- বইয়ের নামঃ নতুন চাঁদ
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- প্রকাশনাঃ আগামী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অভেদম্
দেখিয়াছ সেই রূপের কুমারে, গড়িছে যে এই রূপ?
রূপে রূপে হয় রূপায়িত যিনি নিশ্চল নিশ্চুপ!
কেবলই রূপের আবরণে যিনি ঢাকিছেন নিজ কায়া
লুকাতে আপন মাধুরী যে জন কেবলই রচিছে মায়া!
সেই বহুরূপী পরম একাকী এই সৃষ্টির মাঝে
নিষ্কাম হয়ে কীরূপে সতত রত অনন্ত কাজে।
পরম নিত্য হয়ে অনিত্য রূপ নিয়ে এই খেলা
বালুকার ঘর গড়িছে ভাঙিছে সকাল-সন্ধ্যা বেলা।
আমরা সকলে খেলি তারই সাথে, তারই সাথে হাসি কাঁদি
তারই ইঙ্গিতে ‘পরম-আমি’রে শত বন্ধনে বাঁধি।
মোরে ‘আমি’ ভেবে তারে স্বামী বলি দিবাযামী নামি উঠি,
কভু দেখি – আমি তুমি যে অভেদ, কভু প্রভু বলে ছুটি।
একাকী হইয়া একা-একা খেলি, চুপ করে বসে থাকি।
ভালো নাহি লাগে, কেন সাধ জাগে খেলুড়িরে কাছে ডাকি!
সৃষ্টির ঘুড়ি উড়াই শূন্যে, আনন্দে প্রাণ নাচে,
দেখি সে লাটাই লুটায়ে পড়েছে কখন পায়ের কাছে।
বীজ রূপে রই – নিজ রূপ কই? খুঁজিতে সহসা দেখি
সেই বীজ-আমি মহাতরু হয়ে ছড়ায়ে পড়েছি – এ কী!
শাখাপ্রশাখায় পল্লবে-ফুলে ফলে-মূলে কত রূপে
কখন আমারে বিকশিত করি খেলিতেছি চুপে চুপে!
কত সে বিহগ-বিহগী আসিয়া বেঁধেছে আমাতে নীড়,
ঊর্ধ্বে নিম্নে কত অনন্ত আলো আঁধারের ভিড়।
অনন্ত দিকে অনন্ত শাখা, অনন্ত রূপ ধরি
উদ্ভিদ জড় জীব হয়ে আমি ফিরিতেছি সঞ্চরি।
চির-আনমনা উদাসীন, তাই নিজ সৃষ্টিরই মাঝে
হেরি কত শত ছন্দপতন অপূর্ণতা বিরাজে।
চমকি উঠিয়া সংহার করি আপনার সেই ভুল,
সেই ভুল দিয়া নতুন করিয়া ফুটাই সৃষ্টি-ফুল।
মৃত্যু কেমন লাগে মোর কাছে, শোনো সে বাণী অভয়,
আঁখির পলক পড়িলে যেমন ক্ষণিক সৃষ্টি-লয়,
একটি পলক আঁধারে হেরিয়া আবার সৃষ্টি হেরি,
মৃত্যুর পরে জীবন আসিতে ততটুকু হয় দেরি!
মৃত্যুর ভয় ভীত যারা, হয় তাদেরই নরকভোগ,
অমৃতে সেই ডুবে আছে, যার নিত্য আত্ম-যোগ!
মোরই আনন্দ সৃষ্টি করিছে স্ত্রী ও পুত্র আদি,
কেবলই মিলন লাগে নাকো ভালো, বিরহ রচিয়া কাঁদি।
কেবল শান্তি শ্রান্তি আনিলে নিজে অশান্তি আনি,
ভুলিয়া স্বরূপ ঠুলি পরে টানি শত কর্মের ঘানি।
রুদ্রের রূপে সংহার করি, প্রেমময় রূপে কাঁদি,
যারে ‘তুমি’ বল, সেই ‘আমি’ খুঁজি নিজের অন্ত আদি।
সংসারে আসি সং সেজে আমি – শত প্রিয়জন লয়ে,
আপনারে ভোগ করিতে জন্মি বিপুল তৃষ্ণা হয়ে।
যত ভোগ করি তত আপনার তৃষ্ণা বাড়িয়া যায়
অমৃত-মধু মদ হয়ে উঠে তৃষ্ণায় পিয়ালায়!
