ছেলে কয়, “মারে, কত রাত আছে? কখন সকাল হবে,
ভাল যে লাগে না, এমনি করিয়া কেবা শুয়ে থাকে কবে?”
মা কয়“বাছারে ! চুপটি করিয়া ঘুমা ত একটি বার, ”
ছেলে রেগে কয় “ঘুম যে আসে না কি করিব আমি তার ?”
পান্ডুর গালে চুমো খায় মাতা, সারা গায়ে দেয় হাত,
পারে যদি বুকে যত স্নেহ আছে ঢেলে দেয় তারি সাথ।
নামাজের ঘরে মোমবাতি মানে, দরগায় মানে দান,
ছেলেরে তাহার ভাল কোরে দাও, কাঁদে জননীর প্রাণ।
ভাল করে দাও আল্লা রছুল। ভাল কোরে দাও পীর।
কহিতে কহিতে মুখখানি ভাসে বহিয়া নয়ন নীর।
বাঁশবনে বসি ডাকে কানা কুয়ো, রাতের আঁধার ঠেলি,
বাদুড় পাখার বাতাসেতে পড়ে সুপারীর বন হেলি।
চলে বুনোপথে জোনাকী মেয়েরা কুয়াশা কাফন ধরি,
দুর ছাই। কিবা শঙ্কায় মার পরাণ উঠিছে ভরি।
যে কথা ভাবিতে পরাণ শিহরে তাই ভাসে হিয়া কোণে,
বালাই, বালাই, ভালো হবে যাদু মনে মনে জাল বোনে।
ছেলে কয়, “মাগো! পায়ে পড়ি বলো ভাল যদি হই কাল,
করিমের সাথে খেলিবারে গেলে দিবে না ত তুমি গাল?
আচ্ছা মা বলো, এমন হয় না রহিম চাচার ঝাড়া
এখনি আমারে এত রোগ হোতে করিতে পারি ত খাড়া ?”
মা কেবল বসি রুগ্ন ছেলের মুখ পানে আঁখি মেলে,
ভাসা ভাসা তার যত কথা যেন সারা প্রাণ দিয়ে গেলে।
“শোন মা! আমার লাটাই কিন্তু রাখিও যতন করে,
রাখিও ঢ্যাঁপের মোয়া বেঁধে তুমি সাত-নরি শিকা পরে।
খেজুরে-গুড়ের নয়া পাটালিতে হুড়ুমের কোলা ভরে,
ফুলঝুরি সিকা সাজাইয়া রেখো আমার সমুখ পরে।”
ছেলে চুপ করে, মাও ধীরে ধীরে মাথায় বুলায় হাত,
বাহিরেতে নাচে জোনাকী আলোয় থম থম কাল রাত।
রুগ্ন ছেলের শিয়রে বসিয়া কত কথা পড়ে মনে,
কোন দিন সে যে মায়েরে না বলে গিয়াছিল দুর বনে।
সাঁঝ হোয়ে গেল আসেনাকো আই-ঢাই মার প্রাণ,
হঠাৎ শুনিল আসিতেছে ছেলে হর্ষে করিয়া গান।
এক কোঁচ ভরা বেথুল তাহার ঝামুর ঝুমুর বাজে,
ওরে মুখপোড়া কোথা গিয়াছিলি এমনি এ কালি-সাঁঝে?
