তা-ই যদি হয়, তাহলে আমরা কবিতা পড়বা কেন? মূল সত্তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে কেন আমাদের আগ্রহকে সংহত করব সেই রচনার উপরে যা আসলে ছায়ার ছায়ামাত্ৰ? প্লেটো বলছেন, সত্যিই তা করা উচিত নয়। বলছেন, শুধু হোমার কেন, সত্য সম্পর্কে কোনও কবিরই কোনও যথার্থ জ্ঞান নেই। সুতরাং কবিতার উপরে আমাদের আগ্রহকে তো আমরা সংহত করবই না, বরং মানবজীবনে কাব্যের প্রভাব যে কত অনিষ্টকর, অন্যদেরও তা জানিয়ে দেব।
বলা বাহুল্য, অন্যদের জানিয়ে দেবার ব্যাপারে প্লেটোর উদ্যোগে কোনও ত্রুটি ছিল না। কিন্তু তার চেতাবনি সত্ত্বেও যে কবিতা রচনা ও পাঠের আগ্রহ এতাবৎকাল অব্যাহত থেকেছে, তা আমরা জানি। জানি যে, প্লেটো তার কল্প রাজ্য থেকে কবিতাকে নির্বাসন দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু আমাদের কল্পনাকে দীপিত করবার ব্যাপারে তার ভূমিকার কোনও অবসান। তবু ঘটেনি, মানুষের চিত্তভূমিতে তার আসন চিরকাল অটুটই ছিল। উপরন্তু আমরা এ-ও জানি যে, কবিতার প্রতি প্লেটো নিজেও কিছু কম আসন্তু ছিলেন না। বস্তৃত, রিপাবলিক-এর ওই দশম গ্রন্থেই হোমারের প্রতি তাঁর আশৈশব অনুরাগ ও শ্রদ্ধার কথাটা তিনি অকপট ব্যক্তি করেছেন।
প্লেটো তাহলে আর কবিতার বিরুদ্ধে আপত্তি তোলেন কেন? উত্তরটা আমরা প্লেটোর মুখেই শুনেছি। তিনি সত্যসন্ধ দার্শনিক; তীর দৃষ্টি সর্বোপরি সত্যের দিকে নিবন্ধ। এবং কবিতা যেহেতু সত্যের দিক থেকে আমাদের দৃষ্টিকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়, তাই—হোমারের রচনার প্রতি ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা-ভালোবাসা সত্ত্বেও—এই শিল্পকে তঁর আদর্শ রাষ্ট্রে তিনি সস্থান দিতে পারেন না। আমরা ধরেই নিতে পারি যে, আবেগনির্ভর কবিতাকে তিনি যুক্তিনির্ভর দর্শনের বিরোধী একটি শক্তি হিসেবে দেখেছিলেন। কবিতা সম্পর্কের্তার অন্যবিধ আপত্তি, বলা বাহুল্য, এই মৌল আপত্তির সূত্র ধরেই এসেছে।
কিন্তু কবিতা কি সত্যিই সত্যের দিক থেকে আমাদের দৃষ্টিকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেয়? নাকি সে তার নিজস্ব পথে পৌছোতে চায় দ্বিতীয় কোনও সত্যের ক্ষেত্রে, যাকে আমরা শিল্পের নিজস্ব সত্য বলে গণ্য করতে পারি? এই যে প্রশ্ন, এর উত্তর খুঁজে নেবার প্রয়াসে আমরা প্লেটোর শিষ্য আরিস্টটলের কাছ থেকে সাহায্য পাব, র্যার কাব্য-বিষয়ক প্রস্তাবকে অনেকে- আমরা আগেই বলেছি- কবিতার প্রতি প্লেটোর উগ্র উম্মার উত্তর বলে গণ্য করে থাকেন।
যেমন অন্যবিধ শিল্পকে, তেমনই কাব্যকেও আরিস্টটল যে অনুকরণ বলে মনে করতেন, কিন্তু অনুকরণের অনুকরণ নয়, তার কারণ, বস্তুজগৎ তার কাছে নিতান্ত ছায়ামাত্র ছিল না, তাকে তিনি সত্য বলে মানতেন। ফলত, বস্তুজগৎকে যা অনুকরণ করে দেখায়, সেই কাব্যকে তিনি কখনও সত্য থেকে তৃতীয় ধাপের দূরত্বে অবস্থিত ব্যাপার বলে মনে করেননি। কাব্যবিচারে গুরুশিষ্যের মতামতে আর-একটি পার্থক্যও আমরা লক্ষ না করে পারি না। আমাদের চিত্তের উপরে কাব্যের ক্লিয়া সম্পর্কে গুরু ও শিষ্য দুজনেই অবহিত ছিলেন; কিন্তু, তার গুরুর মতো, আরিস্টটল কখনও এমন সিদ্ধান্ত করেননি যে, কাব্যের কাজ হচ্ছে নেহাতই আমাদের দুর্বল প্রবৃত্তিগুলিকে উসকে দেওয়া। বরং তঁর কাব্য-বিষয়ক প্রস্তাবে তিনি খুব স্পষ্ট করেই বলছেন যে, কাব্যের আবেদন আমাদের চিত্তের গভীরে গিয়ে সাড়া জাগায়। শুধু তা-ই নয়, কাব্য যে দর্শনবিরহিত ব্যাপার, এমন কথাও তিনি মানলেন না। ইতিহাস ও কাব্যের তুলনাপ্রসঙ্গে বরং জানালেন যে, ইতিহাসের চেয়ে কাব্য আরও দার্শনিক ও তার তাৎপর্য আরও দূরপ্রসারী, কারণ, কাব্য যে-ক্ষেত্রে সর্বজনীন সত্যের কথা বলে, ইতিহাস সে-ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ব্যক্তি সম্পর্কে নির্দিষ্ট কথা শোনায় মাত্ৰ।(৬)
