দীপেন বললেই
দীপেন বললেই
একটা প্রকাণ্ড গাছ
ঝড়াকে যার থোড়াই কেয়ার।
একটা চওড়া বাধ
য়ার কাছে নতজানু
সমস্ত প্লাবনের জল।
কি চমৎকার আগুন নিয়ে খেলা করতো
দীপেন
পুড়তো না কিছু
শুধু জলজল করে উঠতো
চারপাশের নুড়ি, পাথর, ধুলোবালি।
কী চমৎকার বাঁশী বাজাতো
দীপেন
সাপের ফণাগুলো
মুখোশ খুলে ছুটে আসতো
আলিঙ্গনের লতাপল্লবে।
দীপেন বললেই
লক্ষ্নৌ এর বাদশাহী রাত,
আমাদের আদি যৌবনের
তুলকালাম দাপাদাপি।
আবার
গানের কলির অলিতে গলিতে
কাকে খুঁজে বেড়ানো।
দীপেন বললেই
ময়দানের ঘাসে
হাজার পতাকার হৈ হৈ হাসি
শুকনো মুখের কুলঙ্গীতে
সার সার প্রদীপ।
দীপেনকে
সব গোপন কথা বলতে পারি আমি।
দীপেনকে
ছুরির ফলায় টুকরো করতে পারি আমি।
বাতিল কাগজের মতো দলা পাকাতে পারি আমি।
দীপেন শুধু বলবে
আয়! বোস হতভাগা
মুখে জয়জয়ন্তী হাসি।
দীপেন
আমি তোর শোকসভায় গিয়েছিলাম।
তুই লম্বা হতে হতে
ভালোবাসার আলোয় ভোরের মতো
রাঙা হতে হতে
ফুলের মালায়
ক্লান্ত হতে হতে
কোথায় যেন চলে যাচ্ছিস।
কোথায়?
তুই বললি
বোস্ হতভাগা। আসছি।
দু-পাল্লা জানালা
দু-পাল্লা জানালা কেউ পেয়ে যায় মর্মের ভিতরে
দৈববাণী আসে সেই পথে।
তোমরা বিদীর্ণ হও, যারা গাও নক্ষত্রের স্তব
তোমরা রক্তাক্ত হও, যারা চাও দুষপ্রাপ্য লন্ঠন
তোমরা একাকী হও, যারা খোঁজো মানুষের মুখে
মহাবল্লীপুরমের স্তম্ভের মতন কারুকাজ।
ভিজে তোয়ারের মতো নিজেকে নিংড়িয়ে শুকনো করো
চিরতৃণ হয়ে ফোটো শ্মশানের কাঠ-কয়লা চিরে।
ভিখারীর প্রিয়তম আধুলির মতো যোগ্য হও
পৃথিবীর ভাঙাচোরা অ্যালুমিনিয়মের বাটিতে।
দু-পাল্লা জানালা কেউ পেয়ে যায় মর্মের ভিতরে
ঈশ্বর সেখানে এসে এইভাবে কথা বলে যান।
দুঃখ দিয়েছিলে তুমি
দুঃখ দিয়েছিলে তুমি
আবার লাইটারও দিয়েছিলে।
বোতাম ছিড়ে আমাকে লগ্ন করেছো তুমি
আবারবুনে দিয়েছো নাইলনের সবুজ জামা।
কমলালেবু নিংড়ে নিংড়ে বানানো সরবৎ
ভিতরে মিশিয়ে দিলে গোপন কান্নাকাটি
স্মৃতির পেস্তা-বাদাম
সেই সরবৎ খেতে হবে এখন প্রত্যহ
বাইশ বছরের যুবকটা যতদিন আমার
চুলের ভিতরে আঁচড়াবে
আগুন রঙের চিরুনি।
দৈববাণী
বৃক্ষ হবো
চারপাশে আলোকিত জলের বাঁক
জলের গভীরে নারীর সাজবদলের মতো দৃশ্য
দৃশ্যের গভীরে সুগম্ভীর ঘন্টাধ্বনি
মাতৃজঠর থেকে আমরা শুনে আসছি এই সব দৈববাণী।
ব্রাক্ষ্ম মুহুর্তের রাঙা আবীরের মতো আমাদের ভ্রমণ হবে ভূ-পৃষ্ঠময়
ঋষিকুমারের মতো আমরা খচিত হবো দুর্লভ প্রবালে
নানা রকমের লাল দেয়ালে কালো অক্ষরে
নানা রকমের কালো দেয়ালে লাল অক্ষরে
