মোবারকবাদ
মোরা ফোটা ফুল, তোমরা মুকুল এসো গুল-মজলিশে
ঝরিবার আগে হেসে চলে যাব – তোমাদের সাথে মিশে।
মোরা কীটে-খাওয়া ফুলদল, তবু সাধ ছিল মনে কত–
সাজাইতে ওই মাটির দুনিয়া ফিরদৌসের মতো।
আমাদের সেই অপূর্ণ সাধ কিশোর-কিশোরী মিলে
পূর্ণ করিয়ো, বেহেশ্ত এনো দুনিয়ার মহফিলে।
মুসলিম হয়ে আল্লারে মোরা করিনিকো বিশ্বাস,
ইমান মোদের নষ্ট করেছে শয়তানি নিশ্বাস!
ভায়ে ভায়ে হানাহানি করিয়াছি, করিনি কিছুই ত্যাগ,
জীবনে মোদের জাগেনি কখনও বৃহতের অনুরাগ!
শহিদি-দর্জা চাহিনি আমরা, চাহিনি বীরের অসি,
চেয়েছি গোলামি, জাবর কেটেছি গোলামখানায় বসি।
তোমরা মুকুল, এই প্রার্থনা করো ফুটিবার আগে,
তোমাদের গায়ে যেন গোলামের ছোঁয়া জীবনে না লাগে।
গোলামের চেয়ে শহিদি-দর্জা অনেক ঊর্ধ্বে জেনো;
চাপরাশির ওই তকমার চেয়ে তলোয়ারে বড়ো মেনো!
আল্লার কাছে কখনও চেয়ো না ক্ষুদ্র জিনিস কিছু,
আল্লাহ্ ছাড়া কারও কাছে কভু শির করিয়ো না নিচু!
এক আল্লাহ্ ছাড়া কাহারও বান্দা হবে না, বলো,
দেখিবে তোমার প্রতাপে পৃথিবী করিতেছে টলমল!
আল্লারে বলো, ‘দুনিয়ায় যারা বড়ো, তার মতো করো,
কাহাকেও হাত ধরিতে দিয়ো না, তুমি শুধু হাত ধরো।’
এক আল্লারে ছাড়া পৃথিবীতে কোরো না কারেও ভয়
দেখিবে – অমনি প্রেমময় খোদা, ভয়ংকর সে নয়!
আল্লারে ভালোবাসিলে তিনিও ভালোবাসিবেন, দেখো!
দেখিবে সবাই তোমারে চাহিছে আল্লারে ধরে থেকো!
খোদার বাগিচা এই দুনিয়াতে তোমরা নব মুকুল,
একমাত্র সে আল্লাহ্ এই বাগিচার বুলবুল!
গোলামের ফুলদানিতে যদি এ মুকুলের ঠাঁই হয়,
আল্লার কৃপা-বঞ্চিত হব, পাব মোরা পরাজয়!
যে ছেলেমেয়ে এই দুনিয়ায় আজাদমুক্ত রহে,
তাহাদেরই শুধু এক আল্লার বান্দা ও বাঁদি কহে!
তারাই আনিবে জগতে আবার নতুন ঈদের চাঁদ,
তারাই ঘুচাবে দুনিয়ার যত দ্বন্দ্ব ও অবসাদ!
শুধু আরশের আতরদানিতে যাহাদের হয় ঠাঁই,
তোমাদের এই মহফিলে আমি সেই মুকুলেরে চাই!
সেই মুকুলেরা এসো মহফিলে, বসাও ফুলের হাট,
এই বাংলায় তোমরা আনিয়ো মুক্তির আরফাত।
শিখা
যৌবনের রাগ-রক্ত লেলিহান শিখা
জ্বলিয়া উঠিবে কবে ভারতে আবার
জড়তার ধূমপুঞ্জ বিদারণ করি
উদ্ভাসিয়া তমসার তিমির-শর্বরী?
কোথা সে অনাগত সাগ্নিক পুরোধা
নির্বাপিত-প্রায় এই যজ্ঞ হোমানলে
উচ্চারিয়া বেদমন্ত্র দানিবে আহুতি,
নব নব প্রাণের সমিধ কে জোগাবে সেথা?
হায় রে ভারত, হায় যৌবন তাহার
দাসত্ব করিতেছে অতীত জরার!
জরাগ্রস্ত বুদ্ধিজীবী বৃদ্ধ জরদ্গব
দেখায়ে গলিত-মাংস চাকুরির মোহ
যৌবনের টিকা-পরা তরুণের দলে
আনিয়াছে একেবারে ভাগাড়ে শ্মশানে।
যৌবনে বাহন করি পঙ্গু জরা আজি
হইয়াছে ভারতে জনগণপতি!
