আটপৌরে-শব্দ-সংবলিত কথ্যভাষায় কবিতা লিখবেন, ওয়ার্ডসওয়ার্থের এই প্রতিজ্ঞায় তাঁর সমসাময়িক অন্য-এক বিশিষ্ট কবির, কোলরিজের কিছুমাত্র সায় ছিল না। তার কারণ, ‘কাব্যিক শব্দসুষমার প্রতি র্তারও আসস্থা ছিল আত্যন্তিক। আপন প্রত্যয়ের সপক্ষে সেদিন অতিশয় জোরালো রকমের তর্কও তিনি চালিয়েছেন। পরবর্তীকালের সাহিত্য-আলোচনার উপরে সেই তর্কবিতর্কের ছায়া যখন বারে বারে সঞিারিত হচ্ছিল, তখন, তারই মধ্যে, স্যার ওয়ালটার রলির মুখে আমরা এমন একটা কথা শুনতে পেলুম, যা কিনা একটা মীমাংসা-সূত্রের আভাস এনে দেয়। কবিতার আলোচনায় শব্দের গুরুত্ব যে অপরিসীম, তা তিনি অস্বীকার করলেন না, কিন্তু একই সঙ্গে বললেন যে, ওয়র্ড-অর্ডার বা শব্দ-বিন্যাসের গুরুত্বও কিছু কম নয়।(১২)
সম্ভবত আরও বেশি। রলি অবশ্য তার স্বদেশীয় কবিতার শব্দ-বিন্যাসের কথাই ভাবছিলেন। কিন্তু শুধু ইংরেজি কবিতা নয়, সমস্ত ভাষার কবিতা সম্পর্কেই এ কথা প্রযোজ্য। শব্দের সুষ্ঠু বিন্যাস আসলে কবিতামাত্রকেই সেই সামর্থ্য জোগায়, যা থাকলে তবেই একটি কবিতা, কিংবা তার একটি অংশ, সবচেয়ে জোরালোভাবে আমাদের চিত্তে এসে আঘাত করে। একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। ছন্দের দিক থেকে যে-পঙক্তিটিকে বিচার করে দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ,(১৩) এবং বলেছিলেন যে, “ছন্দের ঝংকারের মধ্যে” দুলিয়ে দেবার ফলেই এই পঙক্তিটি এমন একটা স্পন্দন পেয়ে যাচ্ছে, যা “কোনো দিনই শান্ত হবে না”, সেই “কেবা শুনাইল শ্যামনাম”কে
ক) শুনাইল কেবা শ্যামনাম
খ) শ্যামনাম কেবা শুনাইল
গ) কেবা শ্যামনাম শুনাইল
ঘ) শ্যামনাম শুনাইল কেবা
ঙ) শুনাইল শ্যামনাম কেবা।
বলা বাহুল্য, মূল পঙক্তিটিকে পুনর্বিন্যস্ত করে এভাবে সাজিয়ে নিলেও তার অর্থ একই থাকে, এবং ছন্দের যেটা মূল কাঠামো, তারও কোনও হানি হয় না। কিন্তু নবতর এই বিন্যাসগুলি ঠিক ততটাই জোর পায় না, পঙক্তিটির মূল বিন্যাসের মধ্যে যতটা জোর আমরা লক্ষ করি। মূল বিন্যাসকে সেদিক থেকে ‘ধ্রুব বিন্যাস’ বলতে হয়। ধ্রুব এই অর্থে যে, তার আর কোনও নড়াচড়া হবার উপায় নেই।
একটু বাদেই এই বিন্যাসের প্রসঙ্গে আমাদের ফিরতে হবে। কিন্তু তার আগে আর-একটা কথা বলে নেওয়া দরকার। সেটা এই যে, শব্দকে প্রাধান্য দেবার এই যে প্রবণতা, এরই সমান্তরালভাবে আর-একটি প্রবণতাও যে ভিন্নতর একটি সিদ্ধান্তের দিকে এগিয়ে গেছে, তা-ও আমরা লক্ষ না করে পারি না। আমরা দেখতে পাই যে, একদিকে যখন শব্দ ও ভাষার উপরে গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে, তখন, অন্যদিকে, ভাষার উপরে আসন দেওয়া হচ্ছে ভাবনাকে। শেলির “এ ডিফেনস অব পোয়ট্রি খুব স্পষ্ট