আশা
আমি শ্রান্ত হয়ে আসব যখন পড়ব দোরে টলে,
আমার লুটিয়ে-পড়া দেহ তখন ধরবে কি ঐ কোলে?
বাড়িয়ে বাহু আসবে ছুটে?
ধরবে চেপে পরান-পুটে?
বুকে রেখে চুমবে কি মুখ
নয়ন-জলে গলে?
আমি শ্রান্ত হয়ে আসব যখন পড়ব দোরে টলে!
তুমি এতদিন যা দুখ দিয়েছ হেনে অবহেলা,
তা ভুলবে না কি যুগের পরে ঘরে-ফেরার বেলা?
বলো বলো জীবন-স্বামী,
সেদিনও কি ফিরব আমি?
অন্তকালেও ঠাঁই পাব না
ঐ চরণের তলে?
আমি শ্রান্ত হয়ে আসব যখন পড়ব দোরে টলে!
আশান্বিতা
আবার কখন আসবে ফিরে সেই আশাতে জাগব রাত,
হয়তো সে কোন নিশুত রাতে ডাকবে এসে অকস্মাৎ!
সেই আশাতে জাগব রাত।
যতই কেন বেড়াও ঘুরে
মরণ-বনের গহন জুড়ে
দূর সুদূরে,
কাঁদলে আমি আসবে ছুটে, রইতে দূরে নারবে নাথ,
সেই আশাতে জাগব রাত।
কপট! তোমার শপথ-পাহাড় বিন্ধ্যসম হোক না সে,
ঝড়ের মুখে খড়ের মতন উড়বে তা মোর নিশ্বাসে!
একটি ছোট্ট নিশ্বাসে!
রাত্রি জেগে কাঁদছি আমি
শুনবে যখন, হে মোর স্বামি,
সুদূরগামী!
আগল ভেঙে আসবে পাগল, চুমবে সজল নয়ন-পাত,
সেই আশাতে জাগব রাত।
জানি সখা, আমার চোখের একটি বিন্দু অশ্রুজল,
নিববে তাতেই তোমার বুকের অগ্নি-সিন্ধু নীল গরল,
আমার চোখের অশ্রুজল!
তোমার আদর-সোহাগিনী
তাই তো কাঁদায় নিশিদিনই
এ অধীনী,
ভুলবে জানি তোমার রানি গরবিনীর সব আঘাত!
সেই আশাতে জাগব রাত।
আসবে আবার পদ্মানদী, দুলবে তরী ঢেউ-দোলায়,
তেমনি করে দুলব আমি তোমার বুকের পরকোলায়।
দুলবে তরী ঢেউ-দোলায়।
পাগ্লি নদী উঠবে খেপে,
তোমায় তখন ধরব চেপে
বক্ষ ব্যেপে,
মরণ-ভয়কে ভয় কি তখন, জড়িয়ে কণ্ঠ থাকবে হাত!
সেই আশাতে জাগব রাত।
পোড়া চোখের জল ফুরায় না, কেমন করে আসবে ঘুম?
মনে পড়ে শুধু তোমার পাতাল-গভীর মাতাল চুপ,
কেমন করে আসবে ঘুম?
আজ যে আমার নিশীথ জুড়ে
একলা থাকার কান্না ঝুরে
হতাশ সুরে,
পুবের হাওয়ায় সে সুর, আসবে পছিম হাওয়ার সাথ!
সেই আশাতে জাগব রাত।
বিজলি-শিখার প্রদীপ জ্বেলে ভাদর রাতের বাদল মেঘ,
দিগ্বিদিকে খুঁজছে তোমায় ডাকছে কেঁদে বজ্র-বেগ–
দিগ্বিদিকে খুঁজছে মেঘ!
তোমার আশায় ঐ আশা-দীপ
জ্বালিয়েছে আজ দিক ভরে নীপ,
হে রাজ-পথিক,
আজ না আসো, এসো যেদিন দীপ নিবাবে ঝন্ঝবাত!
