Site icon BnBoi.Com

ঘুমিয়ে পড়ার আগে – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

ঘুমিয়ে পড়ার আগে - নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

অন্ধকারে, একলা মানুষ

ঠাট্টা, হাসি, গান, কলরব
যেই থেমেছে, দূরে কাছে
দেখছি পথের সঙ্গীরা সব
স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ব্যাপার কী, আর গল্প কি নেই?
রাস্তাটা যে অনেক বাকি।
চোখ তুলে কালপুরুষ দেখেই
ফুরিয়ে গেল সব কথা কি?

সত্যি ছিল সঙ্গীরা? ধুস্‌।
মধ্যরাতে পথের ধারে
এই তো আমি একলা মানুষ
দাঁড়িয়ে আছি অন্ধকারে।

গল্পের বিষয়

আমার তিন বন্ধু অমিতাভ, হরদয়াল আর পরমেশের সঙ্গে
আজকাল একটু
ঘনঘনই আমার দেখা হয়ে যাচ্ছে।
কখনও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের বাগানে
কখনও বালিগঞ্জের লেকে,
কখনও বা
উত্তর কলকাতার দেশবন্ধু পার্কের সেই
দেহাতি চা’ওয়ালার দোকানে,
গরম জলে চায়ের বদলে যে রোজ
হোগলা আর শালপাতার সঙ্গে এক-টুকরো
আদাও ফুটিয়ে নেয়।

ভিক্টোরিয়ার বাগানে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের
গল্প হয়।
বালিগঞ্জের লেকের ধারে ছন্নমতি
বালক-বালিকাদের কাণ্ডকারখানা দেখতে-দেখতে আমাদের গল্প হয়।
দেশবন্ধু পার্কের ঘাসের উপরে উবু হয়ে বসে
ভাঁড়ের চা খেতে-খেতে আমাদের
গল্প হয়।
তবে যে-সব বিষয়বস্তু নিয়ে আমাদের গল্প হয়,
তার তাৎপর্য এখনকার মানুষরা ঠিক
বুঝবে না।

আমাদের গল্প হয়
মধ্য-কলকাতার সেই গলিটাকে নিয়ে,
গ্যাসের বাতির সবুজ আলোর মধ্যে
সাঁতার কাটতে-কাটতে
রাত বারোটায় যে হরেক রকম স্বপ্ন দেখত।
আমাদের গল্প হয়
এই শহরের অঘ্রাণের সেই ঘোলাটে আকাশটাকে নিয়ে,
শীলেদের বাড়ির মেঝো-তরফের বড় ছেলের
বিয়ের রাত্তিরে
চিনে কারিগর ডাকিয়ে যাবে
মস্ত-মস্ত আলোর নেকলেস পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

আমাদের গল্প হয়
কাঞ্চন থিয়েটারের প্রম্‌টারের সেই মেয়েটিকে নিয়েও,
আমরা প্রত্যেকেই যাকে একদিন
একটি করে গোড়ের মালা উপহার দিয়েছিলুম।

শেষের এই গল্পটা চলবার সময়ে আমরা
কেউই যে কিছুমাত্র
ঈর্ষার জ্বালায় জলিনা, বরং চারজনেই চার
উজবুকের মতো
হ্যা হ্যা করে হাসতে থাকি,
তার কারণ আর কিছুই নয়, আমরা প্রত্যেকেই খুব
বুড়িয়ে গেছে।

ঘরে চন্দ্রমা

বুঝতে পারিনি আমি তার কথা
সে তবু রয়েছে দাঁড়িয়ে।
যেন-বা মূর্ত্তিময়ী সরলতা
চেনা ঘরবাড়ি ছাড়িয়ে
স্বপ্নে অন্য জগতে দিয়েছে পাড়ি,
যেখানে ভিন্ন রকমের ঘরবাড়ি,
ভিন্ন বর্ণ-গন্ধের কাড়াকাড়ি
দেয় মানবিক নানা বৃত্তি ও
নানা বিশ্বাস নাড়িয়ে,
যেখানে চল্‌তি অর্থগুলিও
অনর্থে যায় হারিয়ে।
চিত্রার্পিত ভঙ্গিটি তার,
সে আছে দাঁড়িয়ে দরজায়,
যেন ছোঁয়া লাগে চিরায়মানার
অচির জীবনচর্যায়।
এত যে বয়স, তবু এই সংসারে
যা আমাকে আজও হাড়ে-মজ্জায় মারে,
কে তাকে ডোবাল জ্যোৎস্নার পারাবারে।
শেষের পরিচ্ছেদে আরবার
শুরু হল কোন্‌ পর্যায়।
ঘরে চন্দ্রমা, বাহিরে আঁধার
আক্রোশে ওই গর্জায়।

জ্যোৎস্নারাতে

আমি বললুম, সুন্দর।
এই আশ্বিন মাসে
রহস্য তার লেগেছে অপার
বিমুক্ত নীলাকাশে।
আমি বললুম, এসো।
সে তবু আসে না কাছে।
মায়া দিয়ে গড়া
জ্যোৎস্না অধরা
দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে।

আমি ভাবি, এ কি বিভ্রম?
দাঁতে ঠোঁট চেপে হেসে
তখুনি সে ঘরে
ধুলোর উপরে
ঝাঁপিয়ে পড়ল এসে।

Exit mobile version