বজ্র শব্দটাকে
বজ্র শব্দটাকে আমরা ঠিকমতো উচ্চারণ করতে ভুলে গেছি
আর বৃক্ষ শব্দটাকেও।
টাকা-পয়সা শব্দটার ভিতরে লুকনো আছে একটা ঝুমঝুমি
এবং উচ্চারণ করা খুব সহজ।
ঘরবাড়ি শব্দটা সোফায় হেলান দেওয়ার মতো আরামদায়ক
এবং উচ্চারণ করা খুব সহজ।
গাড়িঘোড়া শব্দটা যেন সমুদ্রতীরের হৈ হৈ হাওয়া
এবং উচ্চারণ করা খুব সহজ।
সাহিত্য সংস্কৃতি এইসব শব্দ বুট জুতোর মতো ভারি ছিল বলে
আমরা বানিয়ে নিয়েছি হালকা চপ্পল।
মুক্তি শব্দটা উচ্চারণ করতে গিয়ে
একবার আমাদের হাড়েমাসে ঢুকে পড়েছিল কনকনে শীত।
তাই সংগ্রাম শব্দের মতো তাকেও আমরা যৎপরোনাসি- এড়িয়ে চলি।
নানাবিধ ছোটলাট বড়লাটের পায়ে
কচুটাতার মতো অনবরত আছড়াতে আছড়াতে
বৃক্ষ শব্দটাকে আমরা ঠিকমতো উচ্চারণ করতে ভুলে গেছি
আর বজ্র শব্দটাকেও।
বুকে লেবুপাতার বাগান
গত মাসের কাগজে আমাকে ঘোষণা করা হয়েছে
মৃত।
একাধিক ময়না তদন্তের রিপোর্ট ঘেটে ঘেটে
ওরা খুজেছে লেবুপাতার গন্ধ
আর রুপোলী ডট পেন।
যেহেতু লেবুপাতার গন্ধেই আমি প্রথম পেয়েছিলাম
পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার স্বাদ।
আর ঐ রুপোলী ডট্ পেন আমাকে শিখিয়েছিল
অক্ষর দিয়ে কিভাবে গড়তে হয় শাখা-প্রশাখাময় জীবন।
গত মাসের কাগজে মৃত ঘোষনার পরেও
ওরা কিন্তু তন্ন তন্ন খুঁজে বেড়াচ্ছে
পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত দামাল শালবন।
ওদের বুট জুতোয় থ্যেৎলে যাচ্ছে
সুর্যকিরণে জেগে ওঠা জল,
মানুষের মধ্যে যাতায়াতকারী সাঁকো।
আমি এখন উদয় এবং অন্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান
মন কেমন করে
ভীষ্মদেবের জন্যে মাঝে মাঝে মন কেমন করে
আবার যামিনী রায়ের জন্যেও।
সমস্ত বৃহৎ অট্টালিকার ভিতরে ঢুকে পড়েছে আগুনের শিকড়
সমস্ত প্রাচীন বইত্রে উইপোকার তছনছ সুড়ঙ্গ
সমস্ত সুফলা গাছের গায়ে কুড়োলের আঠারো ঘা আর রক্ত পুঁজ।
আমীর খাঁর জন্যে মাঝে মাঝে মন কেমন করে
আবার জীবনানন্দের জন্যেও।
গান এবং ছবি যখন যে পথ দিয়ে মানুষের কাছে আসতে চায়
সেই দিকেই ঝুঁকে পড়ে কড়কড়ে মেঘ আর বাতাসের লম্ফ-ঝম্ফ।
আমাদের সামনে দৃশ্য বলতে এখন চুনকাম করা দেয়াল
আর শব্দ বলতে সেই সব উল্লাস, যা সারমর্মহীন।
ভাঙা মন্দিরের টেরাকোটার জন্যে মন কেমন করে
আবার সেনেট হলের সিড়ির জন্যেও।
সেই সব মহিমাময় নক্ষত্রেরা মরে গেছে
যারা জীবনের গায়ে জড়িয়ে দেয় ভয়ঙ্কর উচ্চাভিলাষ।
সেই সব ছলবলে নদীরাও শুকিয়ে গেছে মানচিত্রে
যাদের মুখস্থ ছিল মহাদেবের জটার ঠিকানা।
ক্রমশ কমে যাচ্ছে সেই সব মানুষ যারা মৃগনাভির মতো।
মাঝে মাঝে গান্ডীবের জন্যে মন কেমন করে
আবার একতারার জন্যেও।
মাছটি আমার চাই
তরল জলে সরলপুটি বেড়াচ্ছিল খেলে
লোকটা তাকে হঠাৎ দেখতে পেলে।
