Site icon BnBoi.Com

রঙিলা নায়ের মাঝি – জসীম উদ্দীন

রঙিলা নায়ের মাঝি - জসীম উদ্দীন

আজ আমার মনে ত না মানেরে

আজ আমার মনে ত না মানেরে
সোনার চান,
বাতাসে পাতিয়া বুকরে
শুনি আকাশের গান।
আজ নদীতে উঠিয়া ঢেউ আমার কূলে আইসা লাগে,
রাতের তারার সাথে ঘরের প্রদীপ জাগেরে।
চান্দের উপর বসাইয়ারে যেবা গড়ছে চান্দের বাসা,
আজ দীঘিতে শাপলা ফুটে তারির লয়ে আশারে।
উড়িয়া যায় হংসরে পঙ্খী, যায়রে বহুত দূর,
আজ তরলা বাঁশের বাঁশী টানে সেই সুররে।
আজ কাঙ্খের কলসী ধইরারে কান্দে যমুনার জল,
শিমূলের তুলা লয়ে বাতাস পাগলরে।

আমার বন্ধু বিনোদিয়ারে

আমার বন্ধু বিনোদিয়ারে
প্রাণ বিনোদিয়া;
আমি আর কতকাল রইব আমার
মনেরে বুঝাইয়ারে;
প্রাণ বিনোদিয়া।
কি ছিলাম, কি হইলাম সইরে, কি রূপ হেরিয়া,
আমি নিজেই যাহা বুঝলাম না সই, কি কব বুঝাইয়ারে;
প্রাণ বিনোদিয়া।
চোখে তারে দেখলাম সইরে! পুড়ল তবু হিয়া,
আমার নয়নে লাগিলে আনল নিবাইতাম কাঁদিয়ারে;
প্রাণ বিনোদিয়া।
মরিব মরিব সইরে যাইব মরিয়া,
আমার সোনা বন্ধুর রূপ দিও গরলে গুলিয়ারে;
প্রাণ বিনোদিয়া।
আগে যদি জানতাম বন্ধু যাইবা ছাড়িয়া,
আমি ছাপাইয়া রাখতাম তোমার পাঁজর চিরিয়ারে;
প্রাণ বিনোদিয়া।

আরে ও রঙিলা নায়ের মাঝি

আরে ও রঙিলা নায়ের মাঝি।
তুমি এই ঘাটে লাগায়ারে নাও
লিগুম কথা কইয়া যাও শুনি।
তোমার ভাইটাল সুরের সাথে সাথে কান্দে গাঙের পানি,
ও তার ঢেউ লাগিয়া যায় ভাসিয়া কাঙ্খের কলসখানি।
পূবালী বাতাসে তোমার নায়ের বাদাম ওড়ে,
আমার শাড়ীর অঞ্চল ধৈরয না ধরে।
তোমার নি পরাণরে মাঝি হারিয়াছে কেউ;
কলসী ভাসায়া জলে গণেছ নি ঢেউ।

উজান গাঙের নাইয়া

উজান গাঙের নাইয়া!
কইবার নি পাররে নদী
গেছে কতদূর?
যে কূল ধইরা চলেরে নদী
সে কূল ভাইঙ্গা যায়,
আবার আলসে ঘুমায়া পড়ে
সেই কূলেরি গায়;
আমার ভাঙা কূলে ভাসাই তরীরে
যদি পাই দেখা বন্ধুর।
নদীর পানি শুনছি নাকি
সায়র পানে ধায়,
আমার চোখের পানি মিলব যায়া
কোন সে দরিয়ায়
সেই অজানা পারের লাইগারে
আমার কান্দে ভাটির সুর।

ও আমার গহিন গাঙের নায়া

ও আমার গহিন গাঙের নায়া,
ও তুমি অফর বেলায় লাও বায়া যাওরে-
কার পানে বা চায়া।
ভাটির দ্যাশের কাজল মায়ায়,
পরাণডা মোর কাইন্দা বেড়ায়রে-
আবছা মেঘে হাতছানি দ্যায়,
কে জানি মোর সয়া।

এই না গাঙের আগের বাঁকে
আমার বধূর দ্যাশ;
কলাবনের বাউরি বাতাস
দোলায় মাথার ক্যাশ;
কওই খবর তাহার লাইগা,
কাইন্দা মরে এক অভাইগারে;
ও তার ব্যথার দেয়া থাইকা থাইকা
ঝরে নয়ন বায়া।

