কালিন্দী লতা গলায় জড়ায়ে সোনার গোকুল কাঁদে
ব্রজের দুলাল বাঁধা নাহি পড়ে যেন মথুরার ফাঁদে।
মাধবীলতার দোলনা বাঁধিয়া কদম্ব-শাখে শাখে,
কিশোর! তোমার কিশোর সখারা তোমারে যে ওই ডাকে।
ডাকে কেয়াবনে ফুল-মঞ্জরি ঘন-দেয়া সম্পাতে,
মাটির বুকেতে তমাল তাহার ফুল-বাহুখানি পাতে।
ঘরে ফিরে যাও সোনার কিশোর! এ পাপমথুরাপুরী,
তোমার সোনার অঙ্গেতে দেবে বিষবান ছুঁড়ি ছুঁড়ি।
তোমার গোকুল আজো শেখে নাই ভালবাসা বলে কারে,
ভালবেসে তাই বুকে বেঁধে লয় আদরিয়া যারে তারে।
সেথায় তোমার কিশোরী বধূটি মাটির প্রদীপ ধরি,
তুলসীর মূলে প্রণাম যে আঁকে হয়ত তোমারে স্মরি।
হয়ত তাহাও জানে না সে মেয়ে জানে না কুসুম-হার,
এত যে আদরে গাঁথিছে সে তাহা গলায় দোলাবে কার?
তুমিও হয়ত জান না কিশোর, সেই কিশোরীর লাগি,
মনে মনে কত দেউল গেঁথেছে কত না রজনী জাগি।
হয়ত তাহারি অলকে বাঁধিতে মাঠের কুসুম ফুল,
কতদূর পথ ঘুরিয়া মরিছ কত পথ করি ভুল।
কারে ভালবাস, কারে যে বাস না তোমরা শেখনি তাহা,
আমাদের মত কামনার ফাঁদে চেননি উহু ও আহা!
মোদের মথুরা টরমল করে পাপ-লালসার ভারে,
ভোগের সমিধ জ্বালিয়া আমরা পুড়িতেছি বারে বারে।
তোমাদের প্রেম নিকষিত হেম কামনা নাহিক তায়
যুগে যুগে কবি গড়িয়াছে ছবি কত ব্রজের গাঁয়!
তোমাদের সেই ব্রজের ধূলায় প্রেমের বেলাতি হয়,
সেথা কেউ তার মূল্য জানে না, এই বড় বিস্ময়।
সেই ব্রজধূলি আজো ত মুছেনি তোমার সোনার গায়,
কেন তবে ভাই, চরণ বাড়ালে যৌবন মথুরায়!
হায়রে প্রলাপী কবি!
কেউ কভু পারে মুছিয়া লইতে ললাটেরলেখা সবি।
মথুরার রাজা টানিছে যে ভাই! কালের রজ্জু ধরে,
তরুণ কিশোর! কেউ পারিবে না ধরিয়া রাখিতে তোরে।
ওপারে গোকুল এপারে মথুরা মাঝে যমুনার জল,
নীল নয়নেতে তোর ব্যথা বুঝি বয়ে যায় অবিরল।
তবু যে তোমারে যেতে হবে ভাই, সে পাষাণ মথুরায়,
ফুলের বসতি ভাঙিয়া এখন যাইবি ফলের গাঁয়।
এমনি করিয়া ভাঙা বরষায় ফুলের ভূষণ খুলি,
কদম্ব-বধূ শিহরীয়া উঠে শরৎ হাওয়ায় দুলি।
এমনি করিয়া ভোরের শিশির ফুরায় ভোরের ঘাসে,
মাধবী হারায় বুকের সুরভি নিদাঘের নিম্বাস।
তোরে যেতে হবে চলে
এই গোকুলের ফুলের বাঁধন দুপায়েতে দলে দলে।
তবু ফিরে চাও সোনার কিশোর বিদায় পথের ধার,
কি ভূষণ তুমি ফেলে গেলে ব্রজে দেখে লই একবার।
ওই সোনামুখে আজো লেগে আছে জননীর শত চুমো,
দুটি কালো আঁখি আজো হতে পারে ঘুম-গানে ঘুম্ ঘুমো।
বরণ তাদের আর পেলবতা লিখে গেছে নির্ভূল।
কচি শিশু লয়ে ধরার মায়েরা যে আদর করিয়াছে,
সোনা ভাইদের সোনা মুখে বোন যত চুমা রাখিয়াছে;
