কাব্যিক শব্দের প্রতি এই যে পক্ষপাত, এটা কিন্তু একান্তভাবেই অষ্টাদশ শতকের ব্যাপার নয়, কিংবা বিশেষভাবে ইংরেজি সাহিত্যেরও ব্যাপার নয়। এই সেদিনও বাংলা কাব্যসাহিত্যের যা ছিল প্রধান স্রোতোধারা, এবং মুখ্যত যা ছিল রবীন্দ্ৰপ্ৰতিভা ও রবীন্দ্ৰ-প্রভাব থেকে উৎসারিত, গত শতাব্দীর অন্ত্য অধ্যায় ও এই শতাব্দীর প্রথম কয়েক দশকে তার মধ্যেও এই একই পক্ষপাত আমরা দেখতে পাই। আমরা লক্ষ করি যে, সাধারণ মানুষেরা তাদের কথাবার্তায় যেসব শব্দ প্রায়শ ব্যবহার করে থাকে, সেই আটপৌরে শব্দগুলি সেখানে বিশেষ প্রশ্ৰয় পায় না, এবং সাধারণ মানুষদের নিত্যব্যবহার্য নানা সাংসারিক জিনিসপত্র সম্পর্কেও সেই কবিতা বড়ো বিস্ময়করভাবে নীরব থাকে।
অষ্টাদশ শতকের ইংরেজ কবি টমাস গ্রে বলেছিলেন, কবিতা কখনও তার সমকালীন ভাষায় রচিত হয় না। গ্রে-র এই উক্তিকেই বাংলা কবিতা পরবর্তী শতকে তার আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিল কি না, তা আমার জানা নেই। তবে, উনিশ শতকের অন্ত্য অধ্যায় থেকে তঁর মৃত্যুকাল অবধি যিনি ছিলেন বাংলা কবিতার প্রধান পুরুষ, সেই রবীন্দ্রনাথের, অন্যবিধ সাহিত্যকর্মে না হোক, কবিতায়— এমনকি, এই শতাব্দীর প্রথম তিন দশকের মধ্যে রচিত কবিতায়- যে-শব্দারুচির সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে, তাতে আমরা বুঝতে পারি যে, কবি হিসেবে তিনিও ছিলেন “কাব্যিক” শব্দের পক্ষপাতী। তাঁর সাহিত্য-বিষয়ক নিবন্ধাবলিতেও এই সত্যটা গোপন থাকেনি। সেখানে তিনি দাবি করছেন বটে, “আমি নিজে জাত-মানা কবির দলে নই,”(৪) কিন্তু পরীক্ষণেই বলছেন, “বাঁশবনের কথা পাড়তে গেলে অনেক সময় বেণুবন বলে সামলে নিতে হয়।”(৫) শুনে কি গ্রে-র কথাটাই মনে পড়ে। না? আবার যখন শুনি, “বকফুল, বেগুনের ফুল, কুমড়োফুল, এই-সব রইল কাব্যের বাহির-দরজায় মাথা হোঁট করে দাঁড়িয়ে; রান্নাঘর ওদের জাত মেরেছে,”(৬) তখন সেই জনসনের কথাই আমাদের মনে পড়ে যায়, যিনি বিশ্বাস করতেন যে, কসাই ও পাচকের সংসৰ্গদোষ নাইফ শব্দটার জাত মেরে দিয়েছে।
রবীন্দ্ৰনাথ যে সেই পর্যায়ে রচিত তার কবিতায় কোথাও আটপৌরে শব্দ ব্যবহার করেননি, কিংবা নামোল্লেখ করেননি। আমাদের নিত্যব্যবহার্য বস্তুসামগ্ৰীর, তা অবশ্য নয়। এক্ষুনি আমার মনে পড়ছে গত শতকের অন্ত্য দশকে রচিত তার একটি বিখ্যাত কবিতার(৭) কথা, যেখানে ‘হাঁড়ি’ ‘সরা’ থেকে শুরু করে ‘গুড়ের পাটালি’ আর ‘ঝুনা নারিকেল’ পর্যন্ত এমন-সমস্ত শব্দের উল্লেখ ঘটেছে, হেঁশেল আর উদরের সঙ্গে যাদের ‘সংসৰ্গদোষের’ কথা আমরা সবাই জানি। উপরন্তু সেখানে ব্যবহৃত হচ্ছে আটপৌরে বাগভঙ্গিমাও। কিন্তু একইসঙ্গে আমরা লক্ষ না-করে পারি না যে, এই জাত-যাওয়া বস্তুসামগ্রীর নাম আর আটপৌরে বাগভঙ্গিমা