ও তুই যারে আঘাত হানলিরে মনে

ও তুই যারে আঘাত হানলিরে মনে সেজন কি তোর পর,
সে ত তোরি তরে কেন্দে কেন্দে বেড়ায় দেশান্তর;
রে বন্ধু!
তোরি তরে সাজাইলাম বন-ফুলের ঘর,
রে বন্ধু মন-ফুলের ঘর,
ও তুই ভোমর হয়া হানলি কাঁটা সেই না ফুলের পর;
রে বন্ধু!
এক ঘরেতে লাগলে আগুন পোড়ে অনেক ঘর,
মনের আগুন মনই পোড়ায়-নাই কোন দোসর;
রে বন্ধু!
আগে যদি জানতামরে তোর রূপে আগুর জ্বলে,
আমি রূপ থুইয়া আগুনের মালা পরতাম নিজ গলে,
রে বন্ধু!
চিতার অনলে ঝাঁপ দেই যেই জন,
ও তার দেহও পোড়ে, মনও পোড়ে, পোড়ে তার ক্রন্দন;
রে বন্ধু!
রূপের আগুন মনেই লাগে, লাগে না কার গায়,
ও সে মনে মনেই মন জ্বালা কেউ না জানে হায়,
রে বন্ধু!
তীর যদি বেন্ধে গায়ে, তাও তো তোলন যায়,
ও তোর কথার আঘাত কোথায় লাগে কেউ নাহি টের পায়;
রে বন্ধু!

ও মোহন বাঁশী

ও মোহন বাঁশী!
বাজাও বাজাওরে কানাই!
ধীরে অতি ধীরে;
আমি জল আনিতে যমুনাতে,
ও বাঁশী শুনব ফিরে ফিরেরে কানাই!
ধীরে অতি ধীরে।
কলসী ভরার ছলে,
তোমার ছায়া দেখব জলেরে কানাই!
আমি হারায়ে পায়ের নূপুর,
ও ঘরে নাহি যাব ফিরেরে কানাই।
ধীরে অতি ধীরে।

তোমার বাঁশীর স্বরে
যদি কলসীর জল নড়েরে,
তারে ঘুম পাড়াবরে,
কাঁকণ বাজাইয়া করেরে কানাই!
আমি কেমনে মানাব আমার
নয়নের নীরের কানাই!
ধীরে অতি ধীরে।

নদীর কূল নাই-কিনার নাইরে

নদীর কূল নাই-কিনার নাইরে;
আমি কোন কূল হইতে কোন কূলে যাব
কাহারে শুধাইরে?
ওপারে মেঘের ঘটা, কনক বিজলী ছটা,
মাঝে নদী বহে সাঁই সাঁইরে;
আমি এই দেখিলাম সোনার ছবি
আবার দেখি নাইরে;
আমি দেখিতে দেখিতে সে রূপ
আবার দেখি নাইরে।

বেসম নদীর পানি, ঢেউ করে হানাহানি,
ভাঙা এ তরনী তবু বাইরে,
আমার অকূলের কূল দয়াল বন্ধুর
যদি দেখা পাইরে।

নিশিতে যাইও ফুলবনে

নিশিতে যাইও ফুলবনে
রে ভোমরা
নিশিতে যাইও ফুলবনে।
জ্বালায়ে চান্দের বাতি
আমি জেগে রব সারা রাতি গো;
কব কথা শিশিরের সনে
রে ভোমরা!
নিশিতে যাইও ফুলবনে।

যদিবা ঘুমায়ে পড়ি-
স্বপনের পথ ধরি গো,
যেও তুমি নীরব চরণে
রে ভোমরা!
(আমার ডাল যেন ভাঙে না,
আমার ফুল যেন ভাঙে না,
ফুলের ঘুম যেন ভাঙে না)।
যেও তুমি নীরব চরণে
রে ভোমরা!
নিশিতে যাইও ফুলবনে।

বাঁশরী আমার হারায়ে গিয়েছে

বাঁশরী আমার হারায়ে গিয়েছে
বালুর চরে,
কেমনে ফিরিব গোধন লইয়া
গাঁয়ের ঘরে।

কোমল তৃণের পরশ লাগিয়া,
পায়ের নুপুর পড়িয়াছে খসিয়া।
চলিতে চরণ ওঠে না বাজিয়া
তেমন করে।

কোথায় খেলার সাথীরা আমার
কোথায় ধেনু,
সাঝেঁর হিয়ায় রাঙিয়া উঠিছে
গোখুর-রেণু।

ফোটা সরিষার পাঁপড়ির ভরে
চরো মাঠখানি কাঁপে থরে থরে।
সাঁঝের শিশির দুচরণ ধরে
কাঁদিয়া ঝরে।

সিন্দুরের বেসাতি

(রূপক নাটিকা)

