্তাকুড়, অবিবেচনার ব্যাপ্ত ডামাডোল ভুলে
যারা জানি পেয়ে যাবো শুকনো ঠোঁটে সরবতের স্বাদ
এতো আমাদেরই আর্তনাদ।
আমাদেরও কন্ঠনালী সারেঙ্গীর কিছু সুর জানে,
আমাদেরও বহু কান্না
জলন্ত উল্কা পিণ্ড, ঝরে গেছে শুন্যের শ্মশানে।
দুঃখের উদ্ভিদগুলো ক্রমাগত কঠিন শিকড়ে
বুক চিরে নামে।
অপেক্ষায় অপেক্ষায় ক্রমাগত দীর্ঘ অপেক্ষায়
সাজানো মঞ্চের মতো জেগে আছি পরিপুর্ণ আলোকসজ্জায়
তবু দৃশ্য ফোটে না সেখানে
যেহেতু জানি না কেউ চিত্রাঙ্গদা থাকে কোনখানে।
আমারই ভুলে
আমারই ভুলে
আজ প্রত্যুষে সুর্য ওঠেনি, পাঁশুটে আকাশে আলোর আকাল
আমারই ভুলে
মুর্ছিত মেঘ, খোঁপা-ভাঙা চুল, জলে একাকার যাবজ্জীবন
আমারই ভুলে
স্বেচ্ছাচারীর মতন বাতাস লুটপাট করে যেখানে সেখানে
আমারই ভুলে
ঝরে অরন্য, ঝরে অরণ্যে পুরনো চিঠির মতো মৃত পাতা
আমারই ভুলে
ভুলপথে নদী ভাসিয়ে দিয়েছে শতাধিক সুখ, সাজানো বিছানা
আমারই ভুলে
একটি রমনী একাকী এখন কৌটোবন্দী কাতর ভ্রমর
আমারই ভুলে
আমি ফিরে আসি রাজগৃহ থেকে, ভিজি স্মতিজলে, নোংরা বালিশে।
আমিই কচ আমিই দেবযানী
একটা দিকে খাট পালঙ্ক, আরেকদিকে ঘাম
মধ্যিখানে যজ্ঞে জলে কাঠ
এক পা ছেঅটে ভুবন জুড়ে দিগ্নজয়ী ঘোড়া
আরেক পায়ে জড়ানো চৌকাঠ।
তুলতে যাই ভোরের ফুল শিশিরকণাসহ
অগ্নিকণা লাফিয়ে ওঠে হাতে
ফর্সা রোদে শুকোতে চাই ময়লা বালুচরি
হৃদয় ভেজে অকাল বৃষ্টিপাতে।
শিরীষশাখা শান্তি দেবে, এলাম তপোবনে
হিংসা হানে দুয়ারে করাঘাত
যে ঠুকরে খায় সোনার খাঁচা অপমানের দাঁতে
তাঁর হাঁটুতেই নম্র প্রণিপাত।
একটা চোখে প্রগাঢ় প্রেম, আরেক চোখে ছানি,
আমিই কচ, আমিই দেবযানী।
এই ডালে
এই ডালে দুঃখ এসে বসেছিল কাল।
বসে বসে দেখে গেল পাতা ঝরা, শিশিরের ঝরা
দৃশ্যকে নিহত করে হেমন্তের বাবুগিরি চাল
ফিনফিনে আদ্দির ওড়াওড়ি।
মন্দিরে আরতি নেই, দেখে গেল ধূপে ছাই ঝরা
দেখে গেল বালিশের ফাটা মুখে তুলোর বুদবুদ।
মঞ্চে মৃত অন্ধকার, চরিত্রেরা আসেনি এখনো,
শুধু ড্রপসীনে
পাহাড়ের গায়ে নদী, পলেস্তারা-খসা নীল বন।
এই ডালে দুঃখ এসে বসেছিল কাল।
এখন সবচেয়ে জরুরী
