Site icon BnBoi.Com

আর রঙ্গ – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

আর রঙ্গ - নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

নিশান

মাঝে-মাঝে একটু জিরিয়ে নিতে হয়।
ঘুরে-দাঁড়িয়ে মাঝে-মাঝে একবার
দেখতে হয়
পিছনের মানুষজন, ঘরবাড়ি আর
খেতখামার।

মাঝে-মাঝে ভাবতে হয়
এই যে আমি পাথরের ধাপে
পা রেখে-রেখে
পাহাড়-চূড়ার ওই দেবালয়ের দিকে উঠে যাচ্ছি,
এর কি কোনও দরকার ছিল?

আমার মুঠোর মধ্যে খুব শক্ত করে আমি
ধরে রেখেছি সেই নিশান,
পাথরে পা রেখে-রেখে উপরে উঠে গিয়ে
মন্দিরের ওই চূড়ার যা আমি
উড়িয়ে দেব।

কিন্তু ঘুরে দাঁড়িয়ে এখন আমি
পাহাড়তলির
ঘরবাড়ি দেখছি,
খেতখামার দেখছি,
আর দেখছি মানুষজনের মেলা।

ঘুরে দাঁড়াবার এই হচ্ছে বিপদ।
মনে হচ্ছে,
কোথাও কিছু ভুল হয়ে গেল।
মানুষের ওই মেলার মধ্যেই এই
নিশানটা আমি রেখে আসতে পারতুম।

ভরদুপুরে

হরেক রাস্তা ঘুরতে-ঘুরতে
ভরদুপুরে পুড়তে-পুড়তে
কোথার থেকে কোথায় যাওয়া।

আকাশ থেকে জলের ঝাড়ি
হয়নি উপুড়, গুমোট ভারী,
কোত্থাও নেই কিচ্ছু হাওয়া।

এই, তোরা সব চুপ কেন রে?
আয় না হাসিঠাট্টা করে
পথের কষ্ট খানিক ভুলি।

কেউ হাসে না। ভরদুপুরে
আমরা দেখি আকাশ জুড়ে
উড়ছে সাদা পায়রাগুলি।

মানচিত্র

একদিন যাতে তছনছ করে দেওয়া হয়েছিল,
ছেঁড়া ফাটা সেই মানচিত্রগুলিকে
এখন আবার
একটু-একটু করে জোড়া লাগানো হচ্ছে।
উঠে যাচ্ছে কাঁটাতারের বেড়া,
ধরে পড়ছে দেওয়াল
তার ইটের টুকরো এখন
কিউরিও-শপে সওদা করা যায়।
চেকপোস্টের খুপরি-ঘরে ঝাঁপ ফেলে দিয়ে
উর্দি-পরা লোকজনেরা
অনেক আগেই যে যার বাড়ি চলে গেছে।

একদিন যা সীমান্ত বলে চিহ্নিত ছিল, সেখানে কোনও
রক্তচক্ষু এখন আর দপদপ করে না।
কোথাও কোনো বাধা নেই।
মানুষগুলি ইচ্ছেমতো এদিক থেকে ওদিকে যাচ্ছে, আর
ওদিক থেকে আসছে এদিকে।
তারা জেনে গেছে যে,
মানচিত্রকে ভেঙে ফেলার খেলা আর কেউ
জমাতে পারবে না। যা
ভাঙা হয়েছিল, নতুন করে এখন আবার তাকে
জোড়া লাগাবার দিন।

২৪ ভাদ্র, ১৩৯৭

মেলার মাঠে

হাতখানা যার শক্ত করে
আঁকড়ে ধরে রেখেছিলাম,
হঠাৎ কখন ছিটকে গিয়ে
এই মাঠে সে হারিয়ে গেছে!

এখন তাকে খুঁজব কোথায়!
কোত্থেকে যে কোন্‌খানে যায়
নিরুদ্দিষ্ট লোকজনেরা
ভিড়ের মধ্যে ভাসতে-ভাসতে।

হাসতে-হাসতে যাচ্ছে সবাই,
কেউ কিনেছে বেলুন-চাকি,
কেউ ঝুড়ি, কেউ কাঁসার বাসন,
কেউ নিতান্ত কাঠের পাখি।

সকাল থেকেই মেঘলা আকাশ,
বৃষ্টি পড়ছে ছিপছিপিয়ে।
শুকনো যে খাল, হয়তো তাতেও
একগলা জল দাঁড়িয়ে গেছে।

মেলায় তবু প্রচণ্ড ভিড়,
পিছল পথে যায় না হাঁটা,
হাজার দোকান, অজস্র লোক,
খুব জমেছে বিক্রিবাটা।

তার ভিতরেই বন্‌বনাবন্‌
নাগরদোলা ঘুরছে ভীষণ,
তার ভিতরেই আর-এক-কোণে
যুদ্ধ চলছে রাম-রাবণে।

মুড়কি, মুড়ি, তিলেখাজা,
কদ্‌মা এবং পাঁপড়ভাজা,
তার ভিতরেই অনেকটা পথ
এতক্ষণ সে ছাড়িয়ে গেছে।

অথচ খুব শক্ত করে
হাতখানা তার ধরে ছিলাম,
তবুও সে এই মেলার মাঠে
হঠাৎ কখন হারিয়ে গেছে।

যাবেন না

কখন যে একদল মানুষ আমাকে ঘিরে ফেলেছে,
তা আমি বুঝতে পারিনি।
হাত ধরে যিনি আমাকে আজ এই হাটের মধ্যে এনে
ছেড়ে দিয়েছিলেন,
চোখের পলক ফেলতে-না-ফেলতেই তিনি
ভ্যানিশ।
বুঝতে পারছিলুম যে, আমারও এখন
সরে পড়া দরকার। কিন্তু
মানুষের বলয়ের বাইরে যেই আমি আমার
পা পাড়িয়েছি, অমনি
কেউ একজন বলে উঠল, ‘যাবেন না।’

যাবেন না, যাবেন না, যাবেন না!
হাটের ধারেই
বিশাল বটগাছ।
জোলো হাওয়ায়
গা ভাসিয়ে সে তার
পাতার ঝাঁঝর বাজাচ্ছে তো বাজিয়েই যাচ্ছে।
দুপুরবেলায় খুব বৃষ্টি হয়েছিল,
বিকেলে তাই
যেমন লোকজন, তেমন দেখছি চারপাশের
গাছপালা, খেতখামার আর
বাড়িঘরগুলোর চেহারাও এখন একটু
অন্যরকম।
ছেঁড়া-ছেঁড়া মেঘগুলোও তাদের ভোল ইতিমধ্যে
পালটে ফেলেছে।

বোঝা যাচ্ছে, আজ আর বৃষ্টি হবে না।
গা ধুয়ে নিয়ে
প্রকৃতি এখন একেবারে পটের বিবির মতো
আপাদমস্তক ফিটফাট্‌।
যেন ছবিটাকে সম্পূর্ণ করে তুলবার জন্যেই
খানি কাগে
আকাশ থেকে সেই আলোর ধারা নেমে এসেছে,
যে-আলোয় শুধু বিয়ের কনে নয়,
যে-কোনও মানুষকেই ভারী
সুন্দর দেখায়।

আমার চোখে আর পলক পড়ছে না। আমি
দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি। আর
তারই মধ্যে
চতুর্দিকে ধ্বনিত হচ্ছে সেই মন্ত্র,
যে-মন্ত্র একমাত্র মানুষই উচ্চারণ করতে পারে।
যাবেন, যাবেন না, যাবেন না!

Exit mobile version