কিন্তু সেইসব কর্মকাণ্ডের কোনওটার সঙ্গেই কবিতার ঠিক তেমন কোনও যোগসূত্র আমরা খুঁজে পাই না। রাতারাতি জলাভূমি ভরাট হয়ে যাচ্ছে, ধাপে-ধাপে লাফিয়ে উঠছে অভ্রংলিহ অট্টালিকা, বিশাল বনস্পতিকে লাথি মেরে মাটিতে শুইয়ে দিচ্ছে বুলডোজার, কারখানার চিমনি গিয়ে মেঘের বালিশে মাথা রাখছে, নদীর গর্ভ থেকে উঠে আসছে মস্ত-মস্ত পিলার, তার উপরে ঢালাই হয়ে যাচ্ছে কংক্রিটের সড়ক, চায়ের পেটি কিংবা আলুর বস্তা ঘাড়ে নিয়ে হাইওয়ে কাঁপিয়ে ট্রাক ছুটছে, জাহাজের উদর থেকে নিষ্কান্ত হচ্ছে গম, তেল, যন্ত্রপাতি কিংবা নিউজপ্রিন্ট, মাটির তলায় পাতা হচ্ছে রেলের লাইন, রানওয়ে থেকে উধৰ্বশ্বাসে উধর্বকাশে উঠে যাচ্ছে এরোপ্লেন,—এই যে এত-সব বৃহৎ ঘটনা, এর প্রত্যেকটিকে নিয়েই কবিতা লেখা যায় বটে, কিন্তু কবিতাকে এর একটিরও হেতু হিসেবে নির্দেশ করা চলে না। অর্থাৎ, এক কথায়, এসব কাজের কোনওটার সঙ্গেই কবিতার কোনও কার্যকারণের সম্পর্ক নেই। এমনকি, নিতান্ত জীবিকার্জনের জন্য নূ্যনতম যেটুকু উদ্যোগ আমাদের না থাকলেই নয়, তার সঙ্গেও না। উনুনে হাঁড়ি চাপিয়ে কেউ কখনও কবিতা লিখতে বসেনি।
জীবিকার্জনের উদ্যোগের সঙ্গে কবিতার এই যে সম্পর্কহীনতা, রবীন্দ্ৰবৰ্ণিত কবি-গৃহিণী একেবারে সরাসরি এর দিকে আঙুল তুলেছেন। ভদ্রমহিলার উক্তি খুবই স্পষ্ট। স্বামীর উদেশে তিনি যখন বলেন :
গাঁথিছ ছন্দ দীর্ঘ হ্রস্ব–
মাথা ও মুণ্ড, ছাই ও ভস্ম;
মিলিবে কি তাহে হস্তী অশ্ব,
না মিলে শস্যকণা।(১)
তখন আমরাও তাঁর সঙ্গে একমত হই। আমরা বুঝতে পারি যে, এই গঞ্জনা একটা মস্ত বড়ো অভিমান থেকে উঠে আসছে বটে, কিন্তু তাঁর কথাটা তাই বলে মিথ্যে নয়।
প্লেটো অবশ্য অন্য দিক থেকে তার আক্ৰমণ চালিয়েছিলেন। রিপাবলিক’-এর দশম গ্রন্থে কবিতার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তুলেছিলেন তিনি, তার সংক্ষিপ্তসার হচ্ছে এই যে, ক) এমন-সমস্ত বস্তুকে সে অনুকরণ করে দেখায়, যারা নিজেরাই অনুকরণ বা প্রতিচ্ছবিমাত্র; উপরন্তু খ) আমাদের হীন ও দুর্বল প্রবৃত্তিগুলিকে সে উসকে দেয়, এবং বশবর্তী হতে শেখায় এমন-সমস্ত আবেগ-বাসনার, যেগুলিকে দমন করা দরকার।(২)
এই ধরনের আপত্তি যে এ-দেশে কখনও ওঠেনি, তা-ও নয়। রাজশেখর তার কাব্যমীমাংসায় যেসব আপত্তির উল্লেখ করেছেন, তা হল এই যে, ক) কাব্যে মিথ্যা বিষয়ের বর্ণনা থাকে, খ) অসৎ বা গ্ৰাম্য বিষয়ে উপদেশ থাকে, এবং গ) অশ্লীল বিষয়ের বর্ণনা থাকে।(৩) (সুতরাং তার অধ্যয়ন বা আলোচনা অনুচিত) রাজশেখর অবশ্য এসব আপত্তি গ্রাহ্য করেননি। কিন্তু সে-কথা আবার পরে আসবে। আপাতত প্লেটোর প্রসঙ্গে ফিরে যাই।
