“আজি বসন্তে বিশ্বখ্যাতায়
হিসেব নেই কো পুম্পে পাতায়
জগৎ যেন বেঁকের মাথায়
সকল কথাই বাড়িয়ে বলে”(১২)
তখন আমরা বুঝতে পারি যে, অতিরঞ্জনের এই ব্যাপারটাকে তিনি প্রকৃতির সৃষ্টিলীলার মধ্যেও প্রত্যক্ষ করেছিলেন। আর মানুষের সৃষ্ট শিল্পমালা তো সে-ক্ষেত্রে অসংখ্য অতিরঞ্জনে চিহ্নিত হয়ে আছে। কিন্তু এই অতিরঞ্জন বা অতিশয়োক্তি যে শিল্পেরই অঙ্গ, সে-কথা ভুলে যাওয়া ঠিক নয়। বায়রন যখন বলেন :
“Maid of Athens, ere we part,
Give, oh give me back my heart
Or, since that has left my breast,
Keep it now, and take the rest!”
কিংবা সুধীন্দ্রনাথ দত্ত যখন বলেন–
“একটি কথার দ্বিধাথরথর চূড়ে
ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী” (১৪)
কিংবা আমাদের তরুণ কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যখন বলেন :
“অফিস সিনেমা পার্কে লক্ষ লখক মানুষের
মুখে-মুখে রটে যায় নীরার খবর “
বকুলমালার তীব্র গন্ধ এসে বলে দেয়, নীরা আজ খুশি” (১৫)
তখন যুক্তিবাদী তার্কিক হয়তো বলবেন যে, এসব একেবারে নির্জলা মিথ্যে কথা, বায়রন মোটেই তাঁর বক্ষ থেকে হৃৎপিণ্ড উপড়ে নিয়ে সেটি আথেন্সের কোনো লালনার হাতে সমর্পণ করেননি, সুধীন্দ্রনাথের পক্ষে (শুধু সুধীন্দ্রনাথ বলে কথা কী, কোনও মর্তমানবের পক্ষেই) সম্ভব নয়। ইন্দ্রপুরীর আনন্দ আন্দাজ করা, এবং, সুনীল যা-ই বলুন, লক্ষ-লক্ষ মানুষের মুখে নীরা-নামী একটি বালিকার খবর রটে যাওয়াটা একেবারে আদ্যন্ত অসম্ভব একটা ব্যাপার; কিন্তু আমরা যারা অতিবাদকে শিল্পের অঙ্গ বলে জেনেছি, তারা এইসব উক্তির মধ্যে কোনও দোষ দেখব না, বরং শিল্পের রসে রঞ্জিত এই অতিশয়ৌক্তিগুলিকে আমরা কবিতার এক-একটি মহার্ঘ অলংকার বলেই চিনে নেব।
রবীন্দ্রনাথের কবিতায় তো বটেই, গানেও এই ধরনের অলংকার আমরা প্রচুর দেখতে পাই। প্রসঙ্গত আমাদের মনে পড়ছে “একদা তুমি, প্রিয়ে, আমারি এ তরুমূলে” গানটির কথা। ফুলসজ্জায় সজ্জিত হয়ে কবির তরুমুলে যে-মেয়েটি একদা উপবেশন করেছিল, তাকে সম্বোধন করে কবি বলছেন যে, সেদিনকার কথা তার হয়তো মনে নেই, কিন্তু নদী তাকে ভোলেনি; এমনকি, নদী তার স্রোতের মধ্যে সেই মেয়েটির বেণির ছবিটিকে আজও ধরে রেখেছে।(১৬) শুনে সত্যান্বেষী তার্কিক হয়তো এক্ষেত্রেও বলবেন যে, এটা একেবারে নির্জলা মিথ্যে কথা, নদী কাউকে মনে রাখে কিংবা আপন স্রোন্তোধারার মধ্যে ধরে রাখে। কারও বেণির চিত্র, এই সংবাদ আদৌ বিশ্বাসজনক নয়। কিন্তু আমরা সে-কথা বলব না। আমরা ঠিকই বুঝে নেব যে, কবিই সেই মেয়েটিকে আজও ভুলতে পারেননি, এবং, নদীর বাঁকা স্রোতের দিকে চোখ পড়বামাত্র, কবিরই আজও সেই মেয়েটির বঙ্কিম বেণির কথা মনে পড়ে যায়, কিন্তু এই সত্য কথাটা সরাসরি না বলে কবি যে তাঁর স্মৃতিকে এক্ষেত্রে নদীর উপরে আরোপ করেছেন, এতেই বরং আরও সম্পন্ন হয়ে উঠেছে। তাঁর গানের বাণী। এটা অবশ্য অতিশয়োক্তি নয়, ঘুরিয়ে কথা বলবার ব্যাপার, কিন্তু অলংকার হিসেবে এর মূল্যও অপরিসীম।
