আসুন, ভাজা মৌরী খাই
দেখুন, দেখুন, প্রজাপতিগুলো
এবেলা-ওবেলা ঝুলতে ঝুলতে কেমন বাদুড়
আর গুয়োপোকাগুলোর কেমন বাঁই বাঁই উড়োজাহাজে পিঠ এলিয়ে
আর ঘরবাড়িগুলো
কী বিশ্রী রকম কোৎ পেড়ে চলেছে প্রসব-যন্ত্রণায়।
আসুন এই ফাঁকে আমরা একমুঠো ভাজা মৌরী খাই
আর টুথ পিকে দাঁতের মাংস খুঁটি।
দেখুন দেখুন, লম্বা মানুষগুলো
কেমন বেঁটে হয়ে যাচ্ছে গায়ে নামাবলী জড়িয়ে
আর শক্ত দেয়ালগুলো
কেমন কুজো হয়ে পড়েছে প্রতিশ্রুতির বড় হরফের ভারে
আর আবহাওয়ার তলপেটে
কেমন গোঁ গোঁ করছে নতুন বিপদ-আপদ।
আসুন এই ফাঁকে আমরা একুমঠো ভাজা মৌরী খাই
আর টুথ পিকে দাঁতের মাংস খুঁটি।
দেখুন দেখুন, ঝড় নেই
তবু ভেঙে পড়ছে ইস্পাতের পঞ্চবার্ষিকী কাঠামো।
ভেঙে পড়ছে মুখোশের হাড়গোড় এবং বক্তৃতামঞ্চ।
আর ঝড়ের পাখিগুলো।
নতুন গ্রামোফোনে গেয়ে চলেছে পুরনো কাওয়ালি।
আসুন এই ফাঁকে আমরা একমুঠো ভাজা মৌরী খাই
আর টুথ পিকে দাঁতের মাংস খুঁটি।
একি অমঙ্গল
তোমার হাতে ছুঁচ-সুতোটি
আমার হাতে ফুল
দেখতে পেয়েই আকাশ জুড়ে হিংসা হুলুস্থুল।
তোমার হাতে রঙের বাটি
আমার হাতে তুলি
দেখতে পেয়েই শুকনো মড়া চোখে জ্বালায় চুলি।
তোমার হাতে ধান-দুর্বো
আমার হাতে শাঁখ
দেখতে পেয়েই আকাশ চিরে শকুন পাড়ে হাঁক।
তোমার হাতে জলের ঘাট
আমার ঠোঁটে জল
দেখতে পেয়েই দৈববাণী: এ কি অমঙ্গল!
গভীর ফাটল তবু
বনে ও জঙ্গলে রোদ ছায়া গুলে আলপনা আঁকে
আকাশের আর্শীবাদ তৃণ শস্য সারা গায়ে মাখে
গভীর ফাটল তবু পৃথিবীর মাঠে পড়ে থাকে।
মেঘ নামে, বৃষ্টি পড়ে, বীজেরা ভুমিষ্ট হতে থাকে
যুবতীর ভঙ্গিমায় তরুলতা দিনে দিনে পাকে
গভীর ফাটল তবু পৃথিবীর মাঠে পড়ে থাকে।
মানুষের ঘুম ভাঙে বনবাসী পাখিদের ডাকে
আকাঙ্খাকে কাঁধে নিয়ে হেঁেট যায় সাঁকো পার হয়ে দূর বাঁকে
গভীর ফাটল তবু পৃথিবীর মাঠে পড়ে থাকে।
পুরনো সংসারে ধুলো চমকে ওঠে অবেলার শাঁখে
নতুন বধুর লাল শাড়ির এয়োতী-রঙ পদ্ম মুখে মাখে।
গভীর ফাটল তবু পৃথিবীর মাঠে পড়ে থাকে।
নারীরা পুরনো হয়, যুবকেরা বেঁকে যায় দুঃখে দুর্বিপাকে
জননীরা তুলে নেয় মৃত্যুর সংসার কোলে-কাঁখে
গভীর ফাটল তবু পৃথিবীর মাঠে পড়ে থাকে।
গাছপালাগুলো
গাছপালাগুলো যেন কেমন হয়ে গেছে আজকাল।
কেউ কেউ স্মান করেনি কতদিন
কেউ কেউ চুল কাটেনি কতদিন
কেউ কেউ বাসি জামাকাপড় পরে আছে কতদিন।
মনে হয় মাঝরাতে ঘুসঘুসে জ্বর হয় কারো কারো
কারো কারো হাঁপানির শ্বাসকষ্ট শুনতে পাই মাঝরাতে
স্বপ্নের মধ্যে এপাশ-ওপাশ আইঢাই করে কেউ কেউ।
কেউ কেউ নিশ্বাস ফেলে আগুনে হাপরের মতো।
গাছপালাগুলো সত্যি সত্যি কেমন হয়ে গেছে আজকাল।
একটু সব্য-ভব্য হ।
বাইরে যখন ঝড়-ঝাপটার ওলোট-পালোট হাওয়া
ঘরে শুয়ে বসে থাক দুদণ্ড।
দেখছিস তো দিনকাল খারাপ
মেঘে মেঘে দলা পাকাচ্ছে গোপন ফিসফাস
দেখছিস তো ইট চাপা পড়ে ঘাসের রঙ হলুদ।
দেখছিস তো যে-পাখি উড়তে চায় তার ডানায় রক্ত।
একটু সাবধান সতর্ক হ।
সে-সব কথা কানে ঢোকে নাকি বাবুদের?
