আমি ছিনু পথ – ভিখারিনি, তুমি কেন পথ ভুলাইলে,
মুসাফিরখানা ভুলায়ে আনিলে কোন এই মঞ্জিলে?
মঞ্জিলে এনে দেখাইলে কার অপরূপ তসবির,
‘তসবি’তে জপি যত তাঁর নাম তত ঝরে আঁখি-নীর!
‘তশবিহি’ রূপ এই যদি তাঁর, ‘তনজিহি’ কীবা হয়,
নামে যাঁর এত মধু ঝরে, তাঁর রূপ কত মধুময়।
কোটি তারকার কীলক-রুদ্ধ অম্বর-দ্বার খুলে
মনে হয় তার স্বর্ণ-জ্যোতি দুলে উঠে কুতুহলে।
ঘুম-নাহি-আসা নিঝঝুম নিশি-পবনের নিশ্বাসে
ফিরদৌস-আলা হতে যেন লাল ফুলের সুরভি আসে।
চামেলি জুঁই-এর পাখায় কে যেন শিয়রে বাতাস করে,
শ্রান্তি ভুলাতে কী যেন পিয়ায় চম্পা-পেয়ালা ভরে।
শিস দেয় দধিয়াল বুলবুলি, চমকিয়া উঠি আমি,
ইঙ্গিতে বুঝি কামিনী-কুঞ্জে ডাকিলেন মোর স্বামী।
নহরের পানি লোনা হয়ে যায় আমার অশ্রুজলে,
তসবির তাঁর জড়াইয়া ধরি বক্ষের অঞ্চলে!
সাকি গো! শারাব দাও, যদি মোর খারাব করিলে দীন,
‘আল-ওদুদের’ পিয়ালার দৌর চলুক বিরাম-হীন।
গেল জাতি কুল শরম ভরম যদি এসে এই পথে
চালাও শিরাজি, যেন নাহি জাগি আর এ বে-খুদী হতে
দূর গিরি হতে কে ডাকে, ওকি মোর কোহ-ই-তুর-ধারী?
আমারই মতো কি ওরই ডাকে মুসা হল মরু-পথচারী?
উহারই পরম রূপ দেখে ইশা হল না কি সংসারী?
মদিনা-মোহন আহমদ ওরই লাগি কি চির-ভিখারি?
লাখো আউলিয়া দেউলিয়া হল যাহার কাবা দেউলে,
কত রূপবতী যুবতি যাহার লাগি কালি দিল কুলে,
কেন সেই বহু-বিলাসীর প্রেমে, সাকি, মোরে মজাইলি,
প্রেম-নহরের কওসর বলে আমারে জহর দিলি?
জান সাকি, কাল মাটির পৃথিবী এসেছিল মোর কাছে,
আমি শুধালাম, মোর প্রিয়তম, সে কি পৃথিবীতে আছে?
‘খাক’ বলিল, না, জানি না তো আমি,‘আব’ বুঝি তাহা জানে
জলেরে পুছিনু, তুমি কি দেখেছ মোর বঁধু কোনখানে?
আমার বুকের তসবির দেখে জল করে টলমল,
জল বলে, আমি এরই লাগি কাঁদি গলিয়া হয়েছি জল।
আগুন হয়তো তেজ দিয়া এরে বক্ষে রেখেছে ঘিরে,
সূর্যের ঘরে প্রবেশিনু আমি তেজ-আবরণ ছিঁড়ে।
হেরিনু সূর্য সাত-ঘোড়া নিয়ে সাত আশমানে ছুটে,
সহসা বঁধুর তসবির হেরে আমার বক্ষ-পুটে।
বলিল, কোথায় দেখেছ ইহারে, হইয়াছে পরিচয়?
