তোর গো-রাখা রাখালের হাতে বাঁশের বাঁশি কই?
তোর খালের ঘাটে পাট পচে ভাই পাহাড়-প্রমাণ হয়ে,
তোর মাঠের ধানে সোনা রং-এর বান যেন যায় বয়ে,
সে পাট ওঠে কোন লাটে?
সে ধান ওঠে কোন হাটে?
উঠানে তোর শূন্য মরাই মরার মতন পড়ে–
স্বামীহারা কন্যা যেন কাঁদছে বাপের ঘরে।
তোর গাঁয়ের মাঠে রবি-ফসলছবির মতন লাগে,
তোর ছাওয়াল কেন খাওয়ার বেলা নুন লঙ্কা মাগে?
তোর
তরকারিতেও সরকারি কোন ট্যাক্স বুঝি বসে!
তোর ইক্ষু এত মিষ্টি কি হয় চক্ষুজলের রসে?
তোর গাইগুলোকে নিঙড়ে কারা দুধ খেয়েছে ভাই?
তোর দুধের ভাঁড়ে ভাতের মাড়ের ফেন – হায়, তাও নাই!
তোর ছোটো খোকার জুড়িয়েছে জ্বর ঘুমিয়ে গোরস্তানে,
সে দিদির আঁচল ধরে বুঝি গোরের পানে টানে।
বিকার-ঘোরে দিদি তাহার ডাকছে ছোটো ভায়ে,
দুধের বদল ঝিনুক দিয়ে আমানি দেয় মায়ে।
কবর দিয়ে সবর করে লাঙল নিয়ে কাঁধে,
মাঠের কাদাপথে যেতে আব্বা তাহার কাঁদে।
চারদিকে তার মাঠ-ভরা ধান আকাশ-ভরা খুশি,
লাল হয়েছে দিগন্ত আজ চাষার রক্ত শুষি!
মাঠে মাঠে ধান থই থই, পণ্যে ভরা হাট,
ঘাটে ঘাটে নৌকা-বোঝাই তারই মাঠের পাট।
কে খায় এই মাঠের ফসল, কোন সে পঙ্গপাল?
আনন্দের এই হাটে কেন তাহার হাড়ির হাল?
কেন তাহার ঘরের খোকা গোরের বুকে যায়?
গোঠে গোঠে চরে ধেনু, দুধ নাহি সে পায়!
ওরে চাষা! বাঁচার আশা গেছে অনেক আগে
গোরের পাশের ঘরে কাঁদা আজও ভালো লাগে?
জাগে না কি শুকনো হাড়ে বজ্র-জ্বালা তোর?
চোখ বুজে তুই দেখবি রে আর, করবে চুরি চোর?
বাঁশের লাঠি পাঁচনি তোর, তাও কি হাতে নাই?
না থাক তোর দেহে রক্ত, হাড় কটা তোর চাই।
তোর হাঁড়ির ভাতে দিনে রাতে যে দস্যু দেয় হাত,
তোর রক্ত শুষে হল বণিক, হল ধনীর জাত
তাদের হাড়ে ঘুণ ধরাবে তোদেরই এই হাড়
তোর পাঁজরার ওই হাড় হবে ভাই যুদ্ধের তলোয়ার।
তোরই মাঠে পানি দিতে আল্লাজি দেন মেঘ,
তোরই গাছে ফুল ফোটাতে দেন বাতাসের বেগ,
তোরই ফসল ফলাতে ভাই চন্দ্র সূর্য উঠে,
আল্লার সেই দান আজি কি দানব খাবে লুটে?
তেমনি আকাশ ফর্সা আছে, ভরসা শুধু নাই,
তেমনি খোদার রহম ঝরে, আমরা নাহি পাই।
হাত তুলে তুই চা দেখি ভাই, অমনি পাবি বল,
তোর ধানে তোর ভরবে খামার নড়বে খোদার কল!
কিশোর রবি
হে চিরকিশোর কবি রবীন্দ্র, কোন রসলোক হতে
আনন্দ-বেণু হাতে লয়ে এলে খেলিতে ধূলির পথে?