কাব্যের বিরুদ্ধে অনৈতিকতার যে অভিযোগ তোলা হয়েছিল, তাকে আমল দেননি। আরিস্টটল। বলেছেন, কোনও উক্তি অথবা আচরণকে বিচ্ছিন্নভাবে বিবেচনা কবুলে এক্ষেত্রে চলবে না; দেখতে হবে, কথাটা কে বলছে অথবা কাজটা কার। সেইসঙ্গে দেখতে হবে যে, সেই উক্তি অথবা আচরণের উদ্দিষ্ট ব্যক্তিটিই-বা কে|..উক্তি অথবা আচরণের উদ্দেশ্য অথবা অভিপ্ৰায় কী, সেটাও হিসেবের মধ্যে ধরা চাই। ভেবে দেখতে হবে যে, বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য, অথবা বৃহত্তর অমঙ্গলকে এড়াবার জন্য, কথাটা বলা হচ্ছে কি না অথবা কাজটা করা হচ্ছে কি না।(৭)
এই যে কোনও উক্তি অথবা আচরণকে বিচ্ছিন্ন করে না-দেখে, উদ্দেশ্য তাৎপর্য ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত করে দেখা, সাহিত্যবিচারে এই পদ্ধতির মূল্য যে কতটা, তা আমরা জানি। কিন্তু শুধু এই পদ্ধতির নির্দেশ দিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছেন না। আরিস্টটল, এই সঙ্গে তিনি আরও একটা কথা আমাদের জানিয়ে দিচ্ছেন, কাব্যবিচারের ব্যাপারে যা কিনা আরও জরুরি। ইতিপূর্বে তিনি আমাদের বলেছেন যে, কাব্য কীভাবে নির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ সত্যকে অতিক্ৰম করে সর্বজনীন সত্যের ক্ষেত্রে পৌঁছে যায়। এবারে তারই সূত্র ধরে তিনি আরও খানিকটা এগিয়ে এলেন। কোনটা ভুল আর কোনটা নির্ভুল, তার বিচারের প্রসঙ্গে এসে বললেন, কাব্যশিল্প ও অন্যবিধ সামাজিক ক্রিয়াকর্মের পদ্ধতি এক নয়, সুতরাং তাদের (বিচার করবার) মানদণ্ডও হবে আলাদা।
কবিতা কেন, এই প্রশ্নের উত্তরে প্লেটোর কাছে আমরা শুনেছিলুম যে, কবিতা কেন নয়। এবারে আরিস্টটলের কাছে পালটা উত্তর শোনা গেল। শিল্পকর্ম সম্পর্কে প্লেটোর অভিমতকে অবশ্য অন্যভাবেও খণ্ডন করা যায়। তাঁর কাছে আমরা তিন রকমের টেবিলের কথা শুনেছি। ঈশ্বরের টেবিল (অর্থাৎ টেবিলের মূল সত্তা), ছুতোর-মিস্ত্রির টেবিল ও চিত্রকারের টেবিল। আরও শুনেছি যে, ছুতোরমিস্ত্রির টেবিল ও চিত্রকারের টেবিলকে মৌলিক সৃষ্টি বলে গণ্য করা যায় না। কেন না, টেবিলের মূল সত্তা থেকে তারা যথাক্ৰমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের দূরত্বে অবস্থান করছে। দ্বিতীয়টি মূল সত্তার অনুকরণ ও তৃতীয়টি মূল সত্তার অনুকরণের অনুকরণ। এই যে তিন রকমের টেবিল, এদের মধ্যে প্রথমটিকে অর্থাৎ টেবিলের মূল সত্তা বা ঈশ্বরের টেবিলকেই প্লেটো সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে বলা যায় যে, তিনটি টেবিলের উপযোগিতাও তিন রকমের। ঈশ্বরের টেবিল বা টেবিল-সংক্ৰান্ত বিশুদ্ধ ধারণা ব্যতিরেকে সূত্রধরের টেবিল নির্মিত হতে পারত না, এ-কথা স্বীকার করে নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায় যে, সেই বিশুদ্ধ ধারণার উপরে কি আমরা ভাতের থালা রাখতে পারি? তা আমরা পারি না। তার জন্য সূত্রধরের টেবিলই আমাদের চাই। আবার সূত্রধরের টেবিল আমাদের নান্দনিক ক্ষুধা মেটায় না। সেই ক্ষুধার নিবৃত্তির জন্য চাই চিত্রকরের আঁকা টেবিল। অর্থাৎ প্লেটো যাদের “অনুকরণ’ ও “অনুকরণের অনুকরণ’ বলছেন, উপযোগিতার বিচারে গুরুত্ব তাদেরও কিছু কম নয়।