ইহারই প্রেমের আগুনে জ্বলিয়া তনু হল মোর ক্ষয়।
যুগযুগান্ত গেল কত তবু মিটিল না এই জ্বালা।
ইহারই প্রেমের জ্বালা মোর বুকে জ্বলে হয়ে তেজোমালা।
যেতে যেতে পথে দেখিনু বাতাস দীরঘ নিশাস ফেলি
খুঁজিতেছে কারে আকাশ জুড়িয়া নীল অঞ্চল মেলি।
মোর বুকে দেখে তসবির এল ছুটিয়া ঝড়ের বেগে,
বলে – অনন্ত কাল ছুটে ফিরি দিকে দিকে এরই লেগে।
খুঁজিয়া স্থূল ও সূক্ষ্ম জগতে পাইনি ইহার দিশা,
তুমি কোথা পেলে আমার প্রিয়ের এই তসবির-শিশা?
হাসিয়া উঠিনু ব্যোম-পথে, সেথা কেবল শব্দ ওঠে
অলখ-বাণীর পারাবারে যেন শত শতদল ফোটে।
আমি কহিলাম, দেখেছ ইহারে হে অলক্ষ্য বাণী?
বাণীর সাগর কত অনন্ত হল যেন কানাকানি!
‘নাহি জানি নাহি জানি’ বলে ওঠে অনন্ত ক্রন্দন,
বলে, হে বন্ধু, জানিলে টুটিত বাণীর এ বন্ধন।–
জ্যোতির মোতির মালা গলে দিয়া সহসা স্বর্ণরথে
কে যেন হাসিয়া ছুঁইয়া আমারে পলাল অলখ-পথে।
‘ও কি জৈতুনি রওগন, ওরই পারে জলপাই-বনে
আমার পরম-একাকী বন্ধু খেলে কি গো নিরজনে?’
শুধানু তাহারে ; নিষ্ঠুর মোর দিল নাকো উত্তর?
জাগিয়া দেখিনু, অঙ্গ আবেশে কাঁপিতেছে থরথর!…
জোহরা-সেতারা উঠেছে কি পুবে? জেগে উঠেছে কি পাখি?
সুরার সুরাহি ভেঙে ফেলো সাকি, আর নিশি নাই বাকি।
আসিবে এবার আমার পরম বন্ধুর বোররাক
ওই শোনো পুব-তোরণে তাহার রঙিন নীরব ডাক!
ঈদের চাঁদ
সিঁড়ি-ওয়ালাদের দুয়ারে এসেছে আজ
চাষা মজুর ও বিড়িওয়ালা;
মোদের হিস্সা আদায় করিতে ঈদে
দিল হুকুম আল্লাতালা!
দ্বার খোলো সাততলা-বাড়িওয়ালা, দেখো কারা দান চাহে,
মোদের প্রাপ্য নাহি দিলে যেতে নাহি দেব ঈদ্গাহে!
আনিয়াছে নবযুগের বারতা নতুন ঈদের চাঁদ,
শুনেছি খোদার হুকুম, ভাঙিয়া গিয়াছে ভয়ের বাঁধ।
মৃত্যু মোদের ইমাম সারথি, নাই মরণের ভয়;
মৃত্যুর সাথে দোস্তি হয়েছে – অভিনব পরিচয়।
যে ইসরাফিল প্রলয়-শিঙ্গা বাজাবেন কেয়ামতে–
তাঁরই ললাটের চাঁদ আসিয়াছে, আলো দেখাইতে পথে।
মৃত্যু মোদের অগ্রনায়ক, এসেছে নতুন ঈদ,
ফিরদৌসের দরজা খুলিব আমরা হয়ে শহিদ।
আমাদের ঘিরে চলে বাংলার সেনারা নৌজোয়ান,
জানি না, তাহারা হিন্দু কি ক্রিশ্চান কি মুসলমান।
নির্যাতিতের জাতি নাই, জানি মোরা মজলুম ভাই –
জুলুমের জিন্দানে জনগণে আজাদ করিতে চাই!
এক আল্লার সৃষ্ট সবাই, এক সেই বিচারক,
তাঁর সে লীলার বিচার করিবে কোন ধার্মিক বক?
