- বইয়ের নামঃ উলঙ্গ রাজা
- লেখকের নামঃ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আগুনের দিকে
রাস্তাগুলি ক্রমে আরও তপ্ত হয়।
স্বজন, সঙ্গীর সংখ্যা
ক্রমে আরও কমে আসে।
হাতের মুদ্রায় তবু জাইয়ে রেখেছ বরাভয়
হাওয়ার ভিতরে তবু ভাসে
তোমার সৌরভ।
আর তাই
চতুর্দিকে ছত্রাকার ধড়মুণ্ড-আলাদা-করা শব
দেখেও আমাকে
এগিয়ে যেতেই হয়, আগুনের দিকে
এগিয়ে যেতেই হয়।
উলঙ্গ রাজা
সবাই দেখছে যে, রাজা উলঙ্গ, তবুও
সবাই হাততালি দিচ্ছে।
সবাই চেঁচিয়ে বলছে; শাবাশ, শাবাশ!
কারও মনে সংস্কার, কারও ভয়;
কেউ-বা নিজের বুদ্ধি অন্য মানুষের কাছে বন্ধক দিয়েছে;
কেউ-বা পরান্নভোজী, কেউ
কৃপাপ্রার্থী, উমেদার, প্রবঞ্চক;
কেউ ভাবছে, রাজবস্ত্র সত্যিই অতীব সূক্ষ্ম , চোখে
পড়ছে না যদিও, তবু আছে,
অন্তত থাকাটা কিছু অসম্ভব নয়।
গল্পটা সবাই জানে।
কিন্তু সেই গল্পের ভিতরে
শুধুই প্রশস্তিবাক্য-উচ্চারক কিছু
আপাদমস্তক ভিতু, ফন্দিবাজ অথবা নির্বোধ
স্তাবক ছিল না।
একটি শিশুও ছিল।
সত্যবাদী, সরল, সাহসী একটি শিশু।
নেমেছে গল্পের রাজা বাস্তবের প্রকাশ্য রাস্তায়।
আবার হাততালি উঠছে মুহুর্মুহু;
জমে উঠছে
স্তাবকবৃন্দের ভিড়।
কিন্তু সেই শিশুটিকে আমি
ভিড়ের ভিতরে আজ কোথাও দেখছি না।
শিশুটি কোথায় গেল? কেউ কি কোথাও তাকে কোনো
পাহাড়ের গোপন গুহায়
লুকিয়ে রেখেছে?
নাকি সে পাথর-ঘাস-মাটি নিয়ে খেলতে খেলতে
ঘুমিয়ে পড়েছে
কোনো দূর
নির্জন নদীর ধারে, কিংবা কোনো প্রান্তরের গাছের ছায়ায়?
যাও, তাকে যেমন করেই হোক
খুঁজে আনো।
সে এসে একবার এই উলঙ্গ রাজার সামনে
নির্ভয়ে দাঁড়াক।
সে এসে একবার এই হাততালির ঊর্ধ্বে গলা তুলে
জিজ্ঞাসা করুক:
রাজা, তোর কাপড় কোথায়?
কবিতা ‘৭০
এক-একটা কবিতা যেন সুতানুটি-গোবিন্দপুরের
রাত্রিকে ফিরিয়ে আনে।
এক-একটি কবিতা যেন অকস্মাৎ
টান্ মেরে হটিয়ে দেয় ময়দানের সবুজ গালিচা।
গঙ্গাসাগরের দিকে অগ্রসরমান যাত্রিবোঝাই নৌকাকে
এক-একটি কবিতা যেন রমনীর নখে, ওষ্ঠে, জঙ্ঘাদেশে, হাতের মুদ্রায়
বিষাক্ত ফুলের মতো ফোটে।
এক-একটি কবিতা যেন ঝড়ের ভিতরে হয়ে ওঠে
নিয়তির কণ্ঠস্বর।
কয়েকটা দিনের জন্য মফস্বল-বাংলায় সফর
সেরে নিয়ে
কবিতা আবার এই নগরের কেন্দ্রে ফিরে আসে।
দুলে ওঠে ঘর-দুয়ার।
যাদুঘর, রঙ্গালয়, ফুটবল-গ্যালারি, স্কাইস্ক্রেপারের পাশে
এক-একটি কবিতা গিয়ে হানা দেয়, আর
আতঙ্ক ঘনিয়ে ওঠে চারিধারে।
এক-একটি কবিতা গিয়ে ফেটে পড়ে চৌরঙ্গিপাড়ায়।
বৃক্ষেরা আমূল কাঁপে, ভয়ার্ত পাখিরা
ঝঁকে-ঝাঁকে
বিপন্ন আশ্রয় ছেড়ে রাত্রির আকাশে উড়ে যায়।
ভিতরে তাকাই, ভাবি
যা হলে সবাই খুব খুশি হত, যা হলে সমস্ত দিক রক্ষা পেত, আজ
কালবৈগুণ্যের ফলে
এক-একটি কবিতা যনে কিছুতেই তেমন হচ্ছে না।
বাহিরে তাকাই, দেখি
হলুদ-সবুজ-লাল হলুদ-সবুজ-লাল
ট্রাফিক-বাতির ত্রিনয়ন
জ্বলছে নিবছে জ্বলছে নিবছে। অথচ কোথাও
কোন যানবাহনের চিহ্ন নেই।
ফুটপাতে ভিখারি নেই। রাস্তাগুলি খাঁখাঁ করছে। প্রধান গির্জার