করেই আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে যে, কবিতার যা কিনা। সারাৎসার, ভাষার মধ্যে তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, কেন-না শব্দকে তা অতিক্রম করে যায়। শৃঙ্খলা (অর্ডার), সৌন্দর্য (বিউটি) ও সত্যের (টুথ) সঙ্গে তার তুলনা টেনেছেন শেলি। বলছেন, শব্দ দিয়ে যা আমরা বানিয়ে তুলি, শুধু সেইটুকুর মধ্যে তা সীমাবদ্ধ নয়।
শেলির এই বক্তব্য থেকে আমাদের বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, কবিতার শরীর ও কাব্য-ভাবনাকে শেলি আসলে পৃথক করে দেখতে চাইছেন। নিতান্ত শব্দের মধ্যে যেটুকু ধরা পড়েছে, আমরা যখন তারই উপরে নিবন্ধ করছি আমাদের আগ্রহ, তখন তার দিক থেকে আমাদের চিন্তাকে তিনি ঘুরিয়ে দিতে চাইছেন সেই ভাবনার দিকে, ঠান্ডা ও কঠিন গুটিকয় শব্দের মধ্যে যার অনেকটা অংশই ধরা পড়েনি।
প্রশ্ন হচ্ছে, কবির ভাবনার যে-অংশকে তিনি তার কবিতার মধ্যে ধরিয়ে দিতে পারেননি, আমাদেরই কি তা ধর্তব্য? সত্যি বলতে কী, তা-ও যদি আমাদের ধর্তব্য হয়, কবিতা নিয়ে তাহলে আর বিতণ্ডার অন্ত থাকে না। প্ৰেম ভালোবাসা বিদ্বেষ বিরহ যুদ্ধ রক্তপাত কিংবা এই রকমের যে-কোনও বিষয় নিয়ে নিতান্ত দায়সারা গোছের গুটি চার-ছয় লাইন লিখেও তো যে-কোনও কবি সে-ক্ষেত্রে অক্লেশে আমাদের বলতে পারেন যে, ওই চার-ছয় লাইনের মধ্যে যা পাওয়া যাচ্ছে, তার ভিত্তিতে যেন কবিতাটিকে আমরা বিচার করতে না যাই, কেন-না, ওর মধ্যে যেটুকু ধরা পড়েছে, তার চেয়ে অনেক বড়ো করে, অনেক নিবিড় করে ওই বিষয়টিকে তিনি ভেবেছিলেন। বলা বাহুল্য, শিল্পীমাত্রেই তা-ই ভেবে থাকেন, এবং কোনও শিল্পীই তাঁর ভাবনাকে একেবারে সর্বাংশে তীর সৃষ্টির মধ্যে বিন্বিত করে দেখাতে পারেন না। কবি পারেন না, চিত্রকর পারেন না, ভাস্কর পারেন না। ভাবনা ও রূপের মধ্যে অল্পবিস্তর পার্থক্য সর্বক্ষেত্রে থেকেই যায়। শুধু কবি বলে কথা নেই, তৃপ্তিহীনতা তাই শিল্পীমাত্রেরই নিয়তি।
অন্যান্য শিল্পের কথা থাক। কবিতার প্রসঙ্গে ফিরে আসি। কবির ভাবনার সঙ্গে সরাসরি পরিচিত হবার কোনও উপায় যদি আমাদের থাকত, তাহলে তো— সন্থলভাবে দেখতে গেলে— কবিতা পড়বার কোনও দরকারই আমাদের হত না। কিন্তু তেমন কোনও উপায় আমাদের নেই। ফলে, তার ভাবনার যেটা ব্যক্তি অথবা বাস্তব রূপ, শব্দ-রূপ, তারই সাহায্য নিতে হয় আমাদের। এবং খুশি থাকতে হয় কবির ভাবনার শুধু সেইটুকুর সঙ্গে পরিচিত হয়ে, যেটুকু তীর কবিতার মধ্যে বিম্বিত ও আভাসিত হয়েছে। কীভাবে বিন্বিত ও আভাসিত হয়েছে, শুধু সেইটুকুই আমাদের বিচাৰ্য। যখন আমরা কবিতা পড়ি, তখন আমরা কবিতা-ই পড়ি; ভাবনার ওই শব্দ-রূপ ছাড়া আর কিছুই তখন আমাদের বিচার্য নয়।