যে হাতে পাইত শোভা খর তরবারি
সেই তরুণের হাতে ভোট-ভিক্ষা-ঝুলি
বাঁধিয়া দিয়াছে হায়! – রাজনীতি ইহা!
পলায়ে এসেছি আমি লজ্জায় দু-হাতে
নয়ন ঢাকিয়া! যৌবনের এ লাঞ্ছনা
দেখিবার আগে কেন মৃত্যু হইল না?
যৌবনের আবরণে ভারতে কি তবে
ফিরিতেছে দলে দলে বৃদ্ধ-প্রাণ জরা?
নহিলে এ সিন্ধবাদ কেমন করিয়া
ফিরিতেছে যৌবনের স্কন্ধে চড়ি আজও?
অতীতের অর্থ ভূত, সেই অদ-ভুত
অতীত কি বর্তমানে এখনও শাসিবে?
এই ভূতগ্রস্ত জাতি জানি না কেমনে
স্বাধীন হইবে কভু, পাইবে স্বরাজ!
রে তরুণ, তোমারে হেরিয়া আমি কাঁদি!
অসম্ভবের পথে অভিযান যার
সুদূর ভবিষ্যতে দুর্মদ দুর্বার
সে আজি অতীতে পানে মেলিয়া নয়ন
কেবলই পিছনে চলে, নেতার আদেশে।
তলোয়ার হইয়াছে লাঙলের ফলা!
তোমাদেরই মাঝে আছে নেতা তোমাদের,
তোমাদেরই বুকে জাগে নিত্য ভগবান,
ভয়হীন, দ্বিধাহীন, মৃত্যুহীন তিনি!
তোমারে আধার করি সেই মহাশক্তি
প্রকাশিতে চান নিত্য, চাহো আঁখি খুলি
আপনার মাঝে দেখো আপন স্বরূপ!
অতীতের দাসত্ব ভোলো! বৃদ্ধ সাবধানী
হইতে পারে না কভু তোমাদের নেতা।
তোমাদেরই মাঝে আছে বীর সব্যসাচী
আমি শুনিয়াছি বন্ধু সেই ঐশীবাণী
ঊর্ধ্ব হতে রুদ্র মোর নিত্য কহে হাঁকি,
শোনাতে এ কথা, এই তাঁহার আদেশ।
তোমাদের প্রাণের এ অনির্বাণ-শিখা
যৌবনের হোমকুণ্ড-পাশে বৃদ্ধ বসি,
আগুন পোহাবে, বন্ধু, এ দৃশ্য দেখিতে
যেন নাহি বাঁচি আর। সমাধি হইতে
আর যেন নাহি উঠি প্রলয়ের আগে!
সে যে আমি
ওগো দুরন্ত সুন্দর মোর! কার পরে রাগ করি
তারার মুক্তা-মালিকা ছিঁড়িয়া ছড়ালে গগন ভরি?
কারে তুমি ভালোবাস প্রিয়তম? কার নাহি পেয়ে দেখা
চাঁদের কপোলে মাখাইয়া দিলে কালো কলঙ্ক-লেখা?
কার অনুরাগ নাহি পেয়ে তুমি লাল হয়ে ওঠ রাগে?
প্রভাত-সূর্যে, সৃষ্টিতে সেই রাগের বহ্নি লাগে।
কাহার বিরহ-জ্বালায় জ্বালাও বিশ্ব, পরম স্বামী?
সে কি আমি? সে কি আমি?
বনে উপবনে কুঞ্জে ফোটাও চামেলি চম্পা হেনা,
ওগো সুন্দর, ফুল ফুটাইয়া মালা কেন গাঁথিলে না?
শ্রাবণ-গগনে মেঘরূপে ওঠে তব রোদনের ঢেউ,
ঝুরিয়া ঝুরিয়া ক্ষীণ হল তনু, ভালোবাসিল না কেউ?
ওগো অভিমানী! বলো, কেন কোন নির্দয় অভিমানে
সৃষ্টিতে দিয়া জীবন, আবার টানিছ মৃত্যু-টানে?
গড়িয়া নিমেষে ভেঙে ফেল রূপ, যেন ভালো নাহি লাগে
রূপের এ খেলা। কোন অপরূপা স্মৃতিতে তোমার জাগে।
তাহারই লাগিয়া জাগিয়া রয়েছ উদাসীন দিবাযামী,
সে কি আমি? সে কি আমি?
ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুৎ-ব্যোমে বসালে ভূতের মেলা,
ভূত নিয়ে এ কী অদ্ভুত খেলা, কে হানিয়াছে হেলা?
মাধবীলতার কাঁকন পরায়ে সহকার-তরুশাখে
রুদ্র ঝড়ের রূপে এসে তুমি কেন ছিঁড়ে ফেল তাকে?
তোমার প্রেমের রাখি কে নিল না, কে সেই গরবিনি?
আজও সৃষ্টির পিত্রালয়ে কি কাঁদে সেই বিরহিণী?