নানা রকমের গাঢ় এবং ফিকে পতাকার মিছিলে, দুন্দুভিতে
মাতৃজঠর থেকে শুনে আসছি দৈববাণী।
আহলাদে লাফিয়ে উঠেছে দুশো বছরের পুরনো কার্পেটের ধুলো
উন্মাদ নেচে উঠেছে বাঁশবাগান, ঘুটের দেয়াল
ভাঙা তক্তাপোষের পেরেক।
গম্বুজ থেকে গম্বুজে, রেলব্রীজ থেকে সাঁকোয় এবং ফ্লাইওভারে
রেডিও থেকে টিভিতে, ট্রাকটরে, ইঞ্জিনে গরুর গাড়ির কান্নায়
ভিটামিনের মতো ছড়িয়ে পড়েছে এইসব দৈববানী।
বৃক্ষের কালো চিমনিগুলো এখন উগরে চলেছে শোকবার্তা
বৃক্ষকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে জলের উদ্দাম গীটার
জলের ভিতরের দৃশ্যবলীতে ঢুকে পড়েছে জন্ডিসের হাত।
দেখতে দেখতে যাদের বয়স ছিল আঠারো, এখন আটচল্লিশ,
পঞ্চদশীরা প্রৌঢ়া,
চামড়া ফেটে বল্কল, চোখে ছানি, হাঁটুতে ঘুণ।
উড়ন্ত পাখিরা হাওয়ার ভিতরে হিমের ফোঁটার মতো মুমূর্ষ!
আর ক্রমশ সূর্যাসে-র দিকে হেলে পড়ছে মহীয়ান সব ভাস্কর্য
বেঁকে যাচ্ছে পিতৃপুরুষের আজানুলম্বিত খিলান
ক্রমশ শঙ্খধ্বনির চেয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে ঠিকানাহীন শিয়াল-কুকুরের ডাক।
সমস্ত দৈববানীর গায়ে পিত্তি, পরগাছা এবং পোকামাকড়।
নিসর্গ
ছিঃ ছিঃ।
ছেঁড়া-খোঁড়া এক ফালি সবুজ রুমালের জন্যে আমাদের হা-পিত্যেশ,
আর তুই মাছরাঙা রঙের সাত-সাতটা পাহাড়
আর মিছিলের মতো লম্বা আঠারো মাইল শাল-মহুয়ার বন
আর গায়ে হলুদের কনের মতো একটা গোটা নদী আঁকড়িয়ে?
আবার নীল মেঘের খোঁপায় কি গুজেছিস ওটা?
সূর্যাসে-র লাল পালক?
চলতে-ফিরতে পায়ে বাজছে রুপোর মল
ভিতরে একশো গন্ডা পাখির স্বর।
আদরখাকী, বেশ আছিস তুই রাজবাড়ি বিছিয়ে।
তোর কাছে এলে সোনালী কুকুরের মতো লাফিয়ে ওঠে জন্মজন্মান্তর
মনে পড়ে যায় পুরনো শতাব্দীর সেই সব খেলাধুলো
যখন আমরাই ছিলাম দিগদিগন্তের রাজাধিরাজ
হাজার হাজার বর্গমাইল জুড়ে আমাদের মুক্তাঞ্চল
আমরাই পদ্মপাতায় ওলোট-পালট হাওয়া
মেঘের ভিতরে আমাদের কাশবন, বাঁশবন, নাগরদোলা
জলের ভিতরে অফুরন্ত মৃগয়া
সন্ধের চাঁদকে আমরাই জাগিয়ে দিয়ে বলতাম, যা, বেড়িয়ে আয়।
এখন আমরা কলের গানের মতো এটেঁ গেছি কাঠের চৌকো বাক্সে
আমাদের ঘর আছে কিন্তু জানলা নেই
জানলা আছে কিন্তু নিসর্গ নেই।
শক্তিশালী করাতে প্রত্যহ আমাদের কাট-ছাঁট
কত্তার মার্জিমাফিক কখনো দৈত্য দানবের মতো লম্বা
কখনো ভিখিরির দুপয়সার মতো চ্যাপ্টা।
গরবিনী, হঠাৎ ছুটি-ছাটায় চলে এলে
তোর মায়াকাননের অন্তর্বাস খুলে দিবি তো ঘুমের আগে?
