অনেকেই পড়েন না। এবং তা সত্ত্বেও তাদের দিন দিব্যি কেটে যায়। যেমন, গান না-শূনে এবং ছবি না-দেখেও অনেক মানুষেরই দিন দিব্যি কাটতে থাকে, এ-ও তেমনই ব্যাপার, এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। বরং ধরে নেওয়াই ভালো যে, কবিতা নামক ব্যাপারটা সকলের জন্য নয়।
কারও-কারও জন্য। জীবনানন্দ বলেছেন, সকলেই কবি নয়, কেউ-কেউ কবি। এক্ষেত্রেও সেই একই কথা। সকলেই পাঠক নয়, কেউ-কেউ পাঠক।
আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, কেন পাঠক? কবিতা কি সত্যিই তাদের কিছু দেয়? যদি দেয় তো সেটা কোন বস্তু? কী সেই প্ৰাপ্তি, যার প্রত্যাশায় তাঁরা কবিতার দিকে, আবহমান কাল ধরে, হাত বাড়িয়ে আছেন?
একটা প্রাপ্তির কথা আমরা “ডিফেনস’-এর লেখকের কাছেই শুনি। তিনি বলেছেন, কবিতা আমাদের চিত্তকে জাগিয়ে তোলে ও তার প্রসার ঘটায়। পৃথিবীর গোপন সৌন্দর্যকে অনবগুষ্ঠিত করে দেখায়, এবং এমনভাবে দেখায় যে, যে-বস্তুজগৎকে আমরা চিনি, তাকেও যেন অচেনা ঠেকতে থাকে।(১৭)
আর রবীন্দ্রনাথ বলেছেন “কবিচিত্তে যে অনুভূতি গভীর, ভাষায় সুন্দর রূপ নিয়ে সে আপনি নিত্যতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়।”(১৮) সেদিক থেকে যদি দেখি, তা হলে বুঝতে হবে যে, কবির অনুভূতি এই যে ভাষার মধ্যে, অর্থাৎ বুপের মধ্যে, নিজের নিত্যতাকে প্রতিষ্ঠা করছে, এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে পরিচিত হওয়াই পাঠকের পক্ষে একটা মস্ত প্ৰাপ্তি।
কবিতা কেন, এই প্রশ্নের আরও অনেক-অনেক উত্তর নিশ্চয় খুঁজে বার করা যায়। কিন্তু আপাতত তার দরকার নেই, অন্য-কোনও উত্তরের সন্ধানে ব্যাপৃত হবার আগে বরং এই দুটি উক্তিকেই আর-একটু খুঁটিয়ে দেখা যাক। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, শেলি বলছেন বস্তুজগতের কথা (কবিতা যার গোপন সৌন্দর্যের নির্মোিকটাকে খসিয়ে দেয়) আর রবীন্দ্রনাথ বলছেন আন্তর অনুভূতির কথা (বৃপের মধ্যে যে-অনুভূতির নিত্যতা নিজেকে ‘প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে)। হঠাৎ শুনলে এই উক্তি দুটিকে- যার একটিতে দৃশ্যজগতের উপরে জোর পড়েছে ও অন্যটিতে আন্তর অনুভূতির উপরে- পরস্পরের বিরোধী বলে মনে হওয়া কিছু বিচিত্র নয়। কিন্তু তা যে নয়, বরং এই উক্তি দুটি যে পরস্পরের পরিপূরক, একটু বাদেই তা আমরা ধরতে পারি। আমরা বুঝতে পারি যে, যা দিয়ে কবিতা তৈরি হয়ে ওঠে, সেই অপরিহার্য দুটি অংশের কথাই দুই কবি আমাদের জানিয়ে দিচ্ছেন। একজন বলছেন বিষয়বস্তু বা উপকরণের কথা। অন্যজন উপলব্ধির।
