প্লেটোর আপত্তিকে, বলাই বাহুল্য, সেদিক থেকে বিচার করেননি। আরিস্টটল। কিন্তু নানাবিধ শিল্পকর্মের প্রেরণা ও শ্রেণিবিভাজন(৮) সম্পর্কে সাধারণভাবে নানা কথা বলে নিয়ে অতঃপর বিশেষভাবে কবিতা সম্পর্কে তিনি যেভাবে ছড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর যুক্তিজাল, যেভাবে ইঙ্গিত করেছেন এই শিল্পের ধ্রুব ভূমিকার দিকে, ভবিষ্যৎকালের সাহিত্যচিন্তাকে যে তা কতটা প্রভাবিত করেছিল, আরিস্টটলের মৃত্যুর বহু শতাব্দী পরে- খ্রিষ্টীয় ষোড়শ ও উনবিংশ শতাব্দীতে- রচিত কবিতা-বিষয়ক দুটি অতিবিখ্যাত নিবন্ধ তা আমাদের জানিয়ে দেয়। সেখানে, সেই নিবন্ধদুটির উপরে, আরিস্টটলীয় কাব্যভাবনার ছায়াকে আমরা বারে-বারে সঞ্চারিত হতে দেখি। বলা বাহুল্য, আমরা সিডনির অ্যান অ্যাপোলজি ফর পোয়ন্ট্রি এবং শেলির এ ডিফেনস অব পোয়ট্রি র কথা বলছি, পরে যাকে আমরা সংক্ষেপে শুধুই অ্যাপোলজি’ ও ‘ডিফেনস” বলে উল্লেখ করব।
লক্ষণীয় ব্যাপার এই যে, কবিতাকে প্লেটো যে-ক্ষেত্রে দর্শনের বিরোধী-শক্তি হিসেবে দেখেছিলেন (অন্তত দেখেছিলেন বলেই আমরা অনুমান করে থাকি), ‘অ্যাপোলজি’ অথবা “ডিফেনস”— কোনওটিরই লেখক সে-ক্ষেত্রে দর্শন ও কবিতার এই পারস্পরিক বিরোধের ব্যাপারটাকে মানতে চান না। অ্যাপোলজির লেখক, তার নিবন্ধের সূচনাতেই, প্রাচীনকালের এমন অনেক দার্শনিক ও চিন্তানায়কের কথা আমাদের জানিয়ে দেন, যারা-অন্তত প্ৰথক দিকে-কবিতার মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে তুলে ধরতেন তাদের চিন্তালব্ধ শস্যসম্ভােরকে, এবং সেই কারণে, সমকালীন জনসাধারণ যাঁদের, মূলত, কবি বলেই জানত।(৯) অর্থাৎ, যেটা তাদের বলবার কথা, সেটাকে তাঁরা কবিতার পোশাক পরিয়ে বলতেন বটে, কিন্তু আসলে তারা ছিলেন ছদ্মবেশী দার্শনিক। ‘অ্যাপোলজির লেখকের এই বক্তব্য যে কবিতা ও দর্শনের মধ্যবর্তী পাচিলেটাকে বেশ জোরালো রকমের একটা ধাক্কা মারে, তাতে সন্দেহ নেই। সে-ক্ষেত্রে, “ডিফেনাস’-এর লেখক সেই পাঁচিলটাকে একেবারে গুড়িয়ে দেবার জন্য বললেন যে, কবিতার প্রতি যাঁর ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা’র কথা আমরা শুনে আসছি, সেই প্লেটোও আসলে একজন ছদ্মবেশী কবিই। বলা বাহুল্য, কবিতা ও গদ্যের কোনও কৃত্রিম বিভাজনকে শেলি কখনও মেনে নেননি। কবিতাকে শনাক্ত করতে গিয়ে তার শারীরিক গঠনবিন্যাসের উপরে চোখ রাখতেন না। তিনি, গুরুত্ব আরোপ করতেন। আমাদের ভাবনার যেটা ব্যক্ত রূপ, তার অন্যবিধ লক্ষণের উপরে। প্লেটোর রচনায় সেই লক্ষণগুলিকে যখন তিনি দেখতে পেলেন, তখন প্লেটো যে বস্তৃত কবি, এই সিদ্ধান্তে পৌছোতে তাঁর বিন্দুমাত্র কুষ্ঠা হল না।(১০)
