জয় কালী
পঁয়তাল্লিশ বছর বাদে দেখা, তবু কারও
ভুলভাল হল না।
এসপ্ল্যানেডে বর্ষার সন্ধ্যায়
এক-নজরে দুজনেই দুজনকে চিনলুম। পক্ককেশ
পৌঢ় পরক্ষণে
বালকের মতো হাসল, প্রশ্ন করল, “কী রে,
আজকাল কোত্থেকে ঘুড়ি কিনিস? আবদুল
মৌলালির মোড়ে
এখনও লাটাই ঘুড়ি টানা-মাঞ্জা বিক্রি করে নাকি?”
শুনে আমি হতভম্ব হয়ে চেয়ে থাকি
ইস্কুকের বন্ধু কালীপদ
মল্লিকের দিকে। আমি তিন বছর বাদে
চাকরি থেকে অবসর নেব, কিন্তু দু-দুটো মেয়ের
একটাও পাত্রস্থ হয়নি, বাড়ির বাবদে
ঘাড়ে দেনা, পেটে অম্লশূল,
সাংসারিক দায়-দায়িত্ব বাড়ছে শুধু, কমছে না একটাও,
উপরন্তু গিন্নির হাঁপানি।…আমি আর
একাদশবর্ষীয় বালক নই, তবু কেন হতচ্ছাড়া কেলো
ঘুড়ি ওরাবার কথা বলে?
ডাইনে বাঁয়ে নেভে আর জ্বলে
বিজ্ঞাপনী বর্ণমালা। সম্ভবত সাঁওতালডিহির
প্রথম, দ্বিতীয় কিংবা প্ল্যাণ্টের
উৎপাদনে আজকে কোনো বিভ্রাট ঘটেনি।
আকাশে পুজোর গন্ধ, গঙ্গ থেকে ছুটে আসে হাওয়া
এইরকম সন্ধ্যালগ্নে ভিক্ষারিও স্বপ্ন দেখে, আর
যেন জাদুদণ্ডের ছোঁয়ায়
পালটে যায় কলকাতার মুখচ্ছবি।
চৌরঙ্গির মোড়া মেট্রো-রেলের দেওয়ালে
প্যাণ্টের বোতাম খুলে যারা ভারমুক্ত হচ্ছে, তাদেরও এখন
বালকের মতো
সুখী ও নিশ্চিন্ত বলে মনে হয়।
তাই বলে সময়
বসে থাকে নাকি? কালী, হয় তুই উন্মাদ কিংবা গাধা।
এই কথাটা বলতে গিয়ে পরক্ষণে ভাবি,
পাগল কি নির্বোধ নয়, যেখানে একদিন
ছেড়েছিল, কালী হয়তো হার-না-মানা গোঁয়ারের মতো
মধ্যবর্তী বছরগুলিকে
অস্বীকার করতে চাইছে, আর
একদম সেইখান থেকে ধরতে চাইছে পুরনো বন্ধুকে।
ধরা যায় না, কে না জানে, ইঁদারায় ঝুঁকে
কোনো-কিছু ধরতে গেলে খালি
বেদনাই বাড়ে।
তবুও অস্ফুট কণ্ঠে বলি তাকে, “জয় কালী, জয় কালী!”
ঠাকুমা বলতেন
ঠাকুমা বলতেন, “দাদা, খুব বেশি তো আর
বাঁচব না, এখন তাই সাধ্যমতো আল্গা দিয়ে থাকি।
যে অল্প সময় আছে বাকি,
দেখতে-দেখতে কেটে যাবে, তোমরা থাকো ভাল।
আমি দেখি কী করে আমার
আঁচলের গিঁটগুলোকে ধীরেসুস্থে খুলে ফেলা যায়।”
(যখনই বলতেন, বড় নম্র একটা আলো
ভেসে উঠত শান্ত দুটি অনচ্ছ চক্ষুর জানালায়।)
দিদি তো তক্ষুনি রেগে টং
বলত, “তুমি যাবে কোথা? দিচ্ছে বা কে যেতে?
আমরা চাইছি গল্প শুনতে, আমরা চাইছি খেতে।
নাড়ু, বড়ি, আম-কাসুন্দি খেয়ে দিব্যি আছি,
বুঝলে তো ঠাকুমা? তুমি বাজে কথা বাদ দিয়ে বরং
গল্প বলো, কিংবা সেই বিখ্যাত লাউয়ের-ঘণ্ট রাঁধো
মুগডাল ছড়িয়ে, আমরা চাট্টি খেয়ে বাঁচি।
মোট কথা গিঁটগুলি তুমি শক্ত করে বাঁধো।”
ঠাকুমা বলতেন, “দিদি, যে-লোকটা সব-কিছু ছেড়ে একা
চলে গেছে, তার কথা যে বড্ড মনে পড়ে।
সে-ও তো বলত, কলকাতা-শহরে
চিত্তসুন্দরীর থেকে সুন্দরী যদি-বা থাকে, তার
অর্ধেক সুন্দর রান্না কোত্থাও পাবে না।…যার দেখা
স্বপ্নে রোজ পাচ্ছি, দিদি, তাকে ছেড়ে আর কি থাকা যায়?”
(বলতে-বলতে হাসি ফুটে উঠত ঠাকুমার
মুখে, আলো ভাসত দুটি অনচ্ছ চক্ষুর জানালায়।)