বকিতে দিব না বকাসুরে আর, ঠাসিয়া ধরিব টুঁটি
এই ভেদ-জ্ঞানে হারায়েছি মোরা ক্ষুধার অন্ন রুটি।
মোরা শুধু জানি, যার ঘরে ধনরত্ন জমানো আছে,
ঈদ আসিয়াছে, জাকাত আদায় করিব তাদের কাছে।
এসেছি ডাকাত জাকাত লইতে, পেয়েছি তাঁর হুকুম,
কেন মোরা ক্ষুধা-তৃষ্ণায় মরিব, সহিব এই জুলুম?
যক্ষের মতো লক্ষ লক্ষ টাকা জমাইয়া যারা
খোদার সৃষ্ট কাঙালে জাকাত দেয় না, মরিবে তারা।
ইহা আমাদের ক্রোধ নহে, ইহা আল্লার অভিশাপ,
অর্থের নামে জমেছে তোমার ব্যাঙ্কে বিপুল পাপ।
তাঁরই ইচ্ছায় – ব্যাঙ্কের দিকে চেয়ো না – ঊর্ধ্বে চাহো,
ধরার ললাটে ঘনায় ঘোলাটে প্রলয়ের বারিবাহ!
আল্লার ঋণ শোধ করো, যদি বাঁচিবার থাকে সাধ ;
আমাদের বাঁকা ছুরি আঁকা দেখো আকাশে ঈদের চাঁদ!
তোমারে নাশিতে চাষার কাস্তে কী রূপ ধরেছে, দেখো,
চাঁদ নয়, ও যে তোমার গলার ফাঁদ! দেখে মনে রেখো!
প্রজারাই রোজ রোজা রাখিয়াছে, আজীবন উপবাসী,
তাহাদেরই তরে এই রহমত , ঈদের চাঁদের হাসি।
শুধু প্রজাদের জমায়েত হবে আজিকার ঈদ্গাহে,
কাহার সাধ্য, কোন ভোগী রাক্ষস সেথা যেতে চাহে?
ভেবো না ভিক্ষা চাহি মোরা, নহে শিক্ষা এ আল্লার,
মোরা প্রতিষ্ঠা করিতে এসেছি আল্লার অধিকার!
এসেছে ঈদের চাঁদ বরাভয় দিতে আমাদের ভয়ে,
আবার খালেদ এসেছে আকাশে বাঁকা তলোয়ার লয়ে!
কঙ্কালে আজ ঝলকে বজ্র, পাষাণের জাগরণ,
লাশে উল্লাস জেগেছে রুদ্র উদ্ধত যৌবন!
দারিদ্র্য-কারবালা-প্রান্তরে মরিয়াছি নিরবধি,
একটুকু কৃপা করনি, লইয়া টাকার ফোরাত নদী।
কত আসগর মরিয়াছে, জান, এই বাপ মা-র বুকে?
সকিনা মরেছে, তোমরা দখিনা বাতাস খেয়েছ সুখে!
শহিদ হয়েছে হোসেন, কাসেম, আসগর, আব্বাস,
মানুষ হইয়া আসিয়াছি মোরা তাঁদের দীর্ঘশ্বাস!
তোমরাও ফিরে এসেছ এজিদ সাথে লয়ে প্রেত-সেনা,
সেবারে ফিরিয়া গিয়াছিলে, জেনো, আজ আর ফিরিবে না।
এক আল্লার সৃষ্টিতে আর রহিবে না কোনো ভেদ,
তাঁর দান কৃপা কল্যাণে কেহ হবে না না-উম্মেদ !
ডাকাত এসেছে জাকাত লইতে, খোলো বাক্সের চাবি!
আমাদের নহে, আল্লার দেওয়া ইহা মানুষের দাবি!
বাঁচিবে না আর বেশিদিন রাক্ষস লোভী বর্বর,
টলেছে খোদার আসন টলেছে, আল্লাহু-আকবর!
সাত আশমান বিদারি আসিছে তাঁহার পূর্ণ ক্রোধ।
জালিমে মারিয়া করিবেন মজলুমের প্রাপ্য শোধ।
ওঠ রে চাষি
চাষি রে! তোর মুখে হাসি কই?