হিংসাতুর
হিংসাই শুধু দেখেছ এ চোখে? দেখ নাই আর কিছু?
সম্মুখে শুধু রহিলে তাকায়ে, চেয়ে দেখিলে না পিছু!
সম্মুখ হতে আঘাত হানিয়া চলে গেল যে-পথিক
তার আঘাতেরই ব্যথা বুকে ধরে জাগ আজও অনিমিখ?
তুমি বুঝিলে না, হায়,
কত অভিমানে বুকের বন্ধু ব্যথা হেনে চলে যায়!
আঘাত তাহার মনে আছে শুধু, মনে নাই অভিমান?
তোমারে চাহিয়া কত নিশি জাগি গাহিয়াছে কত গান,
সে জেগেছে একা – তুমি ঘুমায়েছ বেভুল আপন সুখে,
কাঁটার কুঞ্জে কাঁদিয়াছে বসি সে আপন মনোদুখে,
কুসুম-শয়নে শুইয়া আজিকে পড়ে না সেসব মনে,
তুমি তো জান না, কত বিষজ্বালা কণ্ঠক-দংশনে!
তুমি কি বুঝিবে বালা,
যে আঘাত করে বুকের প্রিয়ারে, তার বুকে কত জ্বালা!
ব্যথা যে দিয়াছে – সম্মুখে ভাসে নিষ্ঠুর তার কায়া,
দেখিলে না তব পশ্চাতে তারই অশ্রু-কাতর ছায়া!..
অপরাধ শুধু মনে আছে তার, মনে নাই কিছু আর?
মনে নাই, তুমি দলেছ দুপায়ে কবে কার ফুলহার?
কাঁদয়ে কাঁদিয়া সে রচেছে তার অশ্রুর গড়খাই,
পার হতে তুমি পারিলে না তাহা, সে-ই অপরাধী তাই?
সে-ই ভালো, তুমি চিরসুখী হও, একা সে-ই অপরাধী!
কী হবে জানিয়া, কেন পথে পথে মরুচারী ফেরে কাঁদি!
হয়তো তোমারে করেছে আঘাত, তবুও শুধাই আজি,
আঘাতের পিছে আরও কিছু কি গো ও বুকে ওঠেনি বাজি?
মনে তুমি আজ করিতে পার কি –তব অবহেলা দিয়া
কত যে কঠিন করিয়া তুলেছ তাহার কুসুম-হিয়া?
মানুষ তাহারে করেছ পাষাণ–সেই পাষাণের ঘায়
মুরছায়ে তুমি পড়িতেছ বলে সেই অপরাধী হায়?
তাহারই সে অপরাধ –
যাহার আঘাতে ভাঙিয়া গিয়াছে তোমার মনের বাঁধ!
কিন্তু কেন এ অভিযোগ আজি? সে তো গেছে সব ভুলে!
কেন তবে আর রুদ্ধ দুয়ার ঘা দিয়া দিতেছে খুলে?
শুষ্ক যে-মালা আজিও নিরালা যত্নে রেখেছে তুলি
ঝরায়ো না আর নাড়া দিয়ে তার পবিত্র ফুলগুলি!
সেই অপরাধী, সেই অমানুষ, যত পার দাও গালি!
নিভেছে যে-ব্যথা দয়া করে সেথা আগুন দিয়ো না জ্বালি!
‘মানুষ’, ‘মানুষ’শুনে শুনে নিতি কান হল ঝালাপালা!
তোমরা তারেই অমানুষ বল – পায়ে দল যার মালা!
তারই অপরাধ – যে তার প্রেম ও অশ্রুর অপমানে
আঘাত করিয়া টুটায়ে পাষাণ অশ্রু-নিঝর আনে!
কবি অমানুষ – মানিলাম সব! তোমার দুয়ার ধরি
কবি না মানুষ কেঁদেছিল প্রিয় সেদিন নিশীথ ভরি?
দেখেছ ঈর্ষা – পড়ে নাই চোখে সাগরের এত জল?
শুকালে সাগর –দেখিতেছ তার সাহারার মরুতল!