সেই আশাতে জাগব রাত।
উপেক্ষিত
কান্না-হাসির খেলার মোহে অনেক আমার কাটল বেলা,
কখন তুমি ডাক দেবে মা, কখন আমি ভাঙব খেলা?
অজানাকে আনতে জিনে
জগৎটাকে ফেলনু চিনে,
চাই যারে মা তায় দেখিনে
ফিরে এনু তাই একেলা
পরাজয়ের লজ্জা নিয়ে বক্ষে বিঁধে অবহেলা॥
আজকে বড় শ্রান্ত আমি আশায় আশায় মিথ্যা ঘুরে,
ও মা এখন বুকে ধরো মরণ আসে ঐ অদূরে!
সৃষ্টিটাকে পায়ের তলে
এসেছি মা হেলায় সলে,
হৃদয় শুধু জিনতে বলে
খেয়ে এনু পায়ের ঠেলা
আর সহে না মাগো এখন আমায় নিয়ে হেলাফেলা॥
বিশ্বজয়ের গর্ব আমার জয় করেছে ঐ পরাজয়,
ছিন্ন-আশা নেতিয়ে পড়ে, ও মা এসে দাও বরাভয়!
চারদিকে মা প্রবঞ্চনা
ভালোবাসার গিল্টিসোনা,
আজ মণি কাল ধূলি-কণা,
জুয়ার হাট এই প্রেমের মেলা!
খুইয়েছি সব সাধের খেলায়, বুক ভেঙেছে হেলার ঢেলা!
এখন তুমি নাও মা কোলে, নয় অকূলে ভাসাই ভেলা॥
কবি-রানি
তুমি আমায় ভালোবাসো তাই তো আমি কবি।
আমার এ রূপ-সে যে তোমায় ভালোবাসার ছবি।।
আপন জেনে হাত বাড়ালো-
আকাশ বাতাস প্রভাত-আলো,
বিদায়-বেলার সন্ধ্যা-তারা
পুবের অরুণ রবি,-
তুমি ভালোবাস ব’লে ভালোবাসে সবি?
আমার আমি লুকিয়েছিল তোমার ভালোবাসায়,
তুমিই আমার মাঝে আসি’
অসিতে মোর বাজাও বাঁশি,
আমার পূজার যা আয়োজন
তোমার প্রাণের হবি।
আমার বাণী জয়মাল্য, রাণি! তোমার সবি।।
তুমি আমায় ভালোবাস তাই তো আমি কবি।
আমার এ রূপ-সে যে তোমার ভালোবাসার ছবি।
চপল সাথী
প্রিয়! সামলে ফেলে চলো এবার চপল তোমার চরণ!
তোমার ঐ চলাতে জড়িয়ে গেছে আমার জীবন-মরণে॥
কোথায় দূরে নূপুর বাজে তোমার পায়ে,
হেথায় রোদন আমার ওঠে উথলায়ে,
তোমার উদাসীন ঐ বিষম চলার ঘায়ে
আজ কাঁপে আমার সকল শরম-ভরম।
এখন ঐ দ্বিধাহীন চরণ করো মোর বুকে সম্বরণ।
তোমার ঐ চলাতে জড়িয়ে গেছে আমার জীবন-মরণে॥
তুমি চলার ঝোঁকে দেখছো না হায় পড়ছে চরণ কোথায়,
ওগো চপল পরান-প্রিয়!
হেরো এবার তোমার পা পড়েছে আমার বুকের ব্যথায়
এখন ধীরে চরণ নিয়ো।
তোমার ঐ যে দোলন দোদুল-দোলা-চলায়,
আজ পথ-পাগলের পথের নেশা ভোলায়,
এবার থামাও সে দোল আমার বুকের তলায়,
আর সরিয়ো না মোর ব্যথায়-বাজা চরণ।
আমার ব্যথায় রেঙে হোক ও-চরণ নিখিল-মনোহরণে॥
ঐ অধীর চরণ চলার নেশায় হলে বিপথগামী
আমি বাঁচব কি আর প্রিয়?