কত কথা আজ মনে পড়ে মার, গরীবের ঘর তার,
ছোট খাট কত বায়না ছেলের পারে নাই মিটাবার।
আড়ঙের দিনে পুতুল কিনিতে পয়সা জোটেনি তাই,
বলেছে আমরা মুসলমানের আড়ঙ দেখিতে নাই।
করিম যে গেল? রহিম চলিল? এমনি প্রশ্ন-মালা;
উত্তর দিতে দুখিনী মায়ের দ্বিগুণ বাড়িত জ্বালা।
আজও রোগে তার পথ্য জোটেনি, ওষুধ হয়নি আনা,
ঝড়ে কাঁপে যেন নীড়ের পাখিটি জড়ায়ে মায়ের ডানা।
ঘরের চালেতে ভুতুম ডাকিছে, অকল্যাণ এ সুর,
মরণের দুত এল বুঝি হায়। হাঁকে মায়, দুর-দুর।
পচা ডোবা হতে বিরহিনী ডা’ক ডাকিতেছে ঝুরি ঝুরি,
কৃষাণ ছেলেরা কালকে তাহার বাচ্চা করেছে চুরি।
ফেরে ভন্ ভন্ মশা দলে দলে বুড়ো পাতা ঝরে বনে,
ফোঁটায় ফোঁটায় পাতা-চোঁয়া জল গড়াইছে তার সনে।
রুগ্ন ছেলের শিয়রে বসিয়া একেলা জাগিছে মাতা।
সম্মুখে তার ঘোর কুজঝটি মহা-কাল-রাত পাতা।
পার্শ্বে জ্বলিয়া মাটির প্রদীপ বাতাসে জমায় খেলা,
আঁধারের সাথে যুঝিয়া তাহার ফুরায়ে এসেছে তেল।
বৈদেশী বন্ধু
গান-বারমাসির সুর
যাওরে বৈদেশী বন্ধু যাও হাপন ঘরে,
অভাগী অবলার কথা রাইখ মনে করে।
তোমার দেশেতে বন্ধু। ফুটবে কদম কলি,
আমার দেশে কাজল্যা মেঘা নামবে ঢলি ঢলি।
সেই না কাজলা মেঘা ঝরে রয়া রয়া,
বিজলীর আগুন তাতে পড়ে খয়া খয়া।
সেই আগুন-লাগিবো আমার বুকের বসনে,
সেই আগুন লাগিবো আমার বে-ঘুম শয়নে।
আপন দেশে যাওরে বন্ধু। আপনার ঘর,
দেখিবা আপন জন পরবাস-অন্তর।
মায়েতে মুছাবে মুখ বুকের বসন দিয়া,
বইনে ত করবো বাতাস আবের পাঙ্খা দিয়া।
মায়ে না বসায়া তোমায় কোলের উপর,
নিরালে জিগাইব কত পরবাসের খবর।
মায়ের না আগেরে বন্ধু, বইনের না আগে,
কইও এ অভাগীর কথা যদি মনে লাগে।
মা বুনের আদরে বন্ধু থাকবা যখন ঘরে
অভাগী অবলার কথা দেইখ মনে করে।
ভাবিও তোমার মায়ে যে যত্তন করে,
তেমনি যত্তন কান্দে বৈদেশ নগরে।
হাপনার ভাইএ বইনে যে আদর করে,
তেমনি আদর আছে বেগানারও ঘরে।
ঘরেতে আছে তোমার ধর্ম সোদ্দের বোন,
তোমার উপর দাবী তাহার জানে সর্বজন।
মায়েরও আছে দাবী, বুকের দুধ দিয়া,
তোমারে মানুষ করল কত না করিয়া।
আমি যে বেগানা নারী কোন দাবী নাই,
সেই দুঃখে মরিরে, বন্ধু !কুল নাহি পাই।
বৈদেশী পৈড়াত !তুমি টাকায় খাটো জন,
তারে আজ কি দাম দিলা যার নিলা মন।
আমার দেশে ধান কাটিতে মন কাটিয়া গেলে,
ধানের দামই নিয়ে গেলে মনের দামটা ফেলে।
সেই না ধানের খেতে আবার ঐব ধান,
শাঙইনা পনিতে ভাসপো কাজইলা আসমান
আমার মনেতে বন্ধু। শুধুই চত্রিক মাস,
দুপুইয়া আসমান ছাড়ে আগুনীর শ্বাস।
সেই না আসমানের তলে বাজ ডাকে রয়া,
কেমন গোঁয়াইব কাল মোরে যাও কয়া।
বৈরাগী আর বোষ্টমী যায়
কোথা হতে এলো রসের বৈরাগী আর বোষ্টমী,
আকাশ হতে নামল কি চান হাসলাপরা অষ্টমী।
চেকন চোকন বোষ্টমী তার ঝটরা মাথায় দীঘল কেশ,
খেজুর গাছের বাগড়া যেমন পূব হাওয়াতে দুলছে বেশ।
পাছা পেড়ে শাড়িখানি পাছা বেয়ে যায় পড়ে,
বৈরাগী কয়, তারির সাথে ফাঁস লাগায় যাই মরে।
মুখখানি তার ডাগর ডোগর ঘষামাজা কলসখানি।
বৈরাগী কয় গলায় বেঁধে মাপতে পারি গাঙের পানি।
সঙ্গে চলে বৈরাগী তার তেল কুচ কুচ নধর কায়,
গয়লা বাড়ির ময়লা বাছুর রোদ মেখেছ সকল গায়।
আকাশেরও কালো মেঘে প্রভাতেরি পড়ছে আলো,
সামনে লয়ে পূর্ণিমা চাঁদ অমাবস্যা যায় কি ভাল।
হাতে তাহার ঘুব ঘুমা ঘুম বাজে রসের একতারা,
বৈরাগী বউর রূপের গাঙ্গে মুর্চ্ছি সে সুর হয় হারা।
বৈরাগী যে চলছে পথে চলছে রসের রূপখানি,
বৈরাগী তার একতারাতে চলছে তারি সুর হানি।