উড়নচন্ডের মতো কেবল ঘুরছে আর পুড়ছে,
যেন এক একটি বদরাগী বশিষ্ঠ বিশ্বামিত্র।
এক-একদিন না চেঁচিয়ে পারি না।
-ও হতভাগারা! যাচ্ছিস কোন চুলোয়?
-ভাঙতে।
-কী?
-সেই সব থাম, যাদের গায়ে সাত শতাব্দীর ফাটল।
-তারপর?
-সেই সব পাথর, যাদের দেবতা সাজিয়ে আরতি হচ্ছে ভুল মন্ত্রে।
-তারপর?
-সেই সব তালা, যার ভিতরে ডাঁই হয়ে আছে যুগ যুগান্তের লুটের মাল।
-তাহলে ফুল ফোটাবি কবে?
-আগে আগে- গা লাগিয়ে অরণ্যহই
পরাস্ত অন্ধকারের কবর খুঁিড় এঁদো জঙ্গলে
তারপর ডালপালা ঝাঁপিয়ে ফুল
ফুলের মশাল জ্বালিয়ে আহলাদে আটখানা হৈ হৈ উৎসব।
-তবে মরগে যা! মরে আকাশ পিদিম হ।
এই বলে আমি খিল তুলে দিই আমার খিড়কি দরজায়।
চেনা যায়
অন্ধকার ছিলে বুঝি?
গাছের আড়ালে ছিলে, গর্তে ছিলে
ভিজে খড়ে জড়াজড়ি ছিলে?
মাথাভর্তি লণ্ডভণ্ড চুল।
সারা গায়ে রক্তের আঁকচারা।
যুদ্ধে ছিলে, সেনাপতি ছিলে?
এখনও তোমার চোখে আগুনের ছাই
প্রকাণ্ড কপাল জুড়ে থাকে থাকে
গুপ্ত অস্ত্রাগার।
বহুদিন পরে দেখা
তবুও তোমাকে ঠিক অভিমন্য বলে
চেনা যায়।
তোমার জন্যে, ও আমার প্রিয়া
(জ্যাক প্রেভেরকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে)
আমি গেলাম পাখির বাজারে
তোমার জন্যে পাখি কিনতে
ও আমার প্রিয়া।
পাখির বাজারে পাখি নেই।
থিক খিক করছে লোহা-লক্কড়ের খাঁচা
আর সরু মোটা শিকলি
আর সেই সব দাঁড়িপাল্লা যাতে রক্ত ওজন হয়
সেরা জাতের পাখিদের সবুজ হৃৎপিণ্ড।
আমি গেলাম ফুলের বাজারে
তোমার জন্যে ফুল কিনতে
ও আমার প্রিয়া।
ফুলের বাজারে ফুল নেই।
থিক থিক করছে নীল মাছি হলুদ ডানা
আর চিমসে পোকামাকড়
আর বেশ্যার দালারদের সেই সব ফলন্ত মগজ
রাংতাকে সোনার দামে বেচতে বেচতে
যারা লাট-বেলাট।
আমি গেলাম গয়নার বাজারে
তোমার জন্যে গয়না কিনতে
ও আমার প্রিয়া।
গয়নার বাজারে গয়না নেই।
গিজ্ গিজ্ করছে লম্বা ঠ্যাঙের কাঁটা কম্পাস
আর খরখরে দাঁতের করাত
কুড়োল, কাটারি, কর্নিক।
আর পরোপকারী সেই সব তুখোড় কম্পিউটার
যারা এক নিশ্বাসে বলে দিতে পারে
পৃথিবীর যাবতীয় গুপ্তহত্যা অথবা ষড়যন্ত্রকে
কত দিয়ে ভাগ
অথবা কি কি দিয়ে গুণ করলে
ফলাফল হবে অমায়িক একটা মুখোশ।
আমি গেলাম বইয়ের বাজারে
তোমার জন্যে বই কিনতে
ও আমার পিয়া।
বইয়ের বাজারে বই নেই।
ঝলমল করছে শাড়ি শায়া ব্লাউজ সেন্ট সাবান
আর কত রকমের চিকন লেস
আর সেই সব অলৌকিক রুমাল
যাদের বশীকরণ মন্ত্রে
খুন-জখমের রক্ত-ছাপ অন্ধকারকেও মনে হয়
পরমাশ্চর্য ঘুম।