আল্লা-তত্ত্ব জেনেছ কি, যিনি সর্বশক্তিমান?
শক্তি পেল না জীবনে যে জন, সে নহে মুসলমান!
ইমান! ইমান! বলো রাতদিন, ইমান কি এত সোজা?
ইমানদার হইয়া কি কেহ বহে শয়তানি বোঝা?
শোনো মিথ্যুক! এই দুনিয়ায় পূর্ণ যার ইমান,
শক্তিধর সে টলাইতে পারে ইঙ্গিতে আশমান!
আল্লার নাম লইয়াছ শুধু, বোঝোনিকো আল্লারে।
নিজ যে অন্ধ সে কি অন্যেরে আলোকে লইতে পারে?
নিজে যে স্বাধীন হইল না সে স্বাধীনতা দেবে কাকে?
মধু দেবে সে কি মানুষ, যাহার মধু নাই মৌচাকে?
কোথা সে শক্তি-সিদ্ধ ইমাম, প্রতি পদাঘাতে যার
আবে-জমজম শক্তি-উৎস বাহিরায় অনিবার?
আপনি শক্তি লভেনি যে জন, হায় সে শক্তিহীন
হয়েছে ইমাম, তাহারই খোৎবা শুনিতেছি নিশিদিন!
দীন কাঙালের ঘরে ঘরে আজ দেবে যে নব তাকিদ
কোথা সে মহান শক্তি-সাধক আনিবে যে পুন ঈদ?
ছিনিয়া আনিবে আশমান থেকে ঈদের চাঁদের হাসি
ফুরাবে না কভু যে হাসি জীবনে, কখনও হবে না বাসি!
সমাধির মাঝে গণিতেছি দিন, আসিবেন তিনি কবে?
রোজা এফতার করিব সকলে, সেই দিন ঈদ হবে।
কেন জাগাইলি তোরা
কেন ডাক দিলি আমারে অকালে কেন জাগাইলি তোরা?
এখনও অরুণ হয়নি উদয়, তিমিররাত্রি ঘোরা!
কেন জাগাইলি তোরা?
যে আশ্বাসের বাণী শুনাইয়া পড়েছিনু ঘুমাইয়া
বনস্পতি হইয়া সে বীজ পড়েনি কি ছড়াইয়া–
দিগদিগন্তে প্রসারিয়া শাখা? বাঁধেনি সেথায় নীড়,
প্রাণ-চঞ্চল বিহগের দল করেনি সেথায় ভিড়?
যেখানে ছিল রে যত বন্ধন যত বাধা ভয় ভীতি
সেখানে তোদেরে লইয়া যে আমি আঘাত হেনেছি নিতি।
ভাঙিতে পারিনি, খুলিতে পারিনি দুয়ার, তবুও জানি–
সেই জড়ত্ব-ভরা কারাগারে ভীষণ আঘাত হানি–
ভিত্তি তাহার টলায়ে দিয়েছি, – আশা ছিল মোর মনে
অনাগত তোরা ভাঙিবি তাহারে সে কোন শুভক্ষণে॥
মহা সমাধির দিকহারা লোকে জানি না কোথায় ছিনু
আমারে খুঁজিতে সহসা সে কোন শক্তিরে পরশিনু –
সেই সে পরম শক্তিরে লয়ে আসিবার ছিল সাধ –
যে শক্তি লভি এল দুনিয়ায় প্রথম ঈদের চাঁদ –
তারই মাঝে কেন ঢাক-ঢোল লয়ে এলি সমাধির পাশে
ভাঙাইলি ঘুম? চাঁদ যে এখনও ওঠেনি নীল আকাশে।
ওরে তোরা থাম! শক্তি কাহারও নহে রে ইচ্ছাধীন –
রাত না পোহাতে চিৎকার করি আনিবি কি তোরা দিন?
এতদিন মার খেয়েছিস তোরা – তবুও আছিস বেঁচে,
মারের যাতনা ভুলিবি কি তায় ঢাক-ঢোল নিয়ে নেচে?
সূর্য-উদয় দেখেছিস কেউ – শান্ত প্রভাত বেলা?
উদার নীরব উদয় তাহার – নাই মাতামাতি খেলা;
তত শান্ত সে – যত সে তাহার বিপুল অভ্যুদয়,
তত সে পরম মৌনী যত সে পেয়েছে পরম অভয়!