বন্ধু! কেমনে মিটিবে তৃষ্ণা পূর্ণেরে নাহি পেলে,
আমি যে নিজেই অপূর্ণরূপে এসেছি পূর্ণে ফেলে!
সৃষ্টি-স্থিতি-সংহার – এই তিন রূপই যাঁর লীলা,
সেই সাগরের আমি যে ঊর্মি, বিরহিণী ঊর্মিলা!
দুখ শোক ব্যাধি নিজে লই সাধি, – কখনও অত্যাচারী-
অসুর সাজিয়া কেড়ে খাই – পুন দেবতা সাজিয়া মারি!
বিদ্বেষ নাই, আসক্তিহীন শুধু সে খেলার ঝোঁকে
অসাম্য করি সৃজন – আবার সংহার করি ওকে।
খেলিতে খেলিতে সহসা চকিতে দেখি আপনারই কায়া
শ্রী ও সামঞ্জস্যবিহীন এ কী কুৎসিত ছায়া!
সেই কুৎসিত শ্রীহীন অসুরে তখনই বধিতে চাই,
মোর বিদ্রোহ সাম্য-সৃষ্টি – নাই সেথা ভেদ নাই।
নাই সেথা যশ তৃষ্ণার লোভ, নাই বিরোধের ক্লেদ,
নাই সেথা মোর হিংসার ভয়, নাই সেথা কোনো ভেদ,
নাই অহিংসা-হিংসা, সেখানে কেবল পরম সাম,
রাজনীতি নাই, কোনো ভীতি নাই, ‘অভেদম্’ তার নাম।
অভয়-সুন্দর
কুৎসিত যাহা, অসাম্য যাহা সুন্দর ধরণিতে –
হে পরম সুন্দরের পূজারি! হবে তাহা বিনাশিতে।
তব প্রোজ্জ্বল প্রাণের বহ্নিশিখায় দহিতে তারে
যৌবন ঐশ্বর্য-শক্তি লয়ে আসে বারে বারে।
যৌবনের এ ধর্ম বন্ধু, সংহার করি জরা
অজর অমর করিয়া রাখে এ প্রাচীনা বসুন্ধরা।
যৌবনের সে ধর্ম হারায়ে বিধর্মী তরুণেরা –
হেরিতেছি আজ ভারতে – রয়েছে জরার শকুনে ঘেরা।
যুগে যুগে জরাগ্রস্ত যযাতি তারই পুত্রের কাছে
আপন বিলাস ভোগের লাগিয়া যৌবন তার যাচে।
যৌবনে করি বাহন তাহার জরা চলে রাজপথে
হাসিছে বৃদ্ধ যুবক সাজিয়া যৌব-শক্তি-রথে।
জ্ঞান-বৃদ্ধের দন্তবিহীন বৈদান্তিক হাসি
দেখিছ তোমরা পরমানন্দে – আমি আঁখিজলে ভাসি
মহাশক্তির প্রসাদ পাইয়া চিনিলে না হায় তারে
শিবের স্কন্ধে শব চড়াইয়া ফিরিতেছ দ্বারে দ্বারে।
এই কি তরুণ? অরুণে ঢাকিবে বৃদ্ধের ছেঁড়া কাঁথা
এই তরুণের বুকে কি পরম-শক্তি-আসন পাতা?
ধূর্ত বুদ্ধিজীবীর কাছে কি শক্তি মানিবে হার?
ক্ষুদ্র রুধিবে ভোলানাথ শিব মহারুদ্রের দ্বার?
ঐরাবতেরে চালায় মাহুত শুধু বুদ্ধির ছলে –
হে তরুণ, তুমি জান কি হস্তী-মূর্খ কাহারে বলে?
অপরিমাণ শক্তি লইয়া ভাবিছ শক্তিহীন –
জরারে সেবিয়া লভিতেছ জরা, হইতেছ আয়ুক্ষীণ।
পেয়ে ভগবদ্-শক্তি যাহারা চিনিতে পারে না তারে
তাহাদের গতি চিরদিন ওই তমসার কারাগারে।
কোন লোভে, কোন মোহে তোমাদের এই নিম্নগ গতি?
চাকুরির মায়া হরিল কি তব এই ভগবদ্-জ্যোতি?