দার্শনিকেরা কিংবা ঐতিহাসিকেরা যে কেন কবিতার মাধ্যমে তাদের তত্ত্বকথা অথবা ইতিবৃত্ত প্রচার করতেন, ‘অ্যাপোলজির লেখকের কাছে তা-ও আমরা শুনেছি। তিনি আমাদের জানিয়েছেন যে, অন্য মাধ্যমের প্রতি সাধারণ মানুষের ততটা আগ্রহ ছিল না, যতটা ছিল কবিতার প্রতি। ফলত, সাধারণ মানুষদের কাছে কোনও বক্তব্যকে পৌঁছে দিতে হলে কবিতার মাধ্যমেই সে-কাজ করতে হত, তা ছাড়া উপায়ান্তর ছিল না। (কবিতার মাধ্যমকে স্যার ফিলিপ সিডনি আসলে ‘a great passport” বা মস্ত একটি ছাড়পত্র’ আখ্যা দিয়েছেন, যা থাকলে তবেই জনচিত্তে প্ৰবেশ করা যায়।) অতঃপর তিনি আরও খানিকটা এগিয়ে যান, এবং বলেন যে, দার্শনিকের চেয়ে কবির ভূমিকা আরও বড়ো, এবং তঁর ক্ষেত্রও আরও ব্যাপক। দার্শনিকের কথা তো শুধু মুষ্টিমেয় কিছু শিক্ষিত লোকে বোঝে, অর্থাৎ যারা ইতিপূর্বেই শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়েছে, তিনি তাদের শিক্ষক। আর কবির কথা সেই তুলনায় অনেক সহজপাচ্য (তীর গ্রাহ্যতার ভূমিও তাই অনেক বড়ো), এবং সেদিক থেকে বিচার করলে বলতেই হয় যে, কবিই হচ্ছেন জনগণের প্রকৃত দার্শনিক।।(১১)
আর অনূতভাষিতা? ঠাট্টা করে সিডনি বলছেন, পৃথিবী থেকে নানা গ্ৰহতারার দূরত্ব যাঁরা মেপে দেখান, সেই জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মিথ্যের বহরটা কি আরও বড় নয়? কিংবা চিকিৎসকদের? কবিরা বরং সবচেয়ে কম মিথ্যাবাদী। মিথুক কারা? না যেটা সত্য নয়, সেটাকে যারা সত্য বলে জোরগলায় জাহির করে, তারাই হচ্ছে মিথুক। কিন্তু কবিরা (দ্বিধায়, কুষ্ঠায়, সন্দেহে, সংশয়ে সারাক্ষণ যাঁরা পীড়িত, এবং ‘যেন” ও “হয়তো’র রাজ্যে যাঁরা ঘুরে বেড়ান) তো তেমন জোরগলায় কিছুই জাহির করেন না। মিথ্যেটাকে সত্যি বলে ‘অ্যাফাৰ্ম” করবার কোনও প্রশ্নই এক্ষেত্রে উঠতে পারে না, কেননা, সিডনি বলছেন, “অ্যাফাৰ্ম” করাটাই তাদের ধাতে নেই। (“…the poet never affirmeth.”)
অনূতভাষিতার যে অভিযোগ, তার উত্তর অবশ্য অন্যভাবেও দেওয়া যায়। বলা যায় যে, যাকে আমরা অসত্য’ ভাবি, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা অতিশয়োক্তি মাত্র। এই যে অতিশায়োক্তি বা বাড়িয়ে বলা, যদি কেউ জিজ্ঞেস করেন যে, এর প্ররোচনা কোত্থেকে আসে, তো উত্তরে আমরা শিল্পীর আবেগোচ্ছ্বাসের সঙ্গে একে যুক্ত করে দেখাতে পারি। বিজ্ঞানে কি ন্যায়শাস্ত্ৰে অতিশয়োক্তির কোনও অবকাশ নেই। তার কারণ, আবেগোচ্ছাসেরও কোনও ভূমিকা নেই সেখানে। সেখানে যা-কিছু দাঁড়ায়, তা শুধু তথ্যভিত্তিক নিপট যুক্তির উপরে দাঁড়ায়। অন্যদিকে, ইংরেজিতে যাকে
একেবারে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। আর তাই, কিছু-না-কিছু অতিশয়োক্তি বা অতিরঞ্জন সেখানে ঘটেই। আমরা যখন রবীন্দ্রনাথকে বলতে শুনি: