বনের পরে বন চলেছে বনের নাহি শেষ,
ফুলের ফলের সুবাস ভরা এ কোন্ পরীর দেশ?
নিবিড় ছায়ায় আঁধার করা পাতার পারাবার,
রবির আলো খন্ড হয়ে নাচছে পায়ে তার।
সুবাস ফুলের বুনোট করা বনের লিপিখানি,
ডালের থেকে ডালের পরে ফিরছে পাখি টানি।
কচি কচি বনের পাতা কাঁপছে তারি সুরে,
ছোট ছোট রোদের গুড়ো তলায় নাচে ঘুরে,
মাথার পরে কালো কালো মেঘেরা এসে ভেড়ে
বুনো হাতীর দল এসেছে আকাশখানি ছেড়ে।
এই বনেতে আসমানীদের নেইকো অধিকার,
জীর্ণ পাঁজর বুকের হাড়ে জ্বলছে অনাহার।
নদীর পরে নদী গেছে নদীর নাহি শেষ,
কত অজান গাঁ পেরিয়ে কত না-জান দেশ।
সাত সাগরের পণ্য চলে সওদাগরের নায়,
সুধার ধারা গড়িয়ে পড়ে গঞ্জ নগর ছায়।
চখায় মুকর বালুর চরা হাসে কতই তীরে,
ফুলের বনে রঙিন হয়ে যায় বা কভু ধীরে;
কত মিনার-সৌধ চূড়ার কোল ঘেঁষিয়া যায়,
কত শহর হাট-বন্দর বাজার ফেলে বায়।
কত নায়ের ভাটিয়ালীর গানে উদাস হয়ে,
নদীর পরে নদী চলে কোন অজানায বয়ে।
সেই নদীতে আসমানীদের নেইক অধিকার,
জীর্ণ পাঁজর বুকের হাড়ে জ্বলছে হাহাকার।
বস্তীর মেয়ে
বস্তীর বোন, তোমারে আজিকে ছেড়ে চলে যেতে হবে,
যত দূরে যাব তোমাদের কথা চিরদিন মনে রবে।
মনে রবে, সেই ভ্যাঁপসা গন্ধ অন্ধ-গলির মাঝে,
আমার সে ছোট বোনটির দিন কাটিছে মলিন সাজে।
পেটভরা সে যে পায় না আহার, পরনে ছিন্নবাস,
দারুণ দৈন্য অভাবের মাঝে কাটে তার বারোমাস।
আরো মনে রবে, সুযোগ পাইলে তার সে ফুলের প্রাণ,
ফুটিয়া উঠিত নানা রঙ লয়ে আলো করি ধরাখান।
পড়িবার তার কত আগ্রহ, একটু আদর দিয়ে,
কেউ যদি তারে ভর্তি করিত কোন ইস্কুলে নিয়ে;
কত বই সে যে পড়িয়া ফেলিত জানিত সে কত কিছু,
পথ দিয়ে যেতে জ্ঞানের আলোক ছড়াইত, পিছু পিছু!
নিজে সে পড়িয়া পরেরে পড়াত, তাহার আদর পেয়ে,
লেখাপড়া জেনে হাসিত খেলিত ধরনীর ছেলেমেয়ে।
হায়রে দুরাশা, কেউ তারে কোন দেবে না সুযোগ করি,
অজ্ঞানতার অন্ধকারায় রবে সে জীবন ভরি।
তারপর কোন মূর্খ স্বামীর ঘরের ঘরনী হয়ে,
দিনগুলি তার কাটিবে অসহ দৈন্যের বোঝা বয়ে।
এ পরিনামের হয় না বদল? এই অন্যায় হতে
বস্তীর বোন, তোমারে বাঁচাতে পারিবনা কোনমতে?
ফুলের মতন হাসিখুশী মুখে চাঁদ ঝিকি মিকি করে,
নিজেরে গলায়ে আদর করিয়া দিতে সাধ দেহ ভরে।
তুমি ত কারুর কর নাই দোষ, তবে কেন হায়, হায়,
এই ভয়াবহ পরিনাম তব নামিছে জীবনটায়।
এ যে অন্যায়, এ যে অবিচার, কে রুখে দাঁড়াবে আজ,
কার হুঙ্কারে আকাশ হইতে নামিয়া আসিবে বাজ।
কে পোড়াবে এই অসাম্য-ভরা মিথ্যা সমাজ বাঁধ,
তার তরে আজ লিখিয়া গেলাম আমর আর্তনাদ।
আকাশে বাতাসে ফিরিবে এ ধ্বনি, দেশ হতে আর দেশে,
হৃদয় হইতে হৃদয়ে পশিয়া আঘাত হানিবে এসে।
অশনি পাখির পাখায় চড়িয়া আছাড়ি মেঘের গায়,
টুটিয়া পড়িবে অগ্নি জ্বালায় অসাম্য ধারাটায়!
কেউটে সাপের ফণায় বসিয়া হানিবে বিষের শ্বাস,
দগ্ধ করিবে যারা দশ হাতে কাড়িছে পরের গ্রাস।
আলো-বাতাসের দেশ হতে কাড়ি, নোংরা বস্তী মাঝে,
যারা ইহাদের করেছে ভিখারী অভাবের হীন সাজে;
তাহাদের তরে জ্বালায়ে গেলাম শ্মাশানে চিতার কাঠ,
গোরস্তানেতে খুঁড়িয়া গেলাম কবরের মহা-পাঠ।
কাল হতে কালে যুগ হতে যুগে ভীষণ ভীষণতর,
যতদিন যাবে ততজ্বালা ভরা হবে এ কন্ঠস্বর।
অনাহারী মার বুভুক্ষা জ্বালা দেবে এরে ইন্ধন,
দিনে দিনে এরে বিষায়ে তুলিবে পীড়িতের ক্রন্দন।
দুর্ভিক্ষের স্তন পিয়ে পিয়ে লেলিহা জিহ্বা মেলি,
আকাশ-বাতাস ধরণী ঘুরিয়া করিবে রক্ত কেলি।
বানর যুথ
গহন বনের মাঝে,
বুড়ো বটগাছ শিকড়ে- বাকলে জড়ায়েছে নানা সাজে।
জীর্ণ শীর্ণ বুকের পাঁজর গিয়াছে হইয়া ফাঁক,
তাহার মধ্যে বাসা বাঁধিয়াছে কোকিল শালিক কাক।
সাপের খোলস ঝুলে আছে কোথা, কোথাও শুকনো ডাল,
মহাযোগী বট ধ্যানে নিমগ্ন কত যুগ কত কাল।
সেদিন প্রভাতে বেড়াতে বেড়াতে হেরিলাম তার তলে,
বানরের দল ঘুমায়ে রয়েছে ধরিয়া এওর গলে।
কোন বা জননী, সন্তান মুখে চুমু দিয়ে দিয়ে আর,
সাধ মেটেনাক, নানাভাবে তারে আদরিছে বারবার!
কোন বা জননী ঘুমায়ে নিঝুম, সন্তানগুলি উঠে,
স্বেচ্ছায় দুধ করিতেছে পান মার স্তন হতে লুটে।
কোন বা দুষ্ট সন্তান তার চোখে ঘুমন্ত মার,
আঙ্গুল মাতা হয়ত এখনো স্বপ্ন জড়িত চোখে,
ছেলেদের তরে কোন সুখ-নীড় আঁকিছে বা আশা-লোকে।
কোন কোন মাতা ছোট ছেলেটিরে জাগায়ে দিতেছে মাই,
আছাড়ি পিছাড়ি কাঁদে হিংসায় পাশে তার বড় ভাই।
মাঘের প্রভাত, কনকনে হাওয়া বহিতেছে শীত করি,
শুয়ে আছে ওরা আদরে সোহাগে কাছাকাছি জড়াজড়ি
স্নেহ মমতার এমন দৃশ্য নির্জনে আঁকি আর
শত ফুল আঁখি মেলিয়া ইহারে দেখিতেছে বারবার।
প্রভাতের রবি আসিতে আসিতে থেমে যায় পথ ধারে;
কুয়াশা চাদরে রশ্মিরে ঢাকি রাখে যতখন পারে।
বন তার শাখা-বাহু বাড়াইয়া দিনেরে আড়াল করে,
যিশুর জননী এখানে আসিয়া দাঁড়াক গাছের তলে,
বৃন্দাবনের যশোদা আসুক গোপাল লইয়া কোলে;
ফাতেমা জননী আসুক বুকেতে হাসান হোসেন টানি;
দেখে যাক এই নির্জন বনে মমতার ছবিখানি।
ধীরে ধীরে ধীরে কুয়াশা আঁধার মুছিল রবির গায়,
বিহগ কুসুম সহস্রসুরে ফুটিল বনের ছায়।
গাছের পাতায় ফাঁকা পথ দিয়ে রবির আলোর ঢেলা;
ঘুমন্ত এই স্নেহপুরী মাঝে জুড়িল নিঠুর খেলা।
ধীরে ধীরে তারা জাগিয়া উঠিল, ছেলেরে স্কন্ধে করি,
আহারের খোঁজে চলিল জননী শাখাপথগুলি ধরি।
চলে দম্পতি ডাল হতে ডালে হতে ধরি পাকা ফল,
এ ওরে খাওয়ায় গান করে আর নেচে ফেরে চঞ্চল।
বৃদ্ধ এ বট, শূণ্য বুকেতে কত কি যে কথা ভরে,
উতলা বাতাসে কারে কি কহিছে বুঝি ফিস ফিস করে।
বাস্তু ত্যাগী