তোমার বিপথ সে যে আমার তরে মৃত্যু-আঘাত, স্বামি!
এখন ধীরে চরণ নিয়ো।
ওগো জানি জানি শুধু চলার সুখে
তুমি পা ফেলেছ আমার ব্যথার বুকে,
ঐ চলাই তোমার আমার গভীর দুখে,
শেষে প্রেম হয়ে সে করল অবতরণ।
আজ একা তোমার নয় ও-চরণ আমার নিখিল শরণ!
তোমার ঐ চলাতে জড়িয়ে গেছে আমার জীবন-মরণ!
প্রিয় সামলে ফেলো চলো এবার চপল তোমার চরণে॥
দোদুল দুল
[আরবি ‘মোতাকারিব্’ ছন্দ]
দোদুল দুল্
দোদুল দুল্!
বেণীর বাঁধ
আলগ্-ছাঁদ,
আলগ্-ছাঁদ
খোঁপার ফুল,
কানের দুল
খোঁপার ফুল
দোদুল দুল্
দোদুল দুল!
অলক-ছায়
কপোল-ছায়,
পরশ চায়
অলস চুল
বিনুন্-বিন্
কেশের উল
দোদুল দুল্
দোদুল দুল!
অসম্বৃত্
কাঁখের ভিত
অসম্বৃত্
পিঠের চুল,
লোহিত পীত
নোলক দুল
দোদুল দুল্
দোদুল দুল!
সোহাগ্-ঘায়
দোলন্-গায়
কাঁপন খায়
আপন পায়,
পায়ের নখ
মাথার চুল
দোদুল দুল্
দোদুল দুল!
পরাগ-ফাগ
ছড়ায় আজ
শিরাজ-বাগ
ইরান-গুল,
দোলন্-দোল
দে বুলবুল,
দোদুল দুল্
দোদুল দুল!
কাঁকন চায়
নাচন্ ফিন্
রিমিক ঝিম
ঝিমিক ঝিম!
আঁচল-বীণ
চাবির রিং
বুলায় নিদ
ঢুলায় ঢুল্ৰ
দোদুল দুল্
দোদুল দুল!
নিশাস-রেশ
কাঁপায় বেশ
মোতির হার
হিয়ার দেশ,
কাঁপায় শেষ
প্রাণের কূল
দোদুল দুল্
দোদুল দুল!
বুকের কোল
আদর ঘায়
দোলায় দোল্
দোলায় দোল্
শরম-লোল
মরম-মূল
দোদুল দুল্
দোদুল দুল!
কলস্-কাঁখ
পুকুর যায়,
আঁচল চায়
চুমায় ধুল,
দখিন্ হাত
ঝুলন্ ঝুল্
দোদুল দুল্
দোদুল দুল!
কাঁকাল ক্ষীণ
মরাল গ্রীব
ভুলায় জড়্-
ভুলায় জীব,
গমন-দোল্
অতুল তুল্
দোদুল দুল্
দোদুল দুল!
হাসির ভাস,
ব্যথার শ্বাস,
চপল চোখ,
আঁখির লাস,
নয়ন-নীর
অধর-ফুল
রাতুল তুল
রাতুল তুল
দোদুল দুল্
দোদুল দুল!
মৃণাল-হাত
নয়ন-পাত
গালের টোল,
চিবুক দোল
সকল কাজ
করায় ভুল
প্রিয়ার মোর
কোথায় তুল?
কোথায় তুল
কোথায় তুল?
স্বরূপ তার
অতুল তুল,
রাতুল তুল,
কোথায় তুল
দোদুল দুল্
দোদুল দুল!