পুরুলিয়ার জন্য এখন সবচেয়ে জরুরী মেঘ
বাঁকুড়ার জন্য সবচেয়ে জরুরী বৃষ্টি
আর আমার ভাঙা দেরাজের জন্য
সেই রমণীর ভালোবাসা।
অমনোযোগের চড়বড়ে রোদে পুড়ছি আমরা তিনজন
যেন যজ্ঞের কাঠ।
পুরুলিয়াকে বাঁচালে
পুরুলিয়া আবার ছৌ-নাচের ময়ুর।
বাঁকুড়াকে বাঁচালে
বাঁকুড়া আবার লক্ষীর ঝাঁপি।
আমাকে বাঁচালে
খরার বুকে সুড়ো জালিয়ে ভাঙা দেরাজে মেরামতির কাজ
দীর্ঘশ্বাসের ঘুণ সরিয়ে নতুন ঝাঁট-পাট, লেপা-পোঁছা,
পুজো-পার্বণের মতো পরিপাটি চুনকাম মনের এপিঠ ওপিঠ।
পাড়া-পড়শীদের চোখ তখন চড়ক গাছে-
আ মরণ।
সেই ঘাটের মড়াটা পুণ্যিমের চাঁদ হয়ে উঠল যে আবার।
ওলটপালট
দরজা ভেঙে দেয়াল ভেঙে ভেঙে
ঘর করেছি খালি।
এখন শুধু অপেক্ষমান
মেঘ শোনাবে মন্দ্রিত গান
ঝড়ের করতালি।
মনের মধ্যে অসংখ্য ঝোপ-ঝাড়
নরুন, ছুঁরি, কাঁচি
কুড়োল কাটে গাছের গুড়ি
ফুল শুকিয়ে পাথর নুড়ি
তার ভিতরেই বাঁচি।
দরজা ভেঙে, দেয়াল ভেঙে ভেঙে
ঘর করেছি খালি।
এখন শুধু ঝড়ের হাসি
উড়বে আবর্জনারাশি
নোংরা ধুলোবালি।
মেঘের ঝুঁটি ঝড়ের কালো জটায়
দেখবো কেমন ওলটপালট ঘটায়।
কাঠঠোকরা
কুড়োলে কাটার বয়স হয়ে এল।
এবার চোখে ছানি, চুলে পাক।
এখনো তোর ক্ষিধে মিটল না হারামজাদা?
আমি কি গাছ আছি সেই আগের মতো?
ছাল ফেটে আটখানা, হাজারটা ক্ষত
হাড়ে-মাংসে এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় সেলাই।
সুতোটা রঙিন, তাই রক্ষে
ফোঁপরা ভেতরটা এড়িয়ে যায় দশজনের চক্ষে।
যখন বয়স ছিল, দিয়েছি, যখন যা চেয়েছিস।
ঠুকরে খেয়েছিস।
চাইলি নদীর মতো শরীর, ভাসতে ডুবতে
চাইলি গন্ধ রুমাল, টাটকা ঠোঁট গোলাপে রাঙা,
পা ছড়িয়ে শোবার পালঙ্ক, পা ছড়িয়ে বসার ডাঙা।
চাইলি মানপত্র সোনার থালায়
তুমুল করতালি, কুচিফুল গলার মালায়
চাইলি জিরাফের গলা, আকাশ থেকে যা দরকার পাড়বি,
চাইলি লম্বা নখ, দ্রৌপদীর শাড়ি কাড়বি
রোদ চাইলি রোদ, জ্যোৎস্না চাইলি জ্যোৎস্না
সবই তো কাসুন্দির মতো চাটনি
এবার একটু থির হয়ে বোস না।
তা নয়, কেবল ঠোকর ঠোকর, ঠোঁটের ঘা।
খুদ-কুঁড়ো বলতে এখন আছে তো কেবল স্মৃতি
হতচ্ছাড়া! তাই খাবি? তো খা।