হয়তো কবিই গেয়েছিল গান, সে কি শুধু কথা – সুর
কাঁদিয়াছিল যে – তোমারই মতো সে মানুষ বেদনাতুর!
কবির কবিতা সে শুধু খেয়াল? তুমি বুঝিবে না, রানি,
কত জ্বাল দিলে উনুনের জলে ফোটে বুদ্বুদ্-বাণী!
তুমি কী বুঝিবে, কত ক্ষত হয়ে বেণুর বুকের হাড়ে
সুর ওঠে হায়, কত ব্যথা কাঁদে সুর-বাঁধা বীণা-তারে!
সেদিন কবিই কেঁদেছিল শুধু? মানুষ কাঁদেনি সাথে?
হিংসাই শুধু দেখেছ, দেখনি অশ্রু নয়ন-পাতে?
আজও সে ফিরিছে হাসিয়া গাহিয়া? –হায়, তুমি বুঝিবে না,
হাসির ফুর্তি উড়ায় যে – তার অশ্রুর কত দেনা!
১৪০০ সাল
[কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “আজি হতে শতবর্ষ পরে” পড়িয়া]
আজি হ’তে শত বর্ষ আগে!
কে কবি, স্মরণ তুমি ক’রেছিলে আমাদেরে শত আনুরাগে,
আজি হ’তে শত বর্ষ আগে।
ধেয়ানী গো, রহস্য-দুলাল!
উতারি’ ঘোমটাখানি তোমার আঁখির আগে
কবে এল সুদূর আড়াল?
আনাগত আমাদের দখিন-দূয়ারী
বাতায়ন খুলি তুমি, হে গোপন হে স্বপ্ন-চারী,
এসেছিলে বসন্তের গন্ধবহ-সাথে,
শত বর্ষ পরে যেথা তোমার কবিতাখানি পড়িতেছি রাতে।
নেহারিলে বেদনা-উজ্জ্বল আঁখি-নীরে,
আনমনা প্রজাপতি নীরব পাখায়
উদাসীন, গেলে ধীরে ফিরে।
আজি মোরা শত বর্ষ পরে
যৌবন-বেদনা-রাঙা তোমার কবিতাখানি
পড়িতেছি অনুরাগ-ভরে ।।
জড়িত জাগর ঘুমে শিথিল শয়নে
শুনিতেছি প্রিয়া মোর তোমার ইঙ্গিত গান সজল নয়নে।
আজো হায়
বারে বারে খুলে যায়
দক্ষিণের রুদ্ধ বাতায়ন,
গুমরি গুমরি কাঁদে উচাটন বসন্ত-পবন
মনে মনে বনে বনে পল্লব মর্মরে,
কবরীর অশ্রুজল বেশী-খসা ফুল-দল পড়ে ঝ’রে ঝ’রে!
ঝিরি ঝিরি কাঁপে কালো নয়ন-পল্লব,
মধুপের মুখ হতে কাড়িয়া মধুপী পিয়ে পরাগ আসব!
কপোতের চষ্ণুপুটে কপোতীর হারায় কূজন
পরিয়াছে বনবধূ যৌবন-আরক্তিম কিংশুক-বসন।
রহিয়া রহিয়া আজো ধরনীর হিয়া
সমীর উচ্ছ্বাস্ব যেন উঠে নিঃশ্বসিয়া!
তোমা হ’তে শত বর্ষ পরে–
তোমার কবিতাখানি পড়িতেছি,
হে কবীন্দ্র, অনুরাগ ভরে!
আজি এই মদালসা ফাগুন-নিশীথে
তোমার ইঙ্গিত জাগে তোমার সঙ্গীতে!
চতুরালি, ধরিয়াছি তোমার চাতুরী।
করি’ চুরি
আসিয়াছ আমাদের দুরন্ত যৌবনে,
কাব্য হ’য়ে, গান হ’য়ে, সিক্তকন্ঠে রঙ্গীলা স্বপনে।
আজিকার যত ফুল- বিহঙ্গের যত গান যত রক্ত-রাগ
তব অনুরাগ হ’তে হে চির-কিশোর কবি,
আনিয়াছে ভাগ !
আজি নব-বসন্তের প্রভাত-বেলায়
গান হ’য়ে মাতিয়াছে আমাদের যৌবন-মেলায়।
আনন্দ দুলাল ওগো হে চির অমর।
তরুণ তরুণি মোরা জাগিতেছি আজ তব মাধবী বাসর।
যত গান গাহিয়াছ ফুল-ফোটা রাতে–
সবগুলি তার
একবার–তা’ পর আবার
প্রিয়া গাহে, আমি গাহি, আমি গাহি প্রিয়া গাহে সাথে।
গান-শেষে অর্ধরাতে স্বপনেতে শুনি
কাঁদে প্রিয়া, “ওগো কবি ওগো বন্ধু ওগো মোর গুণী–”
স্বপ্ন যায় থামি’,
দেখি, বন্ধু, আসিয়াছ প্রিয়ার নয়ন-পাতে অশ্রু হ’য়ে নামি’।
মনে লাগে, শত বর্ষ আগে
তুমি জাগো–তব সাথে আরো কেহ জাগে
দূরে কোন্ ঝিলিমিলি-তলে
লুলিত-অঞ্চলে।
তোমার ইঙ্গিতখানি সঙ্গীতের করুণ পাখায়
উড়ে যেতে যেতে সেই বাতায়নে ক্ষণিক তাকায়,
ছুঁয়ে যায় আখি-জল রেখা,
নুয়ে যায় অলক-কুসুম,
তারপর যায় হারাইয়া,–তুমি একা বসিয়া নিঝ্ঝুম।
সে কাহার আঁখিনীর- শিশির লাগিয়া,
মুকুলিকা বাণী তব কোনটি বা ওঠে মঞ্জুরিয়া,
কোনটি বা তখনো গুঞ্জরি ফেরে মনে
গোপনে স্বপনে।
সহসা খুলিয়া গেল দ্বার,
আজিকার বসন্ত প্রভাতখানি দাঁড়াল করিয়া নমস্কার।
শতবর্ষ আগেকার তোমারি সে বাসন্তিকা দূতি
আজি তব নবীনের জানায় আকুতি!…
হে কবি-শাহান-শাহ। তোমারে দেখিনি মোরা,
সৃজিয়াছ যে তাজমহল-
শ্বেতচন্দনের ফোঁটা কালের কপালে ঝলমল–
বিস্ময়-বিমুগ্ধ মোরা তাই হেরি,
যৌবনেরে অভিশাপি– “কেন তুই শতবর্ষ করিলি রে দেরী?”
হায়, মোরা আজ
মোম্তাজে দেখিনি, শুধু দেখিতেছি তাজ!
শতবর্ষ পরে আজি হে কবি-সম্রাট!
এসেছে নূতন কবি–করিতেছে তব নান্দীপাঠ!
উদয়াস্ত জুড়ি’ আজো তব
কত না বন্দনা-ঋক ধ্বনিছে নব নব।
তোমারি সে হারা-সুরখানি
নববেণু-কুঞ্জে-ছায়ে বিকশিয়া তোলে নব বাণী।
আজি তব বরে
শতবেণু-বীণা বাজে আমাদের ঘরে।
তবুও পুরে না হিয়া ভরে না ক’ প্রাণ,
শতবর্ষ সাঁতরিয়া ভেসে আসে স্বপ্নে তব গান।
মনে হয়, কবি ,
আজো আছ অস্তপাট আলো করি’ আমাদেরি রবি!
আজি হ’তে শত বর্ষ আগে
যে অভিবাদন তুমি ক’রেছিলে নবীনেরে রাঙা অনুরাগে,
সে-অভিবাদনখানি আজি ফিরে চলে
প্রণামী-কমল হ’য়ে তব পদতলে!
মনে হয়, আসিয়াছ অপূর্ণের রূপে
ওগো পূর্ণ আমাদেরি মাঝে চুপে চুপে।
আজি এই অপূর্ণের কম্প্র কন্ঠস্বরে
তোমারি বসন্তগান গাহি তব বসন্ত-বাসরে–
তোমা হ’তে শতবর্ষ পরে!