- বইয়ের নামঃ কবিতা কী ও কেন
- লেখকের নামঃ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
- প্রকাশনাঃ দে’জ পাবলিশিং (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
০১. কবিতা কী
ধরা যাক, আমরা শিকার করতে বেরিয়েছি। ধরা যাক, আমরা একটি সিংহ শিকার করব। কিন্তু যেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছি, সিংহ সেখানে সত্যি-সত্যি আছে তো? কীভাবে বুঝব যে, সে আছে? ধরা যাক, একটু আগেই আমরা তার গর্জন শুনেছি। কিংবা নরম মাটিতে দেখেছি তার পায়ের ছাপ। সেই শোনা কিংবা সেই দেখার উপরে নির্ভর করে আমরা তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। দূরের একটা ঝোপ যেন একটু নড়ে উঠল। সিংহ? চকিতে একটা ছায়া যেন আমাদের চোখের সামনে থেকে সরে গেল। সিংহ? আমাদের প্রত্যেকেরই স্নায়ু একেবারে টানটান হয়ে আছে। হৃৎপিণ্ড উঠে এসেছে মুখের মধ্যে। আমরা প্রত্যেকেই আমাদের বুকের ধকধক খুব স্পষ্ট করে শুনতে পাচ্ছি। আমরা প্রত্যেকেই ভাবছি যে, আর দেরি নেই, এইবারে হয়তো যে-কোনও মুহুর্তে তার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে।
ধরা যাক, ঠিক এইভাবেই একটি কবিতার সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমরা। আমরা শুনেছি যে, কবিতা কিছু অসম্ভব শশবিষাণের ব্যাপার নয়, কবিতা বলে সত্যিই কিছু আছে, এবং আমাদের ধারে কাছেই আছে। তাই আমরা আশা করছি যে, আমাদের অন্বেষণ বিফলে যাবে না, যে-কোনও মুহূর্তে আমরা তার দেখা পাব।
কিন্তু দেখা পাওয়াই যথেষ্ট নয়, দেখা যখন হবে, তখন তাকে চিনে নিতে পারব তো? প্রশ্নটা আমাদের নয়, বিদেশি এক কবি-সমালোচকের। কিন্তু আর্চিবলড ম্যাকলিশ যখন এই প্রশ্ন তোলেন, তখন তার সমস্যাটা যে কী, তা খুব সহজেই আমরা বুঝতে পারি। আসলে, সিংহ কিংবা বাঘ কিংবা টেবিল কিংবা চেয়ার কিংবা কলম কিংবা বই কিংবা এই রকমের আরও অজস্র প্রাণী অথবা বস্তুকে যত সহজে চিনে নেওয়া যায়, কবিতাকে চিনে নেওয়া তত সহজ ব্যাপার নয়।
কেন নয়? ম্যাকলিশ এই প্রশ্নের একটা উত্তর দেবার চেষ্টা করেছেন। প্রসঙ্গত তিনি যা বলেছেন, তার মোদ্দা কথাটা এই যে, ইতিপূর্বে আমরা যদি সিংহ না-ও দেখে থাকি, তবু যে তাকে দেখবামাত্র আমরা চিনে নিতে পারি, তার কারণ আর কিছু নয়, নানা জনের কাছে এই প্ৰাণীটির যে-বৰ্ণনা আমরা শুনেছি, তার মধ্যে কোনও বিরোধ ছিল না। গল্পের অন্ধেরা যখন হাতির বর্ণনা দিয়েছিল, তখন তাদের একজন বলেছিল, হাতি হচ্ছে সাপের মতো; একজন বলেছিল, হাতি হচ্ছে কুলোর মতো; একজন বলেছিল, হাতি হচ্ছে থামের মতো; আর যে অন্ধটি হাতির শূড়, কান বা পা ছোঁয়নি, শুধু— হাতি যখন তার পাশ দিয়ে চলে যায়, তখন- আন্দোলিত বাতাসের