কিন্তু ওই শব্দ-বৃপের ভিতর দিয়েই যে শব্দীতীতের আভাস পেয়ে যাই আমরা, তা-ই-বা কী করে অস্বীকার করি? বস্তৃত, গদ্যের সঙ্গে কবিতার এখানেই মস্ত পার্থক্য। গদ্যও এক ধরনের শব্দ-বুপাই, আমাদের ভাবনাকে সে-ও মূর্তি দেয়, কিন্তু শব্দ সেখানে তার তাৎক্ষণিক বা আভিধানিক অর্থের বেশি-কিছু আমাদের বলে না। কবিতার শব্দ সে-ক্ষেত্রে তার তাৎক্ষণিক অর্থকে ছাড়িয়ে যেতে চায়, ছাড়িয়ে প্রায়শ যায়ও, ইঙ্গিত করতে থাকে অন্যতর কোনও অর্থ কিংবা তাৎপর্যের দিকে।
এই যে তাৎক্ষণিক অর্থকে ছাড়িয়ে যাওয়া, একেই আমরা বলি ব্যঞ্জনা, আর এই ব্যঞ্জনকেই আমরা কাব্যের একটি ধ্রুব অভিজ্ঞান বলে গণ্য করতে পারি।
প্রশ্ন উঠবে, শব্দ কীভাবে তার তাৎক্ষণিক অর্থকে ছাড়িয়ে যায়। উত্তরে আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বলতে পারি যে, তার একক শক্তিতে সেটা সম্ভব হয় না। প্রতিটি শব্দেরই একটি সুনির্দিষ্ট অর্থ রয়েছে, এবং, বাক্যের ভিতর থেকে সরিয়ে এনে, শব্দগুলিকে যখন আমরা পৃথক-পৃথকভাবে দেখি, তখন সেই সুনির্দিষ্ট অর্থের আশ্রয়েই তাদের নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। পক্ষান্তরে, বাক্যের ভিতরে প্রবিষ্ট হবার সঙ্গে-সঙ্গেই যে তাদের নিশ্চলতার অবসান ঘটে, তা-ও নয়। ঘটে একমাত্র তখনই, ঠিকমতো-নির্বাচিত দুই বা ততোধিক শব্দ যখন পরস্পরের সান্নিধ্যে এসে দাঁড়ায়। এই যে পরস্পরের কাছে এসে দাঁড়ানো, একে আমরা বিদ্যুন্ময়” সান্নিধ্য বলতে পারি। আমরা লক্ষ করি যে, এই সান্নিধ্য অর্জিত হবার সঙ্গে-সঙ্গেই শব্দের সেই অর্থগত নিশ্চলতার অবসান ঘটেছে, তারা চঞল। হয়ে উঠেছে, এবং পরস্পরের সহযোগে তারা তাদের ধরাবাঁধা অর্থকে অতিক্ৰম করে অন্যতর কোনও অর্থ অথবা তাৎপর্যকে আভাসিত করতে চাইছে। অর্থাৎ, অর্থের বিচারে, যা ছিল নেহাতই একমাত্রিক বা ‘ওয়ান-ডাইমেনশনাল’ ব্যাপার, সহসা সে একটি বাড়তি মাত্রা পেয়ে গিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আমরা যখন পড়ি :
হে হংসবলাকা
ঝঞ্ঝামদরসে-মত্ত তোমাদের পাখা
রাশি রাশি আনন্দের অট্টহাসে
বিস্ময়ের জাগরণ তরঙ্গিয়া চলিল আকাশে।…(১৪)
অথবা জীবনানন্দের কবিতায়
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়–
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে…(১৫)
তখনই আমরা শব্দের সেই বিদ্যুন্ময় সান্নিধ্যের ক্লিয়াফল উপলব্ধি করতে পারি। একটু আগে আমরা যে ওয়র্ড-অর্ডার বা শব্দ-বিন্যাসের কথা শুনেছিলুম, এইখানেই তার গুরুত্ব।