গা বেয়ে জ্যোৎস্নার ধারা নেমেছে ফুটপাথে।
তারই মধ্যে একদিকে নিরস্তর
ট্রাফিক-বাতির দণ্ড চৌমাথায় চোখ মারে। অন্য দিকে
বঙ্গোপসাগর থেকে হুহু করে ছুটে আসে হাওয়া;
মধ্যরাতে
আচমকা কাঁপিয়ে দেয় কলকাতার বুকের পাঁজর।
কলঘরে চিলের কান্না
এখনও তোমার সেই ডানা ঝাপটানোর শব্দ শুনতে পাই;
এখনও তোমার সেই দারুন বিলাপ
কানে বাজে।
গগণবিহারী চিল,
খর দীপ্র দুপুরবেলায়
তুমি এক আকাশের থেকে অন্য আকাশের দিকে
তেজস্বী ও স্বভাবত-সঙ্গিবিহীন সম্রাটের মত
সহজ উল্লাসে
বাতাসে সাঁতার কেটে চলেছিলে।
যেতে যেতে,
শূণ্যের মেখলা থেকে যে-রকম উল্কা খসে যায়,
তুমিও সহসা সেইরকম
ঊর্ধাকাশ থেকে এই গৃহস্থবাড়ির বারান্দায়
ছিটকে পড়েছিলে।
মুহূর্তে কাকের মেলা বসে গেল ছাতের কার্নিসে।
কা-কা-অট্টহাসির বিদ্রুপে
ভরে উঠল দ্বিপ্রহর।
তখনও মরোনি তুমি। দুই চক্ষু
ঘোলাটে ও ঘূর্ণমান, বাদামি শরীর
কেঁপে কেঁপে উঠছে, ফের আকাশে উঠবার
শক্তি নেই, তবু তুমি
শরীরের শেষ বিন্দু সামর্থ্য সংগ্রহ করে
প্রাণপণে ঝাপটাচ্ছ ডানা, কখনও-বা
বাঁকিয়ে উদ্ধত গ্রীবা
ঘৃণাভরে দেখে নিচ্ছ
অদূরে অপেমাণ শত্র“দের।
গগণবিহারী চিল! যারা ঊর্ধে উঠতে পারে না, আর
পারে না বলেই যারা
পৃথিবীর
ভাগাড়ে ও আস্তাকুড়ে কাপুরুষ মস্তানের মত
দঙ্গল পাকিয়ে ঘুরে বেড়ায়, তাদের
হাতে কি কখনও আমি ঊর্ধাচারী মানুষের
লাঞ্ছনা দেখিনি?
দেখেছি অসংখ্যবার। বুঝেছি যে, লাঞ্ছনাই স্বাভাবিক।
এমন কী, লাঞ্ছনা আর নিগ্রহের ফলে
মানুষের দীপ্তি ও মহিমা আরও বেড়ে যায়।
অথচ সমস্ত দেখে, সমস্ত বুঝেও- মূ্র্খ আমি-
দলবব্ধ কাকের গুন্ডামি থেকে
তোমাকে বাঁচাতে গিয়েছিলুম। তোমকে
বারান্দার থেকে তুলে এনে
স্নানঘরের মধ্যে আটকে রেখে
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ভাবতে পেরেছিলুম, তোমার
মর্যাদা বাঁচানো গেল।
এখন বুঝতে পারি, বস্তুত তোমাকে
এক বিদ্রুপের থেকে আরও ক্রুর, আরও ভয়ংকর
বিদ্রুপের ভিতরে নিক্ষেপ করেছিলুম সেদিন।
গগণবিহারী চিল,
বৈদুর্যমণির তীব্র দাহনে উজ্জ্বল খর দুপুর বেলায়
সম্রাটের মতো তুমি সমস্ত আকাশ ঘুরে এসে
তারপর
শহরতলির এক গৃহস্থের
ছয় বাই তিন ফুট ওই কলঘরের অন্ধকারে বন্দি হয়েছিলে।
সারারাত্রি ঝাপটা মেরেছ তুমি
কাঠের দরজায়,
নখরে আঁচড়েছ মেঝে, সারারাত
আপন সাম্রাজ্য থেকে নির্বাসিত, বিচ্যুত হবার
অপমানে, গ্লানিতে ও যন্ত্রণায়
চিৎকার করেছ।
অমন ধারালো, শুকনো, বুকফাটা আর্তনাদ আমি
কখনও শুনিনি।
এনে হয়েছিল, যেন পাখি নয়, বিশ্ব-চরাচর
আজ রাত্রে ওই
কলঘরের অন্ধকারে বন্দি হয়ে চিৎকার করছে।
গগনবিহারী চিল,
সকালে তোমাকে আমি মুক্তি দিব বলে
দরজা খুলে যখন দেখলুম,
মেঝের উপর তুমি স্থির ও নিঃশব্দ হয়ে পড়ে আছ,
তখন আবার মনে হয়েছিল,
তুমি পাখি নও, তুমি অফুরন্ত আকাশের প্রাণমূর্তি, যেন
সমস্ত আকাশ আজ
নিতান্ত ছাপোষা এক গৃহস্থের
কলঘরের
ক্লিন্ন অন্ধকারে
মরে পড়ে আছে।
১৯ ফাল্গুন, ১৩৭৬