হেথায় ঘুমায় তোর ছোট ফুপু সাত বছরের মেয়ে,
রামধনু বুঝি নেমে এসেছিল ভেস্তের দ্বার বেয়ে।
ছোট বয়সেই মায়েরে হারায়ে কি জানি ভাবিত সদা,
অতটুকু বুকে লুকাইয়াছিল কে জানিত কত ব্যথা।
ফুলের মতন মুখখানি তার দেখিতাম যবে চেয়ে,
তোমার দাদীর মুখখানি মোর হৃদয়ে উঠিত ছেয়ে।
বুকেতে তাহারে জড়ায়ে ধরিয়া কেঁদে হইতাম সারা,
রঙিন সাঁঝেরে ধুয়ে মুছে দিত মোদের চোখের ধারা।
একদিন গেনু গজ্নার হাটে তাহারে রাখিয়া ঘরে,
ফিরে এসে দেখি সোনার প্রতিমা লুটায় পথের পরে।
সেই সোনামুখ গোলগাল হাত সকলি তেমন আছে,
কি জেনি সাপের দংশন পেয়ে মা আমার চলে গ্যাছে।
আপন হসেতে সোনার প্রতিমা কবরে দিলাম গাড়ি–
দাদু ধর–ধর–বুক ফেটে যায়, আর বুঝি নাহি পারি।
এইখানে এই কবরের পাশে, আরও কাছে আয় দাদু,
কথা ক’সনাক, জাগিয়া উঠিবে ঘুম-ভোলা মোর যাদু।
আস্তে আস্তে খুড়ে দেখ্ দেখি কঠিন মাটির তলে,
দীন দুনিয়ার ভেস্ত আমার ঘুমায় কিসের ছলে।
ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবিরের রাগে,
এমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে।
মজীদ হইছে আজান হাঁকিছে বড় সকরুণ সুর,
মোর জীবনের রোজকেয়ামত ভাবিতেছি কত দুর!
জোড়হাতে দাদু মোনাজাত কর্, ‘আয় খোদা, রহমান,
ভেস্ত নাজেল করিও সকল মৃত্যু-ব্যথিত প্রাণ!’
জেলে গাঙে মাছ ধরিতে যায়
জেলে গাঙে মাছ ধরিতে যায়,
পদ্মা নদীর উজান বাঁকে ছোট্ট ডিঙি নায়।
পদ্মা নদী কাটাল ভারী, চাক্কুতে যায় কাটা,
তারির পরে জেলের তরী করে উজান+ভাঁটা।
জলের উপর শ্যাওলা ভাসে, স্রোতের ফুলও ভাসে,
তারির পরে জেলের তরী ফুলেল পালে হাসে;
তারি সাথে ভাসায় জেলে ভাটীর সুরে গান,
জেলেনী তার হয়ত তাহার সাথেই ভেসে যান।
জেলে গাঙে মাছ ধরিতে যায়,
জেলেনী বউ জাল যে বুনায় বসে ঘরের ছায়।
সূতোর পরে সুতো দিয়ে বুনোয় দীঘল জাল,
তারির সাথে বুনিয়ে চলে দীঘল মনের হাল।
জেলে তাহার নেই যে ঘরে, ভোরের কোকিল ডাকে
জেলেনী বউ আপন মনে জাল বুনাতেই থাকে।
জেলে গেছে মাছ ধরিতে হায়,
পূব কোণেতে মেঘের গায়ে চক্কর দিয়ে যায়।
বাও ডাকিল, ঢেউঁ হাঁকিল তল তলা নাওখানি,
জেলেনী বউ ঘরের থেকে সেঁচছে তাহার পানি।
বৈষম শাপট! জেলের কুঁড়ে ভাঙবে যে এই বেলা
গাঙের থেকে দিচ্ছে জেলে বৈঠাতে তার পেলা।
গাঙে কাঁপে জেলের তরী, ঘরে জেলের প্রিয়া,
মধ্যে তারি আসন-যাওন করছে জেলের হিয়া।
জেলে ভাবে ঘরের কথা, বউ যে জেলের তরী,
এরি মধ্যে ঝড় পাগেলা কোথায় যে যায় সরি।
লাভের মাঝে হাজরা তলা দুগ্ধেতে যায় ভাসি,
গঙ্গা দেবীর কপাল ভালো পূজায় উঠেন হাসি!
জেলে গেছে মাছ ধরিতে বাঁকে,
জেলেনী বোর মন ভালো না বলতে নারে কাকে!
জাল বুনিতে ভুল হয়ে যায়, সূতো কেবল ছেঁড়ে
জেলে বাঁকের বগীলা তার মন নিয়েছে কেড়ে।
জলের ঘাটে কলস তাহার ভরেও নাহি ভরে,
ইচ্ছা করে কলসীটিরে বাঁধি মাথার কেশে,
ভাসিয়ে দেয় জেলে তাহার রয় যে বে গান দেশে।
জেলে বাঁকে মাছ ধরিতে যায়,
কূল হারা সেই গাঙে কাহার কুল লইয়া হায়!