কিন্তু আর নয়। কবিতার বিরুদ্ধে হরেক অভিযােগের ফিরিস্তি আমরা শুনেছি, এবং জেনেছি যে, কেন সেগুলি ধোপে টেকে না। সওয়াল-জবাবের মধ্য দিয়ে এই কথাটা আশা করি স্পষ্ট হয়েছে যে, কবিতার প্রতি বিরূপ হবার সত্যি কোনও কারণ নেই। কিন্তু এটা হল নঞর্থক কথা, উলটো-দিক থেকে বিচার করবার ব্যাপার। এবারে সোজাসুজি আমরা কবিতার দিকে তাকিয়ে জেনে নিতে চাই যে, কোন সদর্থক (পজিটিভ) গুণ রয়েছে তার। বুঝতে চাই, তাকে আমরা সময় দেব কেন। অর্থাৎ, কেন আমরা কবিতা পড়ব।
কিন্তু তার আগে একটা সহজ কথা বোধ হয় স্বীকার করে নেওয়া ভালো। সেটা এই যে, কবিতা না-পড়লেই যে মানবজীবন একেবারে অচল হয়ে পড়বার আশঙ্কা, তা কিন্তু নয়। এমন একটা রাষ্ট্ৰীয় কিংবা সামাজিক ব্যবস্থার কথা অনেকেই কল্পনা করেছেন, যেখানে কোনও মানুষেরই খাওয়া-পরার কোনও কষ্ট থাকবে না। তা ছাড়া, কাউকে সেখানে নিরাশ্রয় হয়ে দিন কাটাতে হবে না, বিনাচিকিৎসায় মরতে হবে না, এবং প্রত্যেকেই সেখানে লেখাপড়া করবার সুযোগ পাবে। কিন্তু, অন্তত এখনও পর্যন্ত, এমন কোনও রাষ্ট্ৰীয কিংবা সামাজিক ব্যবসথার কথা কেউ কল্পনা করেননি, যেখানে সবাই দিনের মধ্যে অন্তত কিছুটা সময় গান শুনতে কিংবা ছবি দেখতে চাইবে। ঠিক তেমন, সর্বজনে যেখানে কবিতা পড়তে চাইবে, এবং পড়বার সুযোগ না পেলে ভাববে যে জীবন একেবারে ব্যর্থ হয়ে গেল, এমন কোনও রাষ্ট্ৰীয় কিংবা সামাজিক ব্যবসথার কথাও কেউ কল্পনা করেননি।
কেন করেননি, সেটা বুঝতে কারও অসুবিধে হবার কথা নয়। কবিতাপাঠ আমাদের নূ্যনতম চাহিদা বলে গণ্য হয় না। হবার কোনও কারণও নেই। অন্ন বস্ত্ৰ আশ্রয় কর্মসংস্থান চিকিৎসা সাক্ষরতা ইত্যাদি যে আমাদের নূ্যনতম চাহিদা বলে গণ্য হয়, তার কারণ, এগুলি ছাড়া কারও চলে না। কিন্তু যেমন গান কিংবা ছবি, তেমনই কবিতা ব্যতিরেকেও অসংখ্য মানুষের দিন দিব্যি কেটে যায়।
সত্যি বলতে কী, তেমন মানুষ আমাদের চারপাশেই আমরা অহরহ দেখতে পাই। কবিতার প্রসঙ্গে বলি, আমাদের প্রত্যেকেরই এমন বিস্তর প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন কিংবা বন্ধুবান্ধব রয়েছেন, যাঁরা প্রতিবেশী আত্মীয় কিংবা বন্ধু হিসেবে হয়তো খুবই ভালো ও নির্ভরযোগ্য, কিন্তু কবিতা নামক ব্যাপারটার ছায়াও পারতপক্ষে মাড়ান না। কখনও যে তাঁরা কবিতা পড়েননি, তা হয়তো নয়, ছাত্রাবস্থায় নিশ্চয়ই পড়েছিলেন, কিন্তু সে তো নেহাতই পরীক্ষায় পাস করবার জন্যে নোট মিলিয়ে পড়া, পরীক্ষার পাট চুকে যাবার পরে কবিতার সঙ্গেও তাঁদের সম্পর্ক তাঁরা চুকিয়ে দিয়েছেন, এবং তার জন্যে যে তাদের জীবন কোথাও ঠেকে থাকছে, তা-ও নিশ্চয় নয়। একদা তাঁরা দায়ে ঠেকে, বাধ্য হয়ে গুটিকয় কবিতা পড়েছিলেন, কিন্তু সেই বাধ্যবাধকতার পর্ব শেষ হয়ে গেছে, সুতরাং আর-কখনও র্তারা কবিতা পড়বেন না।