কোন সে রাখাল রাজার লক্ষ ধেনু তুমি চুরি করে
বিলাইয়া দিলে রস-তৃষাতুরা পৃথিবীর ঘরে ঘরে।
কত যে কথায় কাহিনিতে গানে সুরে কবিতায় তব
সেই আনন্দ-গোলোকের ধেনু রূপ নিল অভিনব।
ভুলাইলে জরা, ভুলালে মৃত্যু, অসুন্দরের ভয়
শিখালে পরম সুন্দর চিরকিশোর সে প্রেমময়।
নিত্য কিশোর আত্মার তুমি অন্ধ বিবর হতে
হে অভয়দাতা টানিয়া আনিলে দিব্য আলোর পথে।
তোমার এ রস পান করিবার অধিকার পেল যারা
তারাই কিশোর, তোমাতে দেখেছে নিত্য কিশোরে তারা
ওগো ও পরম কিশোরের সখা, জানি তুমি দিতে পার
নিত্য অভয়, অনন্ত শ্রী, দিব্য শক্তি আরও।
কোথা সে কৃপণ বিধাতার মধু-রসভাণ্ডার আছে
তুমি জান তাহা, তাহার গোপন চাবি আছে তব কাছে।
ওগো ও পরম শক্তিমানের জ্যোতির্দীপ্ত রবি
সেই বিধাতার ভাণ্ডার লুটে দিয়ে যাও হেথা সবই।
যারা জড়, যারা নুড়ির মতন নিত্য রসপ্রবাহে
ডুবিয়া থেকেও পাইল না রস, তারা তব কৃপা চাহে।
এই ক্ষুধাতুর, উপবাসী চির-নিপীড়িত জনগণে
ক্লৈব্য-ভীতির গুহা হতে আনো আনন্দ-নন্দনে।
ঊর্ধ্বের যারা তাহারা পাইল তোমার পরম দান
নিম্নের যারা, তাদের এবার করো গো পরিত্রাণ।
মরে আছে যারা তারা আজ তব অমৃত নাহি পায়
তোমার রুদ্র আঘাতে এদের ঘুম যেন টুটে যায়।
শুধু বেণু আর বীণা লয়ে তুমি আস নাই ধরা পরে
দেখেছি শঙ্খ চক্র বিষাণ বজ্র তোমার করে।
ওগো ও পরম রুদ্র কিশোর! তোমার যাবার আগে
নির্জিত নিদ্রিত এ ভারত যেন গো বহ্নিরাগে
রঞ্জিত হয়ে ওঠে! অসুরের ভীতি যেন চলে যায়।
ওগো সংহার-সুন্দর, পরো প্রলয়-নূপুর পায়!
তোমার যে মহাশক্তি কেবল জ্ঞান-বিলাসীর ঘরে
অনন্ত রূপে রসে আনন্দে নিত্য পড়িছে ঝরে,
গৃহহীন অগণন ভিক্ষুক ক্ষুধাতুর তব দ্বারে
ভিক্ষা চাহিছে, দয়া করো দয়া করো বলি বারে বারে।
বিলাসীর তরে দিয়াছ অনেক, হে কিশোর-সুন্দর,
এবার পঙ্গু-অঙ্গে পরশ করুক তোমার কর।
জানি জানি তব দক্ষিণ করে অনন্ত শ্রী আছে,
দক্ষিণা দাও বলে তাই ওরা এসেছে তোমার কাছে।
হে রবি, তোমারে নারায়ণরূপে এ ভারত পূজা করে,
যাইবার আগে, জাগাইয়া তুমি যাও সেই রূপ ধরে।
দৈত্য-মুক্ত ব্রজের রাখাল কিশোরেরা ভয়হীন,
খেলুক সর্ব-অভাবমুক্ত হয়ে ব্রজে নিশিদিন।
হউক শান্তিনিকেতন এই অশান্তিময় ধরা,
চিরতরে দূর হোক তব বরে নিরাশা-ক্লৈব্য-জরা।
কৃষকের ঈদ
বেলাল! বেলাল! হেলাল উঠেছে পশ্চিমে আশমানে,
লুকাইয়া আছ লজ্জায় কোন মরুর গোরস্তানে!
হেরো ঈদ্গাহে চলিছে কৃষক যেন প্রেত-কঙ্কাল
কশাইখানায় যাইতে দেখেছ শীর্ণ গোরুর পাল?
রোজা এফতার করেছে কৃষক অশ্রু-সলিলে হায়,
বেলাল! তোমার কন্ঠে বুঝি গো আজান থামিয়া যায়!
থালা ঘটি বাটি বাঁধা দিয়ে হেরো চলিয়াছে ঈদ্গাহে,
তির-খাওয়া বুক, ঋণে-বাঁধা-শির, লুটাতে খোদার রাহে।
জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ
মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?
একটি বিন্দু দুধ নাহি পেয়ে যে খোকা মরিল তার
উঠেছে ঈদের চাঁদ হয়ে কি সে শিশু-পাঁজরের হাড়?
আশমান-জোড়া কাল কাফনের আবরণ যেন টুটে
এক ফালি চাঁদ ফুটে আছে, মৃত শিশুর অধর-পুটে।
কৃষকের ঈদ! ঈদ্গাহে চলে জানাজা পড়িতে তার,
যত তকবির শোনে, বুকে তার তত উঠে হাহাকার!
মরিয়াছে খোকা, কন্যা মরিছে, মৃত্যু-বন্যা আসে
এজিদের সেনা ঘুরিছে মক্কা-মসজিদে আশেপাশে।
কোথায় ইমাম? কোন সে খোৎবা পড়িবে আজিকে ঈদে?
চারিদিকে তব মুর্দার লাশ, তারই মাঝে চোখে বিঁধে
জরির পোশাকে শরীর ঢাকিয়া ধনীরা এসেছে সেথা,
এই ঈদ্গাহে তুমি কি ইমাম, তুমি কি এদেরই নেতা?
নিঙাড়ি কোরান হাদিস ও ফেকা, এই মৃতদের মুখে
অমৃত কখনও দিয়াছ কি তুমি? হাত দিয়ে বলো বুকে।
নামাজ পড়েছ, পড়েছ কোরান, রোজাও রেখেছ জানি,
হায় তোতাপাখি! শক্তি দিতে কি পেরেছ একটুখানি?
ফল বহিয়াছ, পাওনিকো রস, হায় রে ফলের ঝুড়ি,
লক্ষ বছর ঝরনায় ডুবে রস পায় নাকো নুড়ি!