আসছে কবিতাটির শুধু সেই অংশেই, যেখানে তিনি একটু রঙ্গরসের লঘু আবহ গড়ে তুলতে চান। আমরা বুঝতে পারি, আটপৌরে শব্দ আর আটপৌরে বাগভঙ্গিমা সেখানে তীর কৌতুকের উপকরণমাত্র। তার বেশি মর্যাদা তিনি তখনও তাদের দিচ্ছেন না। এমনকি তার অনেক বছর পরে লেখা, প্রায় একই রকমের বিখ্যাত, আর-একটি কবিতাতেও(৮) না। সেখানে বুগণা নারীটি যখন বলে, “রাধার পরে খাওয়া আবার খাওয়ার পরে রাধা / বাইশ বছর এক চাকাতে বাধা”, তখন সেই বক্তব্যের সূত্র ধরে কত অনায়াসেই তো নিত্যব্যবহার্য নানা তৈজসপত্রের উল্লেখ ঘটতে পারত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তা ঘটতে দেন না, হেঁশেলের আভাসমোত্র দিয়েই তাকে- তারই ভাষায় বলি- “সামলে নিতে হয়।” অথচ ওসব জিনিসের উল্লেখ ঘটলে কবিতাটির বেদনার দিকটা যে কিছুমাত্র চাপা পড়ত, এমন কথা বিশ্বাস করবার কোনও যুক্তি নেই।
লক্ষণীয় ব্যাপার এই যে, ইংরেজি সাহিত্যের হঠাৎ-ভাব্য-হয়ে-ওঠা পরিবেশের মধ্যে স্যামুয়েল জনসন যখন অকাব্যিক” শব্দের দিকে তঁর নিষেধের তর্জনী তুলে ধরছিলেন, টমাস গ্রে যখন সমকালীন ভাষা থেকে কবিতার ভাষাকে একেবারে আলাদা করে চিহ্নিত করে দিচ্ছিলেন(৯) এবং অলিভার গোলডিস্মিথ যখন তার এই প্ৰত্যয়কে প্রতিষ্ঠা দেবার চেষ্টায় ছিলেন যে, সব শব্দ নয়, প্রতিটি ভাষাতেই আসলে কবিতায় ব্যবহৃত হবার যোগ্য আলাদা এমন-কিছু শব্দ রয়েছে, যা আমাদের কল্পনাকে দীপিত করে ও কর্ণকে আরাম দেয়’(১০) তখন অন্যদিকে ধীরে-বীরে তৈরি হয়ে উঠছিল বিদ্রোহের পটভূমি। আমরা জানি যে, এর কিছুদিন বাদেই আবির্ভাব ঘটবে ওয়ার্ডসওয়র্থের। জানি যে, পোশাকি শব্দকে নির্বাসনে পাঠাবার আহবান জানাবেন তিনি। বলবেন যে, শুধু সেই ভাষাতেই কবিতা লেখা উচিত, যা কিনা মানুষের নিত্যব্যবহার্য মুখের ভাষা।(১১)
বলা বাহুল্য, ঝোকটা এক্ষেত্রে বিপরীত বিন্দুতে পড়ছে বটে, কিন্তু এ-ও আসলে চরম পন্থাই, এক ধরনের শব্দকে যা সমূহ গ্ৰহণ করতে বলে ও অন্য ধরনের শব্দকে যা সমূহ বৰ্জন করতে শেখায়। বুঝতে চায় না যে, কবিতার উপাদান হিসেবে সমস্ত শব্দই গ্রাহ্য, কিন্তু নির্বিচারে কোনও শব্দই গ্রাহ্য নয়। আসলে, কোনও কবিতার মধ্যে কোনও শব্দকে অনধিকার-প্ৰবেশকারী বলে মনে হবে কি না, সেটা একেবারে সর্বতোভাবেই নির্ভর করছে শব্দগুলিকে যিনি ব্যবহার করেন, তাঁর যোগ্যতার উপরে। বস্তৃত, কোনও কবিতার মধ্যে কোনও শব্দ কিংবা শব্দগুচ্ছ যখন আড়ষ্ট, অপ্রতিভা ও অধোবদন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, এবং কবিতাটিকে তার লক্ষ্যে পৌঁছে দেবার ব্যাপারে কিছুমাত্র সাহায্য করে না, তখন এটাই আমাদের বুঝতে হবে যে, শব্দ-নির্বাচনে- অন্তত সেই কবিতাটিকে নির্মাণ করে তুলবার সময়ে- তিনি যথেষ্ট রকমের যোগ্যতা দেখাতে পারেননি।