ওলো সোনার বরণী,
তোমার সিন্দুর নি নিবারে সজনি!
রাঙা তোমার ঠোঁটরে কন্যা, রাঙা তোমার গাল,
কপালখানি রাঙা নইলে লোকে পাড়বে গালরে;
তোমার সিন্দুর নি নিবারে সজনি!
সাঁঝের কোলে মেঘরে-তাতে রঙের চূড়া,
সেই মেঘে ঘষিয়া সিন্দুর করছি গুঁড়া গুঁড়ারে,
তোমরা সিন্দুর নি নিবারে সজনি!
এই না সিন্দুর পরিয়া নামে আহাশেতে আড়া,
এই সিন্দুরের বেসাতি করতে হইছি ঘর-ছাড়ারে;
তোমরা সিন্দুর নি নিবারে সজনি!
কাণা দেয়ায় ঝিলিক মারে কালা মেঘায় ফাঁড়ি,
তোমার জন্য আনছি কন্যা মেঘ-ডম্বুর শাড়ীরে;
তোমরা সিন্দুর নি নিবারে সজনি!
শাড়ীখানি পর কন্যা, সিন্দুর খানি পর,
আঙ্খের পলক দেইখা আমি যাই হাপনার ঘররে;
তোমরা সিন্দুর নি নিবারে সজনি!

থাক থাক বানিয়ারে নিরালে বসিয়া
মা-ধনের আগে আমি আসি জিজ্ঞাসিয়া।
শোন শোন ওহে মা-ধন! শুনিয়া ল তোর কানে,
আমি তো যাব মা-ধন বানিয়ার দোকানে।
এক ধামা দাও ধান আমি কিনিব পুঁতির মালা
আরো ধামা দাও ধান আমি কিনিব হাতের বালা।

বিদেশী বানিয়ারে! বোঝা তোমার মাথে,
দেখাও দেখি কি কি জিনিস আছে তোমার সাথে?

আমার কাছে সিন্দুর আছে ওই না ভালের শোভা,
তোমার রাঙা-ঠোঁটের মত দেখতে মন-লোভা।

আমরা তো জানি না সিন্দুর কেমনে পরে,
আমরা তো দেখি নাই সিন্দুর কাহারো ঘরে।

সোনার বরণ কন্যারে! দীঘল মাথার ক্যাশ,
সিন্দুর পরাইতে পারি যাও যদি মোর দ্যাশ।
ঘরে আছে ভাইয়ের বৌ লক্ষ্মীর সমান,
তোমার মাথায় সিন্দুর দিয়া জুড়াইব প্রাণ।

শোন শোন বানিয়ারে কই তোমার আগে,
তোমার না সিন্দুর লইতে কত দাম লাগে?

আমার না সিন্দুর লইতে লাগে হাসিমুখ,
আমার না সিন্দুর লইতে লাগে খুশীবুক।

নিলাম নিলাম, সিন্দুর নিলাম হাসি-মুখে কিনি,
আরো কি ধন আছে তোমার আমরা নি তা চিনি?

আরো আছে হাতের শাঁখা, আছে গলার হার,
নাকের বেশর নথও আছে সোনার বাঁধা তার।

আমরা তো নাহি জানি বানিয়া শাঁখা বলে কারে,
দেখি নাই তো নথের শোভা সোনাবান্ধা তারে।

সোনার বরণ কন্যা, তোমার সোনার হাত পাও,
শাঁখা যদি না পরিলে কিসের সুখ পাও?
সাতো ভাইয়ের সাতো বউ সাতো নথ নাকে,
পূব-দুয়াইয়া বাড়ি মোদের উজ্জল কইরা থাকে।

শোন শোন বানিয়ারে কই তোমার আগে,
তোমার না নথ ও শাঁখায় কত দাম লাগে?

আমার না শাঁখা লইতে লাগে হাসিমুখ,
আমার না নথ লইতে লাগে খুশীবুক।
নিলাম, নিলাম, নথও নিলাম, নিলাম, তোমার শাঁখা,
তোমার কথা বানিয়ারে রিদ্রে রইলো আঁকা।

ওই বিদেশী বানিয়া মোরে
পাগল করিয়া গেছে,
আমার মন কাড়িয়া নেছেরে সজনি!
শাঁখা না কিনিতে আমি হাতে বাঁধলাম ডোর;
সিঁথার সিন্দুর কিনে চক্ষে দেখি ঘোর!
নথ না কিনিয়া আমি পন্থে করনু বাসা,
একেলা কান্দিয়া ফিরি লয়ে তারি আশা।

Exit mobile version