কবিতাকে প্লেটো যে কেন ছায়ার অনুকৃতি’ বা “অনুকরণের অনুকরণ” বলে গণ্য করেন, তা আমরা জানি। বস্তৃত, শুধু কবিতা কেন, যাবতীয় শিল্পকর্মই তাঁর কাছে “অনুকরণের অনুকরণমাত্র, তার বেশি মর্যাদা তিনি তাদের দেন না। কেন দেন না, রিপাবলিক-এ নানা দৃষ্টান্ত দিয়ে তিনি তা ব্যাখ্যা করেছেন। তার মোদ্দা কথাটা এই যে, জাগতিক যেসব বস্তু আমাদের চতুর্দিকে আমরা দেখতে পাই, তাদের প্রত্যেকটিরই পিছনে রয়েছে সেই বস্তু সম্পর্কিত ধারণা, এবং সেই ধারণাই হচ্ছে মূল সত্তা, বস্তু যার অনুকরণমাত্র। সেদিক থেকে দেখতে গেলে, ছুতোর-মিস্ত্রি যে-টেবিল বানাচ্ছেন, সেই টেবিলও আসলে টেবিল-সংক্ৰান্ত ধারণা বা টেবিলের মূল সত্তার অনুকরণ ছাড়া আর কিছুই নয়। ফলত, কোনও শিল্পী যখন সেই টেবিলটিকে একে দেখান, তখন সেটা অনুকরণের অনুকরণ হয়ে দাঁড়ায়। প্লেটো বলছেন, বস্তৃত মূল সত্তার স্রষ্টা হচ্ছেন ঈশ্বর, এবং ঈশ্বর যদি স্বয়ং একটা টেবিল বানাতেন, তা হলে তাঁর বানানো সেই টেবিল একটি মৌলিক সৃষ্টি বলে গণ্য হতে পারত। কিন্তু, যেজন্যেই হোক, তা তিনি বানাননি। টেবিল বানিয়েছেন সূত্রধর, এবং শিল্পী সেই টেবিলের ছবি এঁকেছেন। শিল্পীর টেবিল অতএব টেবিলের মূল সত্তা থেকে তৃতীয় ধাপের দূরত্ব রয়েছে।(৪)
ঠিক ততটাই দূরে রয়েছে কবিতাও। যেমন শিল্পীর ছবি, তেমন হোমারের কাব্যও অনুকরণের অনুকরণ, অর্থাৎ মূল সত্তা থেকে অনেক দূরবর্তী ব্যাপার। প্লেটো অন্তত এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছেছেন। তার যুক্তি : কবিদের দৃষ্টি মূল সত্যের প্রতি নিবন্ধ নয়, তারা তার প্রতিরূপ বা প্রতিচ্ছবিটিকেই শুধু দেখেন। এমনকি, সেই প্রতিচ্ছবিটিরও নির্মাতা তারা নন। তাঁরা শুধু সেই প্রতিচ্ছবির প্রতিচ্ছবি রচনা করেন। তারা না-যোদ্ধা, না-জনসেবী, না-চিকিৎসক, না-পণ্ডিত। হোমারের কাব্যে যেসব বৃহৎ কর্মের বর্ণনা আমরা পাই, তিনি নিজে তার নায়ক নন। রিপাবলিক-এ প্রশ্ন তোলা হয়েছে, হোমারের কালের এমন কোনও যুদ্ধের কথা কি কেউ জানে, যে-যুদ্ধের সাফল্য তাঁর নেতৃত্বে অথবা পরামর্শে অর্জিত হয়েছিল? মানুষের উপকার হয়, এমন কোনও বাস্তব কৌশলের কি তিনি উদ্ভাবক? কিংবা এমন কোনও শিক্ষাকেন্দ্র কি তাঁর দ্বারা স্থাপিত হয়েছিল, শিক্ষার্থীরা তাঁর উপদেশ শ্রবণের জন্য যেখানে সমবেত হত? এসব প্রশ্নের প্রত্যেকটিরই উত্তর হচ্ছে না”। অর্থাৎ, অন্যে পরে কী কথা, হোমারের মতো মহাকবিও নিজে কিছু ঘটান না, অথবা নিজে কিছু করেন না। অন্যের দ্বারা আয়োজিত ঘটনার অথবা অন্যের কৃতকর্মের বর্ণনা দেন মাত্র।(৫)