সে সব আজিকে তোর ওই দেহে করিতেছে টলমল,
নিখিল নারীর স্নেহের সলিলে তুই শিশু শতদল।
রে কিশোর! এই মথুরার পথে সহসা দেখিয়া তোরে,
মনে হয় যেন ওমনি কাহারে দেখেছিনু এক ভোরে।
সে আমার এই কৈশোর-হিয়া, জীবনের একতীরে,
কোথা হতে যেন সোনার পাখিটি উড়ে এসেছিল ধীরে।
পাখায় তাহার বেঁধে এনেছিল দূর গগনের লেখা,
আর এনেছিল রঙিন ঊষার একটু সিঁদুর-রেখা।
সে পাখি কখন উড়িয়া গিয়াছে মোর বালুচর ছাড়ি,
আজিও তাহারে ডাকিয়া ডাকিয়া শূন্যে দুহাত নাড়ি।
সোনার কিশোর ভাই,
তোর মুখ হেরী মনে হয় যেন কোথায় ভাসিয়া যাই।
এত কাছে তুই, তবু মনে হয় আমাদের গেঁয়ো নদী,
রোদ-মাখা সাদা বালু-চরখানি শুকাইছে নিরবধি;
সেইখানে তুই দুটি রাঙা পায়ে আঁকিয়া পায়ের রেখা,
চলেছিস একা বালুকার বুকে পড়িয়া টেউএর লেখা।
সে চরে এখনো মাঠের কৃষাণ বাঁধে নাই ছোট ঘর,
কৃষাণের বউ জাঙলা বাঁধেনি তাহার বুকের পর।
লাঙল সেথায় মাটিরে ফুঁড়িয়া গাহেনি ধানের গান,
জলের উপর ভাসিতেছে যেন মাটির ও মেটো-থান।
বর্ষার নদী এঁকেছিল বুকে ঢেউ দিয়ে আলপনা,
বর্ষা গিয়াছে, ওই বালুচর আজো তাহা মুছিল না।
সেইখান দিয়ে চলেজ উধাও, চখা-চখি উড়ে আগ,
কোমল পাখার বাতাস তোমার কমল মুখেতে লাগে।
এপারে মোদের ভরের‘গেরাম’আমরা দোকানদার,
বাটখারা লয়ে মাপিতে শিখেছি কতটা ওজন কার।
তবুরে কিশোর, ওই পারে যবে ফিরাই নয়নখানি,
এই কালো চোখে আজো এঁকে যায় অমরার হাতছানি।
ওপারেতে চর এ পারেতে ভর মাঝে বহে গেঁয়ো নদী।
কিশোর কুমার, দেখিতাম তোরে ফিরিয়া দাঁড়াতি যদি।
তোর সোনা মুখে উড়িতেছে আজো নতুন চরের বালি,
রাঙা দুটি পাও চলিয়া চলিয়া রাঙা ছবি আঁকে খালি।
তুই আমাদের নদীটির মত দুপারে দুইটি তট,
দুই মেয়ে যেন দুইধারে টানে বুড়াতে কাঁখের ঘট।
ওপারে ডাকিছে নয়া বালুচর কিশোর কালের সাথী,
এপারেতে ভর ভরা যৌবন কামনা-ব্যথায় ব্যথী।
তুই হেথা ভাই ঘুমাইয়া থাক গেঁয়ো নদীটির মত,
এপার ওপার দুটি পাও ধরে কাঁদুক বাসনা যত।
পল্লী জননী
রাত থম থম স্তব্ধ, ঘোর-ঘোর-আন্ধার,
নিশ্বাস ফেলি, তাও শোনা যায়, নাই কোথা সাড়া কার।
রুগ্ন ছেলের শিয়রে বিসয়া একেলা জাগিছে মাতা,
করুণ চাহনি ঘুম ঘুম যেন ঢুলিছে চোখের পাতা।
শিয়রের কাছে নিবু নিবু দীপ ঘুরিয়া ঘুরিয়া জ্বলে,
তারি সাথে সাথে বিরহী মায়ের একেলা পরাণ দোলে।
ভন্ ভন্ ভন্ জমাট বেঁধেছে বুনো মশকের গান,
এঁদো ডোবা হতে বহিছে কঠোর পচান পাতার ঘ্রাণ?
ছোট কুঁড়ে ঘর, বেড়ার ফাঁকেতে আসিছে শীতের বায়ু,
শিয়রে বসিয়া মনে মনে মাতা গণিছে ছেলের আয়ু।