কিন্তু সঠিক বিন্যাস থেকে জাত এই যে ক্লিয়াফল,- ধরাবাঁধা অর্থের আশ্রয় থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য এবং অন্যতর অর্থকে আভাসিত করার জন্য শব্দের এই যে চঞ্চলতা, শুধু কবিতার মধ্যেই যে একে আমরা দেখতে পাই, তা-ও নয়। দেখতে পাই অনেক গদ্যরচনার মধ্যেও। তখন আমরা বলি যে, সেই গদ্যরচনা-অন্তত সেই রচনার সেই অংশটুকু-যেন কবিতা হয়ে উঠেছে।
কবিতা কী, এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাহলে এখন আমরা বলতে পারি যে, কবিতা আসলে শব্দ নয়, বরং শব্দকে ব্যবহার করবার এক রকমের গুণাপনা। ভাষার মধ্যে যা কিনা অন্যবিধ একটি দ্যোতনা এনে দেয়। (উদ্ধৃত দুটি কবিতাংশে বাঁকা হরফে মুদ্রিত দুই বা ততোধিক শব্দ যেমন দিয়েছে।) অথবা বলতে পারি, কবিতা আসলে ভাষার একটি স্তর, কবিতা বলে গণ্য হতে হলে আমাদের ভাবনার শব্দ-রূপকে যে-স্তরে উত্তীর্ণ হতে হবেই; আবার, অন্যদিকে, গদ্যরচনাও যেস্তরকে মাঝে-মাঝে স্পর্শ করে যায়।
—————-
১. “it looks as if his Aristotle’s treatise on poetry was an answer to Plato’s challenge.” (আরিস্টটলের কাব্যতত্ত্বর ইনগ্রাম বাইওয়াটার-কৃত অনুবাদের ভূমিকা।)
২. রাজশেখর ও কাব্যমীমাংসা। শ্ৰীনগেন্দ্ৰনাথ চক্রবর্তী।
৩. The Design of Poetry. Charles B. Wheeler.
৪. ৫. ৬. সাহিত্যধর্ম। সাহিত্যের পথে।
৭. যেতে নাহি দিব (১২৯৯ বঙ্গাব্দ)। সোনার তরণী।
৮. মুক্তি (১৩২৫ বঙ্গাব্দ)। পলাতকা।
৯. “The language of the age is never the language of poetry.” Thomas Gray.
১০. “There are certain words in every language particularly adapted to the poetical expression; some from the image or idea they convey to the imagination; and some from the effect they have upon the ear.” Oliver Goldsmith.
১১…”the real language of men.” W. Wordsworth.
১২. Wordsworth. Sir Walter Raleigh.
১৩. ছন্দ। রবীন্দ্রনাথ।
১৪. বলাকা। বলাকা।
১৫. আট বছর আগের একদিন। মহাপৃথিবী।
কবিতা কেন
সত্যিই তো, কেন?
আমাদের চতুর্দিকে অহোরাত্র যে অসংখ্যা রকমের কর্মকাণ্ড চলেছে, এবং যার উপরে নির্ভর করছে আমাদের বৈষয়িক ভালোমন্দ, আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, তার সঙ্গে যদি কবিতা রচনা ও পাঠের ব্যাপারটাকে কার্যকরণের সূত্রে যুক্ত করে দেখানো যেত, এবং যদি বলা যেত যে, কিছু লোক কবিতা লেখেন ও কিছু লোক কবিতা পড়েন বলেই এত-সব কাজ অবাধে চলতে পারছে, নইলে এসব কাজের চাকা কবেই অচল হয়ে পড়ত, তাহলে আর কথাই ছিল না, একেবারে নিশ্চিত হয়ে সে-ক্ষেত্রে আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারতুম যে, এই তো, এরই জন্যে কবিতা।