- বইয়ের নামঃ আমাদের তুমুল হৈ-হল্লা
- লেখকের নামঃ পূর্ণেন্দু পত্রী
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অনেক বছর পরে
অনেক বছর পরে তোর কাছে এসেছি, মল্লিকা!
বহুদিন আপিসের কাজে-কন্মে ডুবুরির মতো
বহুদি মেশিনের যন্ত্রপাতি হয়ে
বহুদিন বাবুদের গাড়ির টায়ার হয়ে সুদুরে ছিলাম।
তোর পাশে চাঁপা ছিল, টগর, ঝুমকো-জবা ছিল।
তারা কই ? মারা গেছে ? সে কি ? কবে ? সাতাত্তর সালে ?
এত মৃত্যু ঘটে গেল একাত্তর বাহাত্তর তিয়ত্তর সালে
এত হত্যা ঘটে গেল চুয়াত্তর পঁচাত্তর ছিয়াত্তর সালে।
আজ আর ধ্বংস, হত্যা, মৃত্যু কারো হৃদয়ের ভুমিকম্প নয়।
মল্লিকা ! দুঃখের কথা বাদ দিয়ে অন্য কথা বল।
মল্লিকা ! নিজের স্বপ্ন-শরীরের গল্প-টল্প বল।
চাঁদের আলোর নিচে আমাদের আশাতীত খেলাঘর ছিল
সেই বাল্যকাল, সেই হরিণশিশুর কথা বল।
বহুদিন বাবুদের বাগানবাড়ির মালী হয়ে
বহুদিন বৃক্ষহীন দ্বীপান্তরে বেহুঁশ ছিলাম।
মল্লিকা ! বুকের দুধে বহু যত্নে যাকে পুষেছিলি
কই সে কিন্নরকষ্ঠী খঞ্জনীটা ? সে আসে না কেন?
মারা গেছে ? সে কি? কবে ? সাতাত্তর সালে?
এত মৃত্যু ঘটে গেল একাত্তর বাহাত্তর তিয়াত্তর সালে
এত হত্যা ঘটে গেল চুয়াত্তর পঁচাত্তর ছিয়াত্তর সালে।
বৃহৎ আকাশ তবু রাজছত্র ধরে আছে মানুষের মাখার উপর।
অলৌকিক
অলৌকিক এইভাবে ঘটে।
হঠাৎ একদিন ফাঁক হয়ে যায় সাদাসিধে ঝিনুক,
ভিতর থেকে ঠিকরে বেরোয় সাদা জ্যোৎস্না।
সেদিন মুক্তোর মতো গড়িয়ে এলে আমার হাতে।
অমনি বদলে গেল দৃশ্য।
আমার ডান দিকে ছিল মেঘলা দিন
হয়ে গেল ডালিম-ফাটানো রোদ।
আর বাঁদিকে ছিল ইটের পাঁজা
হয়ে গেল লাল টালির ডাকবাংলো।
অলৌকিক এইভাবে ঘটে।
আগুনের খোলা ঝাঁপি
সময় প্রতিমা!
আগুনের ঝাঁপি খুলে দিলাম তোমাকে,
আত্মসমর্পণে আমি সম্মত হলাম।
ক্ষৌরকার ডেকে এনে কাল-পরশু মাথা ন্যড়া হবো
রাজার পোষাক ছিঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেবো গঙ্গাজলে।
গায়ে বড় আঁট হয়ে, বাঁশের গাঁটের মতো খোঁচা হয়ে আছে যে সকল
স্বর্ণ বর্ণ- অলঙ্কার, লকেট, মেডেল
সেই সব মণি-মুক্তো বেনাবনে শুকোবে এখন
দেবদারু গাছগুলি তদোর দুঃখের সব গোপনীয় কথা শুধু আমাকেই বলে
ক্ষুধিত বেড়ালে নখে চিরেছে যে সব ডালপালা
তার সব আর্তনাদ আমার ঘুমের মধ্যে হাতুড়ি পেটায় ঝন্ঝন্ ।
ছলাৎ ছলাৎ শব্দে ঘুম ভেঙে গেলে দেখতে পাই
সমুদ্রের ঢেউগুলি দরজার কাছাকাছি এসেছে কখন,
তখন মেঘের পাখি ভোরবেলার আলতা রং মেখে
শিয়রের কাছে বসে কথা বলে আত্মীয়ের মতো।
নোংরা জল ঢুকে ঢুকে নিঃস্ব হয়ে যাচেছ সব পৃথিবীর খনিগর্ভগুলি
এই রকম অতর্কিত শিরোনাম ফুটে ওঠে জানালায় গায়ের আকাশে।
সময় প্রতিমা!
