[হাবিলদার-মেজর:- সাবাস সিপাই! ফের বল ভাই!]
ঐ খেপেছে পাগলি মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই,
অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোর্সে সামাল তাই!
কামাল ! তু নে কামাল কিয়া ভাই !
হো হো কামাল ! তু নে কামাল কিয়া ভাই ! !
[সৈন্যদল এক নগরের পার্শ্ব দিয়া চলিতে লাগিল। নগর-বাসিনীরা ঝরকা হইতে মুখ বাড়াইয়া এই মহান দৃশ্য দেখিতেছিল; তাহদের চোখ-মুখ আনন্দাশ্রুতে আপ্লুত। আজ বধূর মুখের বোরকা খসিয়া পড়িয়াছে। ফুল ছড়াইয়া হাত দুলাইয়া তাহারা বিজয়ী বীরদের অভ্যর্থনা করিতেছিল। সৈন্যগণ চীৎকার করিয়া উঠিল।]
ঐ শুনেছিস্? ঝর্কাতে সব বল্ছে ডেকে বৌ-দলে,
‘কে বীর তুমি? কে চলেছ চৌদলে?’
চিনিস্নে কি? এমন বোকা বোনগুলি সব!– কামাল এ যে কামাল!
পাগলি মায়ের দামাল ছেলে! ভাই যে তোদের!
তা না হলে কার হবে আর রৌশন্ এমন জামাল?
কামাল এ যে কামাল!!
উড়িয়ে দেবো পুড়িয়ে দেবো ঘর-বাড়ি সব সামাল!
ঘর-বাড়ি সব সামাল!!
আজ আমাদের খুন ছুটেছে, হোশ টুটেছে,
ডগ্মগিয়ে জোশ উঠেছে!
সাম্নে থেকে পালাও!
শোহরত দাও নওরাতি আজ! হর্ ঘরে দীপ জ্বালাও!
সাম্নে থেকে পালাও!
যাও ঘরে দীপ জ্বালাও!!
[হাবিলদার-মেজর:- লেফ্ট্ ফর্ম্! লেফ্ট্! রাইট! লেফ্ট্!-ফরওয়ার্ড্!]
[বাহিনীর মুখ হঠাৎ বামদিকে ফিরিয়া গেল। পার্শ্বেই পরিখার সারি। পরিখা-ভর্তি নিহত সৈন্যের দল পচিতেছে এবং কতকগুলি অ-সামরিক নগরবাসী তাহা ডিঙাইয়া ডিঙাইয়া চলিতেছে।]
ইস্! দেখেছিস! ঐ কারা ভাই সাম্লে চলেন পা,
ফস্কে মরা আধ-মরাদের মাড়িয়ে ফেলেন বা!
ও তাই শিউরে ওঠে গা!
হাঃ হাঃ হাঃ!
মরল যে সে মরেই গেছে,
বাঁচ্ল যারা রইল বেঁচে!
এই তো জানি সোজা হিসাব! দুঃখ কি তার আঁ?
মরায় দেখে ডরায় এরা! ভয় কি মরায়? বাঃ!
হাঃ হাঃ হাঃ!
[সম্মুখে সঙ্কীর্ণ ভগ্ন সেতু। হাবিলদার-মেজর অর্ডার দিল-‘ফর্ম্ ইন্টু সিঙ্গল্ লাইন’। এক একজন করিয়া বুকের পিঠের নিহত ও আহত ভাইদের চাপিয়া ধরিয়া অতি সন্তর্পণে ‘স্লো মার্চ’ করিয়া পার হইতে লাগিল।]
সত্যি কিন্তু ভাই!
যখন মোদের বক্ষে-বাঁধা ভাইগুলির এই মুখের পানে চাই–
কেমন সে এক ব্যথায় তখন প্রাণটা কাঁদে যে সে!
কে যেন দুই বজ্র-হাতে চেপে ধরে কল্জেখানা পেষে!
নিজের হাজার ঘায়েল জখম ভুলে তখন ডুক্রে কেন কেঁদেও ফেলি শেষে!
কে যেন ভাই কল্জেখানা পেষে!!
ঘুমোও পিঠে, ঘুমোও বুকে, ভাইটি আমার, আহা!
বুক যে ভরে হাহাকারে যতই তোরে সাব্বাস দিই,
যতই বলি বাহা!
লক্ষ্মীমণি ভাইটি আমার, আহা!!
ঘুমোও ঘুমোও মরণ-পরের ভাইটি আমার, আহা!!
অস্ত-পারের দেশ পারায়ে বহুৎ সে দূর তোদের ঘরের রাহা!
ঘুমোও এখন ঘুমোও ঘুমোও ভাইটি ছোট আহা!
মরণ-বধূর লাল রাঙা বর! ঘুমো!
আহা, এমন চাঁদমুখে তোর কেউ দিল না চুমো!
হতভাগা রে!
মরেও যে তুই দিয়ে গেলি বহুৎ দাগা রে
না জানি কোন্ ফুট্তে-চাওয়া মানুষ-কুঁড়ির হিয়ায়!
তরুণ জীবন এম্নি গেল, একটি রাতও পেলিনে রে বুকে কোনো প্রিয়ায়!
অরুণ খুনের তরুণ শহীদ! হতভাগ্য রে!
মরেও যে তুই দিয়ে গেলি বহুৎ দাগা রে!
তাই যত আজ লিখ্নে-ওয়ালা তোদের মরণ ফুর্তি-সে জোর লেখে!
এক লাইনে দশ হাজারের মৃত্যু-কথা! হাসি রকম দেখে!
মরলে কুকুর ওদের, ওরা শহীদ-গাথার বই লেখে!
খবর বেরোয় দৈনিকে,
আর একটি কথায় দুঃখ জানান, ‘জোর মরেছে দশটা হাজার সৈনিকে!’
আঁখির পাতা ভিজল কি না কোনো কালো চোখের,
জান্ল না হায় এ-জীবনে ঐ সে তরুণ দশটি হাজার লোকের!
পচে মরিস পরিখাতে, মা-বোনেরাও শুনে বলে ‘বাহা’!
সৈনিকেরই সত্যিকারের ব্যথার ব্যথী কেউ কি রে নেই? আহা!–
আয় ভাই তোর বৌ এল ঐ সন্ধ্যা মেয়ে রক্ত-চেলি পরে,
আঁধার-শাড়ি পরবে এখন পশ্বে যে তোর গোরের বাসর-ঘরে!–
ভাবতে নারি, গোরের মাটি করবে মাটি এ মুখ কেমন করে–
সোনা মানিক ভাইটি আমার ওরে!
বিদায়-বেলায় আরেকটিবার দিয়ে যা ভাই চুমো!
অনাদরের ভাইটি আমার! মাটির মায়ের কোলে এবার ঘুমো!!
[নিহত সৈন্যদের নামাইয়া রাখিয়া দিয়া সেতু পার হইয়া আবার জোরে মার্চ করিতে করিতে তাহাদের রক্ত গরম হইয়া উঠিল।]
ঠিক বলেছ দোস্ত তুমি!
চোস্ত কথা! আয় দেখি–তোর হস্ত চুমি!
মৃত্যু এরা জয় করেছে, কান্না কিসের?
আব্-জম্-জম্ আনলে এরা, আপনি পিয়ে কল্সি বিষের!
কে মরেছে? কান্না কিসের?
বেশ করেছে!
দেশ বাঁচাতে আপ্নারি জান শেষ করেছে!
বেশ করেছে!!
শহীদ ওরাই শহীদ!
বীরের মতন প্রাণ দিয়েছে খুন ওদেরি লোহিত!
শহীদ ওরাই শহীদ!!