সারাদিন ভরি কতই সে কাঁদে, বড় ভাই তার আসে,
অশ্রুসিক্ত নয়নে বসিয়া রহে বিছানার পাশে।
ডাকিয়া সেদিন বলিলাম তারে, মায়েরে সঙ্গে করে,
আনেন না কেন? সারাদিন খোকা কাঁদে যে তাহার তরে।
ম্লান হাসি হেসে কহিল ভাইটি, আমরা যে খানদান,
আমাদের মেয়ে হেথায় আসিলে ভীষণ অসম্মান।
রাতের বেলায় সকল বেডের রোগীরা ঘুমায়ে পড়ে,
খোকাটি কেবল চীৎকারি কাঁদে মায়েরে তাহার স্মরে।
প্রহরের পর প্রহর চলেছে, আম্মাগো কাছে আয়,
এত ডাক ডাকি তবু না আসিস আমার যে জান যায়।
প্রহরের পর প্রহর চলেছে, আম্মাগো, মোর ঘুড়ি,
পূবের ঘরেতে রেখে দিস যেন কেউ নাহি করে চুরি।
মারবল আর পেন্সিল দুটো, কখানা টুকরো কাঁচ,
সাবধানে তুই রাখিস যেন না কেউ পায় তার আঁচ।
প্রহরের পর প্রহর চলেছে, আম্মাগো, কাছে আয়,
কে যেন আমারে ধরিতে আসিছে ভীষণ চেহারা হায়,
আম্মাগো কারা আমারে মারিছে। প্রহর চলেছে বেয়ে,
কাঁদিছে উতল রাতের পবন বড় যেন ব্যথা পেয়ে।
আমি দেখিতেছি বেঘুম শয়নে, সুদূর হেরেম কোণে,
জাগিছে জননী, নিশির প্রদীপ জাগিছে তাহার সনে।
জাগিছে জননী, রাত-জাগা পাখি, রহিয়া রহিয়া জাগে,
রাত কুসুমের উদাস গন্ধ চিরিতেছে বুকটাকে।
জাগিছে জননী, দুই হাতে যদি পারিত ছিড়িয়া দিতে,
ছেলে হতে তার কোন ব্যবধান রাখিত না ধরনীতে।
পরদা প্রথার যে মিথ্যা আজি দুলালের তার হায়,
এমনি করিয়া করেছে পৃথক ভাঙিত সে আজি তায়।
আহারে মায়ের দীরঘ নিশাস কোথায় নাহিক লাগে,
ঘুরিয়া ঘুরিয়া আপনারি বুকে আরও ব্যথা হয়ে দাগে।
ধীরে ধীরে দীপ নিবিয়া আসিল ম্লান হয়ে এল আলো,
নিবিড় নীরব নিথর পাথারে জড়ালো রাতের কালো।
সব অভিযোগ ব্যথাতুর সেই বালকের মুখ হতে,
ধীরে ধীরে ধীরে ভেসে গেল কোন মহানীরবতা স্রোতে।
কোথা সেই স্বর থামিল যাইয়া, বহু বহুযুগ আগে-
যারা মরিয়াছে কঠিন পীড়নে সমাজনীতির দাগে;
যারা সহিয়াছে সহস্র ব্যথা ভাষাহীন বেদনায়,
মূক বালকের বেদনা মিলিল সে মহা নীরবতায়।
জলের কন্যা
জলের উপরে চলেছে জলের মেয়ে,
ভাঙিয়া টুটিয়া আছড়িয়া পড়ে ঢেউগুলি তটে যেয়ে।
জলের রঙের শাড়ীতে তাহার জড়ায়ে জড়ায়ে ঘুরি,
মাতাল বাতাস অঙ্গের ঘ্রাণ ফিরিছে করিয়া চুরি।
কাজলে মেখেছে নতুন চরের সবুজ ধানের কায়া,
নয়নে ভরেছে ফটিকজলের গহন গভীর মায়া।
তাহার উপর ছায়া-চুরি খেলা করিতে তটের বন,
সুবাস ফুলের গন্ধ ছড়ায়ে হাসিতেছে সারাখন।
জলের কন্যা চলেছে জলের রথে,
খুশীতে ফুটিয়া শাপলা-পদ্ম হাসিতেছে পথে পথে।
আগে আগে চলে কলজলধারা ভাসায়ে পানার তরী,
চরণে তাহার আলতা পরাতে হিজল পড়িছে ঝরি।
ডাহুক ডাহুকী ডাকে বন-পথে নতুন পানির সুরে,
কোঁড়া আজ তার কুঁড়ীরে খুঁজিছে ঘন পাট-ক্ষেতে দূরে;
পুরাতন জালে তালি দিতে দিতে ঢলিয়া জেলের গায়,
জেলে বোর মন মিহিসুরী গানে উজানীর বাঁকে ধায়।
পল্লীবধূরা উদাস নয়নে চেয়ে থাকে তটপানে,
বাপের বাড়ির মমতায় আজ পরাণ কেন যে টানে।
বাঙড়ের খালে সিনান করিতে কলসী ধরিয়া টানি,
মায়েরে কহিছে মেয়ের কথাটি নয়া-জোয়ারের পানি!
হোগরার ছই নতুন বাঁধিয়া গাব-জলে মাজা নায়,
বাপ চলিয়াছে মেয়েরে আনিতে সুদূরের ভিন গাঁয়।
বৈঠার ঘায়ে গলা জলে-ডোবা নাচিছে আমন ধান,
কলমির লতা জড়াইয়া তারে ফুলহাসি করে দান!
ঢ্যাপের মোয়ার চিত্রিত হাঁড়ি আবার ভরিয়া যায়,
পিঠায় আঁকিয়া নতুন নকশা রাত ভোর করে মায়।
জলের কন্যা চলেছে জলের পরে,
মাছেরা চলছে দলে দলে আজ পথটি তাহার ধরে।
রুহিত লাফায়, চিতল ফালায়, ভাটা মাছ সারি সারি,
সাথে সাথে যায় আগে পিছে ধায় খুশী যেন ওরা তারি।
শোল মাছ তার শিশুপোনাগুলি ছড়ায়ে লেজের ঘায়,
টুবটুব করে আদরিয়া পুন জড়াইছে বুক-ছায়;
নকসী কাঁথাটি মেলিয়া ধরিয়া গুমরে চাষার নারী,
সযতনে যেন গুটায়ে ধরিছে বুকের নিকটে তারি।
জলঘাসগুলি ঈষৎ কাঁপিছে তাদের চলার দোলে,
মৃদুল বাতাসে ঝুমিতেছে বন জলের দুনিয়া কোলে।
জলের কন্যা যায়,
নতুন পানির লিখন বহিয়া বন্ধ বিলের ছায়।
তটের বক্ষে আছাড়িয়া মাথা ক্ষতবিক্ষত করি,
বন্দী-মাছেরা কাটাইত দিন জীয়নে- যেন মরি।
অঙ্গ ভরিয়া শ্যাওলা জড়ান নির্জীব ঘুম