পোশাক-পরিচ্ছদ
নতুন জামা-জুতো পরলে পরিচয়হীন অন্যলোক হয়ে যাই আমি।
তখন নিজেকেই প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, কেমন আছেন ? ভালো?
একবার বিদেশে গিয়েছিলাম অন্য লোকের ওভারকোট পরে
সকালসন্ধে সেই ওভারকোট পরা মানুষটাকে দেখে মনে হতো
মিলিটারি-কামড়ানো কোন রাজ্যের পলাতক রাষ্ট্রপতি।
এইসব দেখেশুনেই আমার ধারণা, মানুষের কোন ধরা-বাঁধা পোশাক
না থাকাই ভালো।
স্বাধীন চডুই-এর মতো যখন যে-রকম খুশী পোশাক-পরিচ্ছদে ঢুকে পডুক।
রমণীদের এত ভালো লাগে এ জন্যেই । প্রতিনি নতুন। আলাদা আলাদা।
যেদিন সবুজ শাড়ি, যেন ঘাড়ের কাছে ঝুঁকে-পড়া লতানো জুই-এর ডাল
হাত ধরে ডেকে নিয়ে যাবে ঝাউবনের গোপন আঁধারে,
আগুনের উল্কি এঁকে দেবে হাতে, বুকে। দাঁতে চিবোতে দেবে লাল লবঙ্গ।
যেদিন লাল শাড়ি, কোমরের ঢাল থেকে উকি মারে তুর্কি ছোরার বাঁট।
কমলারঙের ছাপা শাড়ি যেদিন, বুঝতে পারি এই সেই চিতাবাঘ
মোলায়েম ঊরুর উপর শুইয়ে যে আমাকে চেটে-পুটে খাবে এখন ।
বেশ মজা পাই, নিজেকে নানান পোশাক-পরিচ্ছদে পুরে।
মাঝে মাঝে ঢুকে পড়তে ইচ্ছে করে তাগড়াই ঘোড়ার কেশরে,
মাঝে মাঝে টিয়া টুনটুনির পালকে।
একবার এক বিকলাঙ্গ জটায়ুর কাছে প্রার্থনা করেছিলাম
তার রক্তক্ষতময় ডানা,
একবার এক মৃত হরিণের কাছে তার ভ্রমনবিলাশী সোনালী ছাল।
বাঘের চেযে আমার অনেক ভালো লাগে জিরাফের ডোরা।
কিন্তু জিরাফের চেয়ে ভালো লাগে বাঘের সম্রাট-সুলভ চালচলন।
এক-একদিন খেলতে খেলতে হেরে গিয়ে শামুক-গুগলির মতো ছোট হয়ে যাই
তখন সর্বাঙ্গ কাতর হয়ে ওঠে শজারুর বর্শাফলকের জন্যে।
এক-একদিন কারখানা কিংবা কারখানার ম্যানেজারবাবু
বুকের বোতলে প্লাস্টিকের সরু স্ট্র ঢুকিয়ে লম্বা চুমুকে শুষে নেন
সমস্ত জল, জলস্তম্ভ, জোয়ার।
তখন চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়, বন্ধগণ।
গণ্ডারের চামড়া এনে দিতে পারেন কেউ? অথবা বাইসনের সিং?