আকাঙ্খার ঝাঁপি খুলে দিলাম তোমাকে।
আত্মসমর্পনে আমি সম্মত হলাম।
তুমি যদি যুদ্ধে যাও, আমার সমস্ত সৈন্য পাবে।
রেলকলোনীর মাঠে তুমি যদি জনসভা ডাকো
হিম হাওয়া, অন্ধকার, কাঁটাতার, রক্ত-হাসি ঠেলে
প্রত্যেকটি ব্যথিত গাছে আলোর লন্ঠন আমি টাঙাবো একাই
তোমার তুনীর আমি ভরে দেবো, বিজয় উৎসবে।
আমাদের তুমুল হৈ-হল্লা
আমরা যারা চল্লিশের চৌকাঠ পেরিয়ে পঞ্চাশের দিকে
সেদিন আঠারো বছরের উথাল-পাথাল বাউগুলে সেজে
সারারাত তুমুল হৈ-হল্লা।
আগুনের পিন্ডি গিলে গিলে, আগুনের পিন্ডি গিলে গিলে
প্রত্যেকে এক-একজন তালেবর।
‘বুঝেছি, পৃথিবীটাকে উচ্ছন্নে পাঠাবে ছোঁড়াগুলো ।
নিজের মনে গজ গজ জানলা খুলে পালিয়ে গেল হাওয়া।
‘বুঝেছি, একটা কেচ্ছা-কেলেঙ্কারী না ঘটিয়ে এরা ছাড়বে না।
ভয়ে এক ঝটকায় নিভে গেল সমস্ত টিউব লাইট।
আমাদের উড়ো চুলগুলো তখন মনুমেন্ট-মুখো মিছিলের পতাকা
আমাদের শরীরের খাঁজে খাঁজে তখন বিরজু মহারাজের কথক
গলায় আমীর খাঁকে বসিয়ে কোরাস ধরেছি
-জগতে আনন্দ যজ্ঞে
গান থামতেই, যেন রেডিওতে শোকসংবাদ, এমনি গলায়
শান্তি বলে উঠল-
‘জানিস, আর মাত্র কুড়ি বছর পরে খতম হয়ে যাচ্ছে
পৃথিবীর সমস্ত পেট্রোল আর তারপরেই কয়লা-,
অমনি মরা আগুনে ঘি পড়ার মতো দাউ দাউ
আমাদের তুমুল হৈ-হল্লা।
শান্তি থামতেই নীলামদারের মতো হাঁক পাড়ল সুনীল-
‘মেরামতের অযোগ্য এই পৃথিবীটার অন্যে আমি কিনতে চাই
একটা ব্রক্ষাণ্ডজোড়া ডাস্টবিন।
অমনি একশোটা ঘোড়ার চিঁহি চিঁহি ্উল্লাসে
আমাদের তুমুল হৈ-হল্লা।
তার পরই রক্তাক্ত যীশুর ভঙ্গীতে টেবিলের উপর উঠে দাঁড়াল পৃথীশ।
‘বন্ধুগণ!
যে-যার হাফ প্যান্টগুলো কাচিয়ে রাখুন
খোঁড়া তৈমুর আবার জেগে উঠছে কবর ফুঁড়ে
গেরিলা যুদ্ধের সময় দারুণ কাজে লাগবে।
অমনি আমাদের তুমুল হৈ-হল্লা
মিলিটারি ব্যান্ডের মতো ঝমঝমিয়ে।
হিমালয় থেকে গড়াতে গড়াতে
প্রকণ্ড বোল্ডারের মতো জেগে উঠল শক্তি।
‘এবার আমি কিছু বলতে চাই।
গাছ এবং পাথর এমনকি ফুলের ছেঁড়া পাপড়ির সম্বন্ধে
সাংঘাতিক কিছু কথাবার্র্তা জেনে গেছি আমি,
বুড়ো শালিকগুলোর ঘাড়ের রোঁয়া ছিঁড়ে ছিঁড়ে
এখন আকুপাংচারের মতো ঢুকিয়ে দিতে হবে সেগুলো।’
অমনি শান্তির গলা জড়িয়ে আমি
আমার কোমর জড়িয়ে সুনীল
সুনীলের পায়ের তলায় পৃথীশ
পৃথীশের পাকস্থলীতে শক্তি
শক্তির নাইকুণ্ডলীতে সুনীল, সুনীলের জুলফিতে আমি
আমার ঊরু কিংবা ভুরুতে শান্তি
এইভাবে দলা পাকাতে পাকাতে
আমাদের তুমুল হৈ-হল্লার রাতটাকে
নদীনালার দিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে
নক্ষত্রের দিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে
কলকাতার অন্ধকুপের দিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে
কী যে দুর্দান্ত কাণ্ডকারখানা ঘটিয়েছি, কিচ্ছু মনে নেই।