দেখতে পেয়েই চোখ হল তার কনে দেখার আলো
মনটা যেন হাত-বাড়ালো খিড়কি দুয়োর ঠেলে
মাছটি আমার চাই।
বেনারসীর শাড়ি চাইলে বেনারসীর শাড়ি
সাতমহলা বাড়ি চাইলে সাতমহলা বাড়ি
আলতা, সিদুর আতর, সাবান লংলেইং এ গান
জর্দমাখা পান চাইলে জর্দামাখা পান
মাছটি আমার চাই।
হৃদয় জুড়ে শতেক ফুটো খড় কুটোতে ঢাকা
জীবন যেন গন্ডে পড়া গুরুর গাড়ির চাকা।
তরল জলে সরল পুটি মনমোহিনী আঁশ
এক ঝিলিকেই কী সুখ দিলো, সুখ যেন সন্ত্রাস।
ওকে পেলেই শোক পালাবে
শোক পালালে স্বর্গ পাবো, চন্দ্রালোকে ঠাঁই
মাছটি আমার চাই
শোনো, মাছটি আমার চাই।
রাত গাঢ় হলেই
রাত গাঢ় হলেই আমি নিজেকে ছিঁড়ে নিতে পারি
পৃথিবীর রক্তাক্ত নাড়ির খামচা থেকে।
রাত গাঢ় হলেই বুঝতে পারি সমস্ত শব্দের ঠিক ঠিক মানে,
সমস্ত ঘটনার ছাল ছাড়িয়ে পৌঁছতে পারি তার হৃৎপিন্ডে।
যত রকম জিজ্ঞাসা আছে তার সব কিছুকে জুড়লে একটা মানুষ।
মানুষের জিজ্ঞাসা মানুষকে টেনে নিয়ে যায়।
মাটির থেকে উপরে, খানাখন্দ সাঁকো সুড়াঙ্েগর উপরে
ফিনফিনে শান্তি, এমনকি ধপধপে কাচা নিরাপত্তার উপরে
এমন সৌরলোকে, যেখানে আলোর বর্শা থাক থাক করে সাজানো।
রাত গাঢ় হলেই নক্ষত্রগুলো উজ্জল হয়ে ওঠে
তপঃ ক্লিষ্ট ঋষিদের মতো,
এবং তাঁরা নেমে আসেন পৃথিবীর খরখরে অন্ধকারের অলিতে গলিতে।
আর সেই সুযোগে আমার দেখা হয়ে যায়।
প্রত্যেকটি স্তম্ভের ভিতরকার ফাটল
প্রত্যেকটি হিতৈষী পুরুষের ছোরার মতো চোরা হাসি
প্রত্যেকটি ঘড়ির কাঁটায় বিস্ফোরনের গোপন নির্দেশ।
রাত গাঢ় হলেই নিজের পৃথিবীকে কাছে পাই আমি।
হাজার মাইল ফলন্ত শশ্যের ক্ষেত হয়ে যায় আমার ভাবনাগুলো।
আর উন্মাদ পুরুষ যেভাবে নারীকে ভালোবাসে নিংড়ে নিংড়ে
সেই ভাবে সময়ের সঙ্গে আমার
তুমুল ভালোবাসাবাসির সংঘর্ষ।
সেই গল্পটা
আমার সেই গল্পটা এখনো শেষ হয়নি।
শোনো।
পাহাড়টা, আগেই বলেছি
ভালোবেসেছিল মেঘকে
আর মেঘ কী ভাবে শুকনো খটখটে পাহাড়টাকে
বানিয়ে তুলেছিল ছাব্বিশ বছরের ছোকরা
সে তো আগেই শুনেছো।
সেদিন ছিল পাহাড়টার জন্মদিন।
পাহাড় মেঘেকে বললে
আজ তুমি লাল শাড়ি পরে আসবে।
মেঘ পাহাড়কে বললে
আজ তোমাকে স্মান করিয়ে দেবো চন্দন জলে।
ভালোবাসলে নারীরা হয়ে যায় নরম নদী
পুরুষেরা জ্বলন্ত কাঠ।
সেইভাবেই মেঘ ছিল পাহাড়ের আলিঙ্গনেরআগুনে
পাহাড় ছিল মেঘের ঢেউ-জলে।
হঠাৎ,
আকাশ জুড়ে বেজে উঠল ঝড়ের জগঝম্প
ঝাঁকড়া চুল উড়িয়ে ছিনতাইয়ের ভঙ্গিতে ছুটে এল
এক ঝাঁক হাওয়া
মেঘের আঁচলে টান মেরে বললে
ওঠ্ ছুড়ি! তোর বিয়ে।
এখনো শেষ হয়নি গল্পটা।
বজ্রের সঙ্গে মেঘের বিয়েটা হয়ে গেল ঠিকই
কিন্তু পাহাড়কে সে কোনোদিনই ভুলতে পারল না।
বিশ্বাস না হয় তো চিরে দেখতো পারো
পাহাড়টার হাড় পাঁজর,
ভিতরে থৈ থৈ করছে
শত ঝর্ণার জল।