সংসারে আজও প্রবেশ করনি, তবু সংসার – মায়া
গ্রাস করিয়াছে তোমার শক্তি তোমার বিপুল কায়া।
শক্তি ভিক্ষা করিবে যাহারা ভোট-ভিক্ষুক তারা!
চেন কি – সূর্য-জ্যোতিরে লইয়া উনুন করেছে যারা?
চাকুরি করিয়া পিতামাতাদের সুখী করিতে কি চাহ?
তাই হইয়াছে নুড়ো-মুখ যত বুড়োর তলপিবাহ?
চাকর হইয়া বংশের তুমি করিবে মুখোজ্জ্বল?
অন্তরে পেয়ে অমৃত, অন্ধ, মাগিতেছ হলাহল!
হউক সে জজ, ম্যাজিস্ট্রেট কি মন্ত্রী কমিশনার –
স্বর্ণের গলাবন্ধ পরুক – সারমেয় নাম তার!
দাস হইবার সাধনা যাহার নহে সে তরুণ নহে –
যৌবন শুধু খোলস তাহার – ভিতরে জরারে বহে।
নাকের বদলে নরুন-চাওয়া এ তরুণেরে নাহি চাই –
আজাদ-মুক্ত-স্বাধীনচিত্ত যুবাদের গান গাই।
হোক সে পথের ভিখারি, সুবিধা-শিকারি নহে যে যুবা
তারই জয়গাথা গেয়ে যায় চিরদিন মোর দিলরুবা।
তাহারই চরণধূলিরে পরম প্রসাদ বলিয়া মানি
শক্তিসাধক তাহারেই আমি বন্দি যুক্ত-পাণি।
মহা-ভিক্ষু তাহাদেরই লাগি তপস্যা করি আজও
তাহাদেরই লাগি হাঁকি নিশিদিন – ‘বাজো রে শিঙ্গা বাজো!’
সমাধির গিরিগহ্বরে বসি তাহাদেরই পথ চাহি –
তাহাদেরই আভাস পেলে মনে হয় পাইলাম বাদশাহি!
মোর সমাধির পাশে এলে কেউ, ঢেউ ওঠে মোর বুকে –
‘মোর চির-চাওয়া বন্ধু এলে কি’ বলে চাহি তার মুখে।
জ্যোতি আছে হায় গতি নাই হেরি তার মুখ পানে চেয়ে –
কবরে ‘সবর’ করিয়া আমার দিন যায় গান গেয়ে!
কারে চাই আমি কী যে চাই হায় বুঝে না উহারা কেহ।
দেহ দিতে চায় দেশের লাগিয়া, মন টানে তার গেহ।
কোথা গৃহহারা, স্নেহহারা ওরে ছন্নছাড়ার দল –
যাদের কাঁদনে খোদার আরশ কেঁপে ওঠে টলমল।
পিছনে চাওয়ার নাহি যার কেউ, নাই পিতামাতা জ্ঞাতি
তারা তো আসে না জ্বালাইতে মোর আঁধার কবরে বাতি!
আঁধারে থাকিয়া, বন্ধু, দিব্যদৃষ্টি গিয়াছে খুলে
আমি দেখিয়াছি তোমাদের বুকে ভয়ের যে ছায়া দুলে।
তোমরা ভাবিছ – আমি বাহিরিলে তোমরা ছুটিবে পিছে –
আপনাতে নাই বিশ্বাস যার – তাহার ভরসা মিছে!
আমি যদি মরি সমুখ-সমরে – তবু যারা টলিবে না –
যুঝিবে আত্মশক্তির বলে তারাই অমর সেনা।
সেই সেনাদল সৃষ্টি যেদিন হইবে – সেদিন ভোরে
মোমের প্রদীপ নহে গো – অরুণ সূর্য দেখিব গোরে!
প্রতীক্ষারত শান্ত অটল ধৈর্য লইয়া আমি
সেই যে পরম ক্ষণের লাগিয়া জেগে আছি দিবা-যামী।
ভয়কে যাহারা ভুলিয়াছে – সেই অভয় তরুণ দল
আসিবে যেদিন – হাঁকিব সেদিন – ‘সময় হয়েছে, চল!’
আমি গেলে যারা আমার পতাকা ধরিবে বিপুল বলে –
সেই সে অগ্রপথিকের দল এসো এসো পথতলে!
সেদিন মৌন সমাধিমগ্ন ইসরাফিলের বাঁশি
বাজিয়া উঠিবে – টুটিবে দেশের তমসা সর্বনাশী!