তাই কি যেখানে মিলন, সেখানে নিত্য বিরহ আনো?
আপন প্রিয়ারে পেলে না বলিয়া সবার প্রিয়ারে টানো?
কার কামনার সৃষ্টিতে তব রূপ চঞ্চলকামী?
সে কি আমি? সে কি আমি?
কাহারে ভুলাতে ঝর অনন্ত পরম-শ্রীর রূপে,
তোমারই গুণের কথা কি ভ্রমর ফুলে কয় চুপে চুপে?
মুহু মুহু উহু উহু করে ওঠ কুহুর কন্ঠস্বরে
তোমারই কাছে কি শিখিয়া পাপিয়া পিয়া পিয়া রব করে?
পদ্মপাতার থালায় তোমার নিবেদিত ফুলগুলি
ঝরে ঝরে পড়ে অশ্রুসায়রে, কহ লইল না তুলি!
যাহার লাগিয়া ফুলের বক্ষে সঞ্চিত কর মধু,
সকলে সে মধু লইল, নিল না তোমারই মালিনীবধূ?
যে অপরূপারে খোঁজ অনন্তকাল রূপে রূপে নামি –
সে কি আমি? সে কি আমি?
সংহারে খোঁজ, সৃষ্টিতে খোঁজ, খোঁজ নিত্য স্থিতিতে,
যাহারে খুঁজিছ পরম বিরহে, খুঁজিছ পরম প্রীতিতে,
যে অপরূপা পূর্ণা হইয়া আজিও এল না বাহিরে
পাইয়া যাহারে বলিছ, এ নয়, হেথা নয় সে তো নাহি রে।
সেই কুন্ঠিতা গুন্ঠিতা তব চির-সঙ্গিনী বালিকা
অনন্ত প্রেমরূপে অনন্ত ভুবনে গাঁথিছে মালিকা।
ভীরু সে কিশোরী তব অন্তরে অন্তরতম কোণে
হারাবার ভয়ে তোমারে, লুকায়ে রহে সদা নিরজনে।
সকলেরে দেখ, আপনারে শুধু দেখ না পরম উদাসীন,
দেখিলে, দেখিতে যেখানে তুমি, সেইখানে সে যে আছে লীন!
যত কাঁদে, তত বুকে বাঁধে তোমারেই অন্তর্যামী!
সে কি আমি? সে কি আমি?
ওগো প্রিয়তম! যত ধরি আমি দু-হাতে তোমারে জড়ায়ে
আমারে খুঁজিতে আমারেই তত সৃষ্টিতে দাও ছড়ায়ে।
আমারে যতই প্রকাশিতে চাহ বাহিরে ভুবনে আনিয়া,
তত লুকাইতে চাহি ; আজিও যে আমি অপূর্ণা জানিয়া।
হে মোর পরম মনোহর ! তব প্রিয়া বলে দিতে পরিচয়,
ক্ষমা করো, যদি অপূর্ণা এই বালিকার মনে জাগে ভয়!
আমার কলহ মান-অভিমান তোমার সহিত গোপনে,
জাগ্রত দিনে আজও লাজ লাগে, তাই মিলি আমি স্বপনে।
ওগো ও পরম নিলাজ, পরম নিরাবরণ, হে চঞ্চল,
আমারে ধরিতে, টানিয়া চলেছ সৃষ্টিতে মোর অঞ্চল।
আমারে কাঁদাতে সকলের সাথে দেখাও মিলন-অভিনয়,
বাহিরে এনো না, কাঁদিব বক্ষে, রেখো এ মিনতি প্রেমময়।
যদি ভালো তুমি বাস অপরেরে, হে পর-পুরুষ সুন্দর,
আমি আছি, আমি রব চিরকাল জুড়িয়া তোমার অন্তর।
আমি যে তোমার শক্তি হে প্রিয়, প্রকাশ বহির্জগতে,
আমারে না পেয়ে দুঃখের রূপে কাঁদিছে স্বর্গে-মরতে।
কলঙ্ক দিয়া আমার ধর্মে কলঙ্কী নাম নিলে হে,
দুই হয়ে তব রটে অপযশ, একাকী তো বেশ ছিলে হে।
তব সুন্দর-ছায়া মায়া রচে, মায়াতীত হয়ে তাহাতে–
কেন আসক্ত হলে তুমি, তারে জড়ায়ে ধরিলে বাঁ হাতে?
রূপ নাই, তবু রূপের তৃষ্ণা কেন তব বুকে জাগে,
এত রূপ রসে ঝরিয়া পড়িছ বলো কার অনুরাগে?
খেলা-শেষে মহাপ্রলয়ের বেলা আমার দুয়ারে থামি
জানাবে পরম-পতি আমারে কি –
আমি, প্রিয়, সে যে আমি!