একটা ঝাপটা খেয়েছিল মাত্র, সে বলেছিল যে, হাতি হচ্ছে একটা ঝড়ের মতো ব্যাপার। কিন্তু তেমন কোনও বিভ্রাট এক্ষেত্রে ঘটছে না। সিংহের বর্ণনা যাঁরা দিয়েছেন, প্রত্যেকেই তাঁরা চক্ষুম্মান ব্যক্তি। সুতরাং তাঁদের দেওয়া সেই বৰ্ণনার উপরে নির্ভর করেই সিংহকে শনাক্ত করা যায়। পক্ষান্তরে, কবিতা নামক ব্যাপারটাকে যে তেমন করে আমরা শনাক্ত করতে পারি না, তার কারণ, তার বিষয়ে যেসব বুর্ণনা আমরা পেয়েছি, অনেকক্ষেত্রেই সেইসব বর্ণনার মধ্যে কোনও মিল নেই। এমনকি, প্রায়শ তারা পরস্পরের বিরোধী। রামের দেওয়া বর্ণনার সঙ্গে শ্যামের বর্ণনা মেলে না। যাদুর বর্ণনা ও মধুর বর্ণনার মধ্যে বিস্তর ফারাক থেকে যায়। নবীনের দেওয়া বৰ্ণনায় আবার রাম শ্যাম যদু ও মধু, প্রত্যেকেরই আপত্তি ঘটে। ফলে, তাকে শনাক্ত করা আমাদের পক্ষে খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। দুই মহাজন যার বর্ণনায় একমত হতে পারেন না, কীভাবে তাকে আমরা খুঁজে ফিরব? এবং দেখা হয়ে গেলেই বা কীভাবে, কোন কোন লক্ষণ মিলিয়ে চিনে নেব তাকে?
সর্বসম্মত কোনও বর্ণনা কিংবা সংজ্ঞা না-পাবার যে অসুবিধা, কবিতার আলোচক-মাত্রেই কখনও-না-কখনও তার সম্মুখীন হন। তখন কীভাবে তাকে কাটিয়ে উঠবার চেষ্টা করেন তাঁরা? তাদের কেউ-বা কোনও পূর্বাচার্যের দেওয়া সংজ্ঞাকে পুরোপুরি মেনে নিয়ে অতঃপর তারই আলোয় চিনবার চেষ্টা করেন যে, কোনটা কবিতা আর কোনটা নয়। কেউ-বা সে-ক্ষেত্রে, কোনও পূর্বাচার্যের সংজ্ঞাকে একেবারে পুরোপুরি হয়তো মেনে নেন না, কিন্তু তারই সূত্র ধরে চেষ্টা করেন। অন্য কোনও সংজ্ঞা নির্ধারণের। আবার কেউ-বা, অন্য কারও সংজ্ঞার মুখাপেক্ষী না-হয়ে, একান্তভাবে অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে, অন্য পথে এগিয়ে যেতে চান। চেষ্টা করেন, পূর্বলব্ধ যাবতীয় সংজ্ঞার সঙ্গে সম্পর্কহীন, কোনও নূতন সংজ্ঞা খুঁজে নিতে। কিন্তু সেই নূতন সংজ্ঞা যখন খুঁজে পাওয়া যায়, তখন তা নিয়েও আবার নূতন করে বিরোধ ঘনিয়ে ওঠে। কাকে কবিতা বলে, এই প্রারম্ভিক প্রশ্নেরই কোনও সর্বজনগ্রাহ্য মীমাংসা আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
বলা বাহুল্য, কবিতার সংজ্ঞা নির্ধারণ ও লক্ষণ নির্ণয়ের এই যে নব-নব প্ৰয়াস, এবং তার থেকে সঞ্জাত এই যে বিরোধ, এই নিয়েই আমরা এখানে প্রশ্ন তুলতে পারি। বলতে পারি যে, নূতন করে আবার এতসব বাদবিসংবাদের মধ্যে জড়িয়ে যাবার দরকার নেই, তার চেয়ে বরং প্রাচীন মতামতগুলির দিকেই আর-এক বার চোখ ফেরানো যাক। দেখা যাক, তা-ই দিয়েই আমাদের প্রয়োজন মেটে কি না। অর্থাৎ তারই উপরে নির্ভর করে আমরা বুঝে নিতে পারি কি না যে, কবিতা নামক ব্যাপারটা আসলে কী।