অথই নদীর অথই পানি জালে না পায় তাল
অথই মনের ব্যথা জেলের তার চেয়ে জঞ্জাল।
কত নদী পেরিয়ে এলো ততই নদী ছাড়ি,
ব্যথার নদী উথল পাথল জমছেনাক পাড়ি।
মাটির মায়া কাটালো যে ভাটীর সুরে হায়,
কেন তাহার পরাণ টানে সুদূর ভাটী গাঁয়!
তরুণ কিশোর
তরুণ কিশোর ! তোমার জীবনে সবে এ ভোরের বেলা,
ভোরের বাতাস ভোরের কুসুমে জুড়েছে রঙের খেলা।
রঙের কুহেলী তলে,
তোমার জীবন ঊষার আকাশে শিশু রবি সম জ্বলে।
এখনো পাখিরা উঠেনি জাগিয়া, শিশির রয়েছে ঘুমে,
কলঙ্কী চাঁদ পশ্চিমে হেলি কৌমুদী-লতা চুমে।
বঁধুর কোলেতে বধুয়া ঘুমায়, খোলেনি বাহুর বাঁধ,
দীঘির জলেতে নাহিয়া নাহিয়া মেটেনি তারার সাধ।
এখনো আসেনি অলি,
মধুর লোভেতে কোমল কুসুম দুপায়েতে দলি দলি।
এখনো গোপন আঁধারের তলে আলোকের শতদল,
মেঘে মেঘে লেগে বরণে বরণে করিতেছে টলমল।
এখনো বসিয়া সেঁউতীর মালা গাঁথিছে ভোরের তারা,
ঊষার রঙিন শাড়ীখানি তার বুনান হয়নি সারা।
হায়রে করুণ হায়,
এখনি যে সবে জাগিয়া উঠিবে প্রভাতের কিনারায়।
এখন হইবে লোক জানাজানি, মুখ চেনাচেনি আর,
হিসাব নিকাশ হইবে এখন কতটুকু আছে কার।
বিহগ ছাড়িয়া ভোরের ভজন আহারের সন্ধ্যানে,
বাতাসে বাঁধিয়া পাখা-সেতু-বাঁধ ছুটিবে সুদুর-পানে।
শূন্য হাওয়ার শূন্য ভরিতে বুকখানি করি শুনো,
ফুলের দেউল হবে না উজাড় আজিকে প্রভাতে পুন।
তরুণ কিশোর ছেলে,
আমরা আজিকে ভাবিয়া না পাই তুমি হেথা কেন এলে?
তুমি ভাই সেই ব্রজের রাখাল, পাতার মুকুট পরি,
তোমাদের রাজা আজো নাকি খেলে গেঁয়ো মাঠখানি ভরি।
আজো নাকি সেই বাঁশীর রাজাটি তমাল-লতার ফাঁদে,
চরণ জড়ায়ে নূপুর হারায়ে পথের ধূলায় কাঁদে
কে এলে তবে ভাই,
সোনার গোকুল আঁধার করিয়া এই মথুরার ঠাই।
হেথা যৌবন মেলিয়া ধরিয়া জমা-খরচের খাতা,
লাভ লেকাসান নিতেছে বুঝিয়া খুলিয়া পাতায় পাতা।
ওপারে কিশোর, এপারে যুবক, রাজার দেউল বাড়ি,
পাষাণের দেশে কেন এলে ভাই। রাখালের দেশ ছাড়ি?
তুমি যে কিশোর তোমার দেশেতে হিসাব নিকাশ নাই,
যে আসে নিকটে তাহারেই লও আপন বলিয়া তাই।
আজিও নিজেরে বিকাইতে পার ফুলের মালার দামে,
রূপকথা শুনি তোমাদের দেশে রূপকথা-দেয়া নামে।
আজো কানে গোঁজ শিরীষ কুসুম কিংশুক-মঞ্জরী,
অলকে বাঁধিয়া পাটল ফুলেতে ভরে লও উত্তরী!
আজিও চেননি সোনার আদর, চেননি মুক্তাহার,
হাসি মুখে তাই সোনা ঝরে পড়ে তোমাদের যারতার।
সখালী পাতাও সখাদের সাথে, বিনামূলে দাও প্রাণ,
এপারে মোদের মথুরার মত নাই দান-প্রতিদান।
হেথা যৌবন যত কিছু এর খাতায় লিখিয়া লয়,
পান হতে চুন খসেনাক-এমনি হিসাবময়।
হাসিটি হেথায় বাজারে বিকায় গানের বেসাত করি,
হেথাকার লোক সুরের পরাণ ধরে মানে লয় ভরি।
হায়রে কিশোর হায়!
ফুলের পরাণ বিকাতে এসেছ এই পাপ-মথুরায়