দিকহারা ওই আকাশের পানে দেখ দেখ তোরা চেয়ে,
কেমন শান্ত ধ্রুব হয়ে আছে কোটি গ্রহ তারা পেয়ে।
ওই আকাশের প্রসাদে যে তোরা পাস বৃষ্টির জল
ওই আকাশেই ওঠে ধ্রুবতারা ভাস্কর নির্মল।
ওই আকাশেই ঝড় ওঠে – তবু শান্ত সে চিরদিন–
ওই আকাশের বুক চিরে আসে – বজ্র কুন্ঠাহীন!
ওই আকাশেই তকবির ওঠে – মহা আজানের ধ্বনি
ওই আকাশের পারে বাজে চির অভয়ের খঞ্জনি।
জানি ওরে মোর প্রিয়তম সখা বন্ধু তরুণ দল
তোদেরই ডাকে যে আসন আমার টলিতেছে টলমল!
তোদেরই ডাকে যে নামিছে পরম শক্তি, পরম জ্যোতি,
পরমামৃতে পূর্ণ হইবে মহাশূন্যের ক্ষতি।
‘মাহে রমজান’ এসেছে যখন, আসিবে ‘শবে কদর’,
নামিবে তাঁহার রহমত এই ধূলির ধরার পর।
এই উপবাসী আত্মা – এই যে উপবাসী জনগণ,
চিরকাল রোজা রাখিবে না – আসে শুভ ‘এফতার’ ক্ষণ!
আমি দেখিয়াছি – আসিছে তোদের উৎসব-ঈদ-চাঁদ, –
ওরে উপবাসী ডাক তাঁরে ডাক, তাঁর নাম লয়ে কাঁদ।
আমি নয় ওরে আমি নয় – ‘তিনি’ যদি চান ওরে তবে
সূর্য উঠিবে, আমার সহিত সবার প্রভাত হবে।
চাঁদিনি রাতে
কোদালে মেঘের মউজ উঠেছে গগনের নীল গাঙে,
হাবুডুবু খায় তারা-বুদ্বুদ, জোছনা সোনায় রাঙে।
তৃতীয়া চাঁদের ‘সাম্পানে’ চড়ি চলিছে আকাশ-প্রিয়া,
আকাশ-দরিয়া উতলা হল গো পুতলায় বুকে নিয়া।
নীলিম-প্রিয়ার নীলা গুল-রুখ নাজুক নেকাবে ঢাকা
দেখা যায় ওই নতুন চাঁদের কালোতে আবছা আঁকা।
সপ্তর্ষির তারা-পালঙ্কে ঘুমায় আকাশ-রানি,
‘লায়লা’-সেহেলি দিয়ে গেছে চুপে কুহেলি-মশারি টানি।
নীহার-নেটের ঝাপসা মশারি, যেন ‘বর্ডার’ তারই
দিক্-চক্রের ছায়া-ঘন ওই সবুজ তরুর সারি।
সাতাশ-তারার ফুল-তোড় হাতে আকাশে নিশুতি রাতে
গোপনে আসিয়া তারা-পালঙ্কে শুইল প্রিয়ার সাথে।
‘উঁহু উঁহু’ করি কাঁচা ঘুম হতে জেগে ওঠে নীলা হুরি,
লুকায়ে দেখে তা ‘চোখ গেল’ বলে হাসিছে পাপিয়া ছুঁড়ি।
‘মঙ্গল’ তারা মঙ্গল-দীপ জ্বালিয়া প্র্রহর জাগে,
ঝিকিমিকি করে মাঝে মাঝে, বুঝি বধূর নিশাস লাগে।
উল্কা-জ্বালার সন্ধানী আলো লইয়া আকাশ-দ্বারী
‘কাল-পুরুষ’ সে জাগি বিনিদ্র করে ফেরে পায়চারি।
সেহেলিরা রাতে পালায়ে এসেছে উপবনে কোন আশে,
‘হেথা হোথা ছোটে, পিকের কন্ঠে ফিক ফিক করে হাসে।
আবেগে সোহাগে আকাশ-প্রিয়ার চিবুক বাহিয়া ও কি
শিশিরের রূপে ঘর্মবিন্দু ঝরে ঝরে পড়ে, সখী!
নবমী চাঁদের ‘সংসারে’ ও কে গো চাঁদিনি-শিরাজি ঢালি
বধূর অধরে ধরিয়া কহিছে, ‘তহুরা পিয়ো লো আলি!’
কার কথা ভেবে তারা-মজলিসে দূরে একাকিনী সাকি
চাঁদের সংসারে কলঙ্ক-ফুল আনমনে যায় আঁকি!