বলা বাহুল্য, কবিতার যেটা বিষয়বস্তুর দিক- কোনও কাহিনি কিংবা কোনও ঘটনা কিংবা কোনও দৃশ্য- সরাসরি তার কাছ থেকেও আমরা অনেকেই অনেক-কিছু পেয়ে যাই। দৃষ্টান্ত হিসেবে রবীন্দ্রনাথেরই কয়েকটি কবিতার উল্লেখ আমরা করতে পারি। রাত্রি যখন আসন্ন, গৰ্জিত মহাসমুদ্রের উপর দিয়ে সঙ্গীহীন একটি পাখি তখন উড়ে চলেছে, তার দুঃসময়’ কবিতার এই যে বিষয়বস্তু, শুধু এরই গুণে এই কবিতা যে কারও-কারও চিত্তে সাহসের সঞার করে, আবার কারও-কারও চিত্তে প্রেরণা জোগায় প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও পরিণামের কথা চিন্তা না করে আপনি ভূমিকায় সুস্থিত থাকতে, সে-কথা স্বীকার্য। ঠিক তেমনই “বর্ষশেষ’ কবিতার বিষয়বস্তু আমাদের জানিয়ে দেয় যে, ভয়ংকর বিপর্যয়ের ভিতর দিয়েই সম্ভব হতে পারে, হয়ে থাকে, নবীনতার অভ্যুদয়। আবার, একইভাবে, ‘মৃত্যুর পরে’ কবিতাটি থেকে আমরা আমাদের শোকার্ত সময়ে কিছু সান্ত্বনা পেতে পারি, এবং দুই পাখি’ কবিতাটির বিষয়বস্তু থেকে বুঝে নিতে পারি যে, সুখ ও স্বাধীনতা কেন, আত্যন্তিক আগ্রহ সত্ত্বেও, পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হতে পারে না।
এই যে সাহস, প্রেরণা, সান্ত্বনা ও শিক্ষা এই কবিতাগুলির ভিতর থেকে অনেকে পেয়ে আসছেন, এবং আরও অনেক কাল ধরে আরও অনেকে পাবেন, এসব প্ৰাপ্তির কোনওটিরই মূল্য কিছু কম নয়। কবিতাপাঠের খুবই মূল্যবান কয়েকটি পুরস্কার বলে এদের আমরা গণ্য করতে পারি। কিন্তু, বিষয়বস্তুর সঙ্গে এদের সরাসরি যোগ-সম্পর্ক সত্ত্বেও, এক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন ওঠে। সেটা এই যে, কবিতার নিজস্ব প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে যদি-না পাঠকের কাছে এসে পৌঁছে।াত, তাহলে এই সাহস, প্রেরণা, সান্ত্বনা ও শিক্ষার ব্যাপারটা ঠিক এতটাই জোর পেত। কি না। তা যে কিছুতেই পেত না, আমাদের অভিজ্ঞতা থেকেই তা আমরা বলতে পারি। আমরা জানি যে, এই ধরনের সাহস, প্রেরণা, সান্ত্বনা ও শিক্ষার কথা নানা নীতিগল্পের মধ্য দিয়েও আমাদের শোনানো হয়ে থাকে, কিন্তু এই কথাগুলি সেখানে এর সিকির সিকি জোরও পায় না।
কেন পায় না, সেটা বুঝবার জন্যে শেলির কাছেই আবার আমাদের ফিরতে হবে, এবং আর-একটু নজর করে দেখতে হবে তীর উক্তিটিকে। শেলি বলেছেন, কবিতা এই বস্তৃপৃথিবীর গোপন সৌন্দর্যকে গুণ্ঠনমুক্ত করে দেখায়, এবং এমনভাবে দেখায় যে, যেসব বস্তুকে আমরা চিনি, তাদেরও যেন অচেনা ঠেকতে থাকে। এখানে লক্ষণীয় ব্যাপার এই যে, যার সৌন্দর্যকে গোপন বলা হচ্ছে, সেই বস্তৃপৃথিবী নিজে কিন্তু গোপন নয়, আমাদের চোখের সম্মুখেই সে ছড়িয়ে পড়ে আছে। এমনকি, কবিতার সাহায্য ব্যতিরেকে যে তার সৌন্দর্যসম্ভার কারও চোখে পড়ে না, তা-ও আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। বস্তৃত, যাঁরা কবিতা পড়তে অভ্যস্ত নন, তাঁরাও তার অরণ্যের শ্যামশোভা, পর্বতের ধূমল বিস্তার, নদীর তরঙ্গভঙ্গ ও সমুদ্রের সফেন উচ্ছাস দেখে মুগ্ধ হয়ে থাকেন। সে-ক্ষেত্রে প্রশ্ন জাগে যে, তা-ই যদি হয়, তবে আর এই বস্তৃপৃথিবীর সৌন্দর্যকে “গোপন” বলবার অর্থ কী, এবং এমন কথাই-বা। আমরা কী করে মানব যে, কবিতা সেই সৌন্দর্যকে গুণ্ঠনমুক্ত করে। দেখায়?