জোড়া খুন
লোভ আমাকে অরণ্যের দিকে টেনে আনে।
তারপর
অচেনা সেই অরণ্যের মধ্যে
ভয় আমাকে দিগ্বিদিকে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ায়।
আমি ঠিক করেছিলুম,
আমার এই যুগল-শত্রুকে আমি শেষ না করে ছাড়ব না।
আগে আমি লোভের মরামুখ দেখব।
তারপর ভয়ের।
কিন্তু দ্যাখো, কী আশ্চর্য,
লোভের গলায়
আমার দীর্ঘ ও শাণিত ছুরিখানাকে আমূল বিঁধিয়ে দিয়ে
যেই আমি চেঁচিয়ে বলে উঠেছি,
“কিছুই আমি চাই না,”
ভয়ও অমনি, চুপসে-যাওয়া একটা বস্তার মতো, আমার পায়ের তলায়
লুটিয়ে পড়ল।
কখন আলো ফুটেছে, আমি জানি না।
আমি শুনতে পাচ্ছি,
দূর থেকে ভেসে আসছে সূর্যোদয়ের গান।
উদ্দীপক সুরার মতো
সেই গানের সুর ছড়িয়ে যাচ্ছে আমার রক্তে।
শরীরটা খুব হালকা লাগছে।
মনে হচ্ছে,
একটা মস্ত বড় ব্যাধির থেকে আমি মুক্ত হয়ে উঠলুম।
আমার সামনে ছিল লোভ।
আমার পিছনে ছিল ভয়।
আমি ভেবেছিলুম,
একে-একে আমি তাদের মোকাবিলা করব।
কিন্তু তার আর দরকার হল না,
একজনকে আক্রমণ করবার সঙ্গে-সঙ্গেই দেখতে পেলুম,
অন্যজনও ফতুর হয়ে গেছে।
আবিরের থালা হাতে নিয়ে আকাশ আমার মুখ দেখছে।
পাখিরা আমার বন্দনা গাইছে।
বৃক্ষ ও লতা বাতাসে নত হয়ে
নমস্কার করছে আমাকে।
জোড়া খুনের সমাধা করে, বাঁ পা এর লাথি মেরে
আমার দুই জন্মশত্রুর মৃতদেহকে একটা নালার মধ্যে ঠেলে দিয়ে
শিস দিতে দিতে
অরণ্য থেকে আমি বেরিয়ে এলুম।
না এলে না-ই বা এলে
না এলে না-ই বা এলে, তাই বলে কি এ-জন্মে আমার
পরিত্রাণ নেই?
তুমি যত ধোঁকা দাও, তুমি যত
চালাক মাছের মতো দূরে-দূরে ঘোরাফেরা করো,
আমারও ততই
জেদ বেড়ে যায়, আমি
শব্দনির্বাচনে তত সতর্ক হবার চেষ্টা করি।
ডাইনে-বাঁয়ে জমে আছে শব্দের পাহাড়। আমি
একদিকে থেকে একটি ইচ্ছুক পাথর তুলে এনে–
যে-রকম জুতো জামা ইত্যাদির মিলন ঘটানো হয়
সেইরকম–
অন্য পাথরের সঙ্গে তার
জোড় মেলানোর চেষ্টা করি,
ক্রমাগত ক্রমাগত চেষ্টা করি।
কিন্তু জোড় কিছুতে মেলে না।
তুমি একবার মাত্র হাতের মুঠোয় এসেছিলে
সুদূর শৈশবে;
তারপর একবারও এলে না।
যেমন আকাশ থেকে কবুতর মাটিতে, অথবা
দূর অরণ্যের ফুল বারান্দার টবের চারায়
দৈব নিয়মের মতো প্রতিদিন
নির্দিষ্ট সময়ে ফিরে আসে, সেইরকম আর
একবারও এলে না তুমি।
না এলে না-ই বা এলে, তাই বলে কি বিকল্পে আমার
পরিত্রাণ নেই?
সম্প্রতি দু’বার আমি দূর থেকে তোমাকে দেখলুম।
একবার আগ্রার এক ভগ্ন মিনারের শীর্ষে সন্ধ্যার আগুনে,
একবার পুরীর
দীপ্র মকরক্রান্তি তরঙ্গমালায়।
দেখলুম, এখনও তুমি একাধারে
হরিচন্দনের মত জলন্ত এবং
জলজ পুষ্পের মতো কমনীয় রয়ে গেছ। সেই
মুখশ্রী আমি
শব্দের ভিতর ধরে রাখতে চাই, আমি
শব্দে-শব্দে তাই জোড় বাঁধতে চাই, তবু
বাঁধতে পারি না।
অথচ নিশ্চিত জানি, রক্ত ও মাংসের সেই মূর্তিকে যদি না
হাতে পাই, তবে তাকে শব্দের ভিতরে
সমূহ ফোটাতে হবে, না-ফোটালে এ-জন্মে আমার
পরিত্রাণ নেই।
রক্তপাত, পড়ন্ত বেলায়
আজকের মতো খেলা তো প্রায়
খতম হতে চলল।
আর মাত্র মিনিট পাঁচেক বাকি।
যাও বাছা, মাঠে গিয়ে
এই পাঁচটি মিনিট তুমি কোনোক্রমে দাঁড়িয়ে থাকো।
চেয়ে দ্যাখো,
আলো পড়ে এসেছে।
চেয়ে দ্যাখো,
ওদের বোলারদের চোখ।
লোভে চকচক করছে।
মনে হচ্ছে, ওদের তেষ্টা এখনও মেটেনি।
মনে হচ্ছে,
এই শেষবেলায় ওরা অন্তত আর-একজনের
রক্ত না-দেখে ছাড়বে না।
বলো, আমার নামজাদা ব্যাটসম্যানদের
কাউকেই কি এখন আমি
মাঠে পাঠাতে পারি?
আজকের মতো তারা বেঁচেবর্তে থাক।
সকাল হোক
রোদ্দুর উঠুক,
তখন তারা খেলা দেখাবে।
তুমি যাও।
তুমি গিয়ে ওদের তেষ্টা মেটাও।
তুমি আমার এগারো-নম্বর খেলোয়াড়;
কিন্তু প্রমোশন দিয়ে তোমাকে আমি
তিন-নম্বরে তুলে আনলুম।
তোমার স্বার্থে নয়,
দলের স্বার্থে।
বাছা, তুমি ধরেই নাও যে, এই পড়ন্ত বেলায়
দলের স্বার্থে তোমাকে আমরা
খুন হতে পাঠাচ্ছি।
স্বপ্নে-দেখা ঘরদুয়ার
পুকুর, মরাই, সবজি-বাগান, জংলা ডুরে শাড়ি,
তার মানেই তো বাড়ি।
তার মানেই তো প্রাণের মধ্যে প্রাণ,
নিকিয়ে-নেওয়া উঠোনখানি রোদ্দুরে টান্-টান্।
ধান খুঁটে খায় চারটে চড়ুই, দোলমঞ্চের পাশে
পায়রাগুলো ঘুরে বেড়ায় ঘাসে।
বেড়ালটা আড়মোড়া ভাঙছে; কুকুরটা কান খাড়া
করে শুনছে, কথা বলছে কারা।
পুবের সূর্য পাশ্চিমে দেয় পাড়ি,
দুপুরবেলার ঘুমের থেকে জেগে উঠছে বাড়ি।
লাঠির ডগায় পুঁটলি বাঁধা, অনেকটা পথ ঘুরে
লোকটা যাচ্ছে দূরের থেকে দূরে।
ওর চোখেও কি এমন একটা বাড়ির স্বপ্ন টানা?
ওর মনেও কি গন্ধ ছড়ায় গোপন হাস্নুহানা?
ও বড়বউ, ডাকো, ওকে ডাকো,
ওই যে লোকটা পার হয়ে যায় কাঁসাই নদীর সাঁকো।
হ্যালো দমদম
আমার হাতের মধ্যে টেলিফোন;
আমার পায়ের কাছে খেলা করছে
সূর্যমণি মাছেরা।
পিচ-বাঁধানো সড়কের উপর দিয়ে
নৌকো চালিয়ে আমি
পৃথিবীর তিন-ভাগ জল থেকে এক-ভাগ ডাঙায় যাব।
সেই নৌকোর জন্যে আমি বসে আছি;
আর, পাঁচ মিনিট পরপর
ডায়াল ঘুরিয়ে চিৎকার করছি:
হ্যালো দমদম…হ্যালো দমদম…হ্যালো…
আমার মাথার উপরে জ্বলছে নিয়ন-বাতি;
আর আমার গোড়ালির চারপাশে চক্কর মেরে
হাঁটুর কাছে উঠে আসছে
মোহেনজোদড়োর নর্দমা থেকে উপচে-পড়া নোংরা কালো জলস্রোত।
আমার দেওয়ালে ফুটেছে সাইকেডেলিক ছবি।
সেই ছবির দিকে তাকিয়ে আমি ভাবতে থাকি যে,
আমার জুঁইলতা এখন
পাঁচ ফুট জলের তলায় ফুল ফোটাচ্ছে।
কিন্তু খুব-বেশি ভাবনা-চিন্তার সময় আমি পাই না।
আচমকা
আমার মনে পড়ে যায় যে,
দমদম-থানা থেকে একটা রেস্ক্যু-বোট আসবে।
সেই প্রতিশ্রুত উদ্ধারের জন্য পুনশ্চ আমি চেঁচাতে থাকি;
হ্যালো দমদম…হ্যালো দমদম…হ্যালো…
জল ঠেলে আমি শোবার ঘরে আসি।
জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে আমার মেয়ের গা।
তার টেম্পারেচার নিয়ে, জল ঠেলে, আমি আবার
টেলিফোনের কাছে ফিরে যাই।
সেই অবসরে, দরজা খোলা পেয়ে,
রাজ্যের কচুরিপানা ও একটা নেড়িকুত্তা
সাঁতার কেটে
আমার ড্রইংরুমে এসে ঢোকে।
আমি বিস্মিত হই না।
কচুরিপানার ফুলগুলিকে আমি ফ্লাওয়ার-ভাসে সাজিয়ে রাখি,
এবং নেড়িকুত্তাটিকে খুব যত্ন করে আমার
সোফার উপরে বসাই।
তারপর টেলিফোনের মাউথপিসটাকে
তার মুখের কাছে এগিয়ে দিয়ে বলি,
“যদি বাঁচতে চাস হারামজাদা
তা হলে আয়, আমার সঙ্গে গলা মিলিয়ে বল:
হ্যালো দমদম…হ্যালো দমদম…হ্যালো…”