তুমি ফিরে যাও তব আলকায়, গৌরী গিরির শিরে,
চরণে চরণে তুষার ভাঙিও মন্দাকিনীর তীরে।
কন্ঠে পরিও কিংশুকমালা, পাটল-পুষ্প কানে,
নীপ-কেশরের রচিও কবরী নব আষাঢ়ের গানে।
তীর্থ পথিক বহু পথ বাহি শ্রান্ত ক্লান্ত কায়,
কোন এক প্রাতে যেয়ে পৌছিব শিঞ্চল গিরি ছায়।
দিগ জোড়া ঘন কুয়াশার লোল অঞ্চলখানি,
বায়ুরথে বসি কিরণ কুমার ফিরিবে সুদূরে টানি।
আমরা হাজার নব নারী হেথা রহিব প্রতীক্ষায়,
কোন শুভখনে গিরি-কন্যার ছায়া যদি দেখা যায়।
দিবসের পর দিবস কাটিবে, মহাশূন্যের পথে,
বরণের পর বরণ ঢালিবে উতল মেঘের রথে।
কুহকী প্রকৃতি মেঘের গুচ্ছে বাঁধিয়া বাদল ঝড়,
ঘন ঘোর রাতে মহাউল্লাসে নাচিবে মাথার পর।
ভয়-বিহবল দিবস লুকাবে কপিল মেঘের বনে,
খর বিদ্যুৎ অট্ট হাসিবে গগনের প্রাঙ্গণে।
তীর্থ-পথিক তুব ফিরিবে না, কোন শুভদিন ধরি,
বহুদূর পথে দাঁড়াবে আসিয়া গৌরী গিরির পরী।
সোনার অঙ্গে জড়ায়ে জড়ায়ে বিজলীর লতাগুলি,
ফুল ফোটাইবে, হাসি ছড়াইবে অধর দোলায় দুলি।
কেউ বা দেখিবে, কেউ দেখিবে না, অনন্ত মেঘ পরে,
আলোক প্রদীপ ভাসিয়া যাইবে শুধু ক্ষণিকের তরে।
তারপর সেথা ঘন কুয়াশার অনন্ত আঁধিয়ার,
আকাশ-ধরনী, বন-প্রান্তর করে দেবে একাকার।
আমরা মানুষ-ধরার মানুষ এই আমাদের মন,
যদি কোনদিন পরিতে না চাহে কুটীরের বন্ধন;
যদি কোনদিন সুদূর হইতে আলেয়ার আলো-পরী,
বেঘুম শয়ন করে চঞ্চল ডাকি মোর নাম ধরি।
হয়ত সেদিন বাহির হইব, গৃহের তুলসী তলে,
যে প্রদীপ জ্বলে তাহারে সেদিন নিবায়ে যাইব চলে।
অঙ্গে পরিব গৈরিক বাস, গলায় অক্ষহার,
নয়নে পরিব উদাস চাহনী মায়া মেঘ বলাকার।
কাশীশ্বরের চরণ ছুঁইয়া পূতপবিত্র কায়,
জীবনের যত পাপ মুছে যাব প্রয়াগের পথ গায়।
হরিদ্বারের রঙিন ধূলায় ঘুমায়ে শ্রান্ত কায়,
ত্রিগঙ্গা জলে সিনান করিয়া জুড়াইব আপনায়।
কমন্ডলুতে ভরিয়া লইব তীর্থ নদীর বারি,
লছমন ঝোলা পার হয়ে যাব পূজা-গান উচ্চারি।
তাপসীজনের অঙ্গের বায়ে পবিত্র পথ ছায়ে,
বিশ্রাম লভি সমুকের পানে ছুটে যাব পায়ে পায়ে।
বিশ্রাম লভি সমুখের পানে ছুটে যাব পায়ে পায়ে।
দেউলে দেউলে রাখিব প্রণাম, তীর্থ নদীর জলে
পূজার প্রসূন ভাসাইয়া দিব মোর দেবতারে বলে।
মাস-বৎসর কাটিয়া যাইবে, কেদার বদরী ছাড়ি,
ঘন বন্ধুর পথে চলিয়াছে সন্যাসী সারি সারি,
কঠোর তাপেতে ক্ষীন্ন শরীর শ্রান্তক্লান্ত কায়,
সমুখের পানে ছুটে চলে কোন দুরন্ত তৃষ্ণায়।
সহসা একদা মানস সরের বেড়িয়া কণক তীর,
হোমের আগুন জ্বলিয়া উঠিবে হাজার সন্ন্যাসীর।
শিখায় শিখায় লিখন লিখিয়া পাঠাবে শূন্যপানে,
মন্ত্রে মন্ত্রে ছড়াবে কামনা মহা-ওঙ্কার গানে।
তারি ঝঙ্কারে স্বর্গ হইতে বাহিয়া কণক রথ,
হৈমবতীগো, নামিয়া আসিও ধরি মর্ত্ত্যের পথ।
নীল কুবলয় হসে- ধরিও দাঁড়ায়ে সরসী নীরে,
মরাল মরালী পাখার আড়াল রচিবে তোমার শিরে।
প্রথম উদীতা-ঊষসী-জবার কুসুম মূরতি ধরি,
গলিত হিরণ কিরণে নাহিও, হে গিরি দুহিতা পরি।
অধর ডলিয়া রক্ত মৃণালে মুছিও বলাকা পাখে,
অঙ্গ ঘেরিয়া লাবণ্য যেন লীলাতরঙ্গ আঁকে।
চারিধার হতে ভকত কন্ঠে উঠিবে পূজার গান,
তার সিঁড়ি বেয়ে স্বরগের পথে করো তুমি অভিযান।
তীর্থ-পথিক, ফিরিয়া আসিব আবার মাটির ঘরে,
গিরি গৌরীর বাহিনী আনিব কমন্ডলুতে ভরে।
দেউলে দেউলে গড়িব প্রতিমা, পূজার প্রসূন করে,
জনমে জনমে দেখা যেন পাই প্রণমিব ইহা স্মরে।
রূপ
রূপেরে কহিনু ডাকি
হায় রূপ! তুমি কেন চলে যাও,
তুমি কেন একখানে
স্থির হয়ে রহিতে না পাও!
তুমি কি জান না রূপ,
আঁখিতে কাজল-লতা একেঁ,
তরুণীরা তোমারে ধরিতে পাতে ফাঁদ-
দশন মুকুতা মালা দিয়ে
জড়ায়ে হাসির রাঙা চাঁদ
তুমি কি জান না রূপ, বাহুর বিজলী লতা দুটি,
বাহুরে ছাড়িয়া যদি যায়;
লহর পহর জাগে বসি
শাড়ীর সুনীল দরিয়ায়।
তুমি কি জান না রূপ,
দেহের ধূপের পাত্র ভরি,
তোমা লাগি হোম-মন্ত্র
ধ্বনিছে দিবস বিভাবরী;
কত যে হইল প্রাণবলি
কত যে হইল তনুক্ষয়,
হায় রূপ! চিরচঞ্চল রূপ!….
তবু তুমি কাহারো ত হলে নয়।
তোমার তনুর হাওয়া লাগি
প্রেম-ফুল ফুটিয়া টুটিয়া মরে যায়,
কথার কাকলি ওড়ে পথে
সোহাগে আগরে মূরছায়।
রূপ! তুমি রূপ! কারো লাগি থামিলে না কোন পথ বাঁকে
একটি আশিষ-কণা, একটু করুণা-বারি,
দয়া করে নাহি দিলে কাকে।
রূপেরে কহিনু ডাকি,
শোন রূপ, আমাদের কলূষ অন্তর,
তোমারে ছুঁইতে যেয়ে হায়
আমাদের ধরণীর ধূলিরে মাখাই তব গায়;
শিশুরা সরল মন,
চোখে মুখে স্বরগের চুমু লেগে আছে,
তুমি কি পার না রূপ! কিছুদিন রহিবারে
খেলাঘরে তাহাদের কাছে?
ফুলেরা তাদেরও চেয়ে ভাল,
হাসিমুখে চেয়ে থাকে খালি, কথা নাহি জানে,
পাখিরা বনের পাখি
ডালে ডালে মধুর কাকলি করে ফেরে;
তুমি কি তাদের মাঝে
কিছুদিন রহিতে পার না রূপ!
তোমার চলার পথ ছেড়ে?
রূপেরে কহিনু ডেকে আরো,
হায় রূপ! চিরচঞ্চল রূপ,
দেহ হতে দেহ পানে ধাও,
তোমা হেরি এত কথা জাগে মোর মনে;
তোমার কি কোন কথা নাই?
আমরা তোমারে চাহি, তুমি কি কারেও নাহি চাও!
আরো কহিলাম তারে, রূপ! তুমি
তনুতে তনুতে বাসা বাঁধি,
রজনী প্রভাতে চলে যাও;
তোমার নাহিক তৃপ্তি-
কি চেয়ে কি যেন নাহি পাও।
তোমার হাতের বর-মালা
নিশীথে পরায়ে কারো গলে
প্রভাতে খুলিয়া লয়ে যাও;
কারে যে বেসেছ ভাল
তুমি তা জান না বলে রূপ,
কেবলি সমুখ পানে ধাও।
বড় যে অভাগা রূপ,
বড় যে অবলা রূপ,
জানে না কি করে কথা বলে।
সার্থক রজনী
আজকে রাতরে যাইতে দেব না, শুধু শুধু কথা কয়ে,
তারা ফুটাইব, হাসি ছড়াইব আঁধারের লোকালয়ে।
গোলাপী ঠোঁটের কৌটায় করে রাখিব রাতেরে ভরি,
তোমার দু-খানি রঙিন বাহুর বাঁধনে তাহারে ধরি।
আজকের রাত শুধু আজকের-যত ভাল ভাল কথা,
কয়ে আর কয়ে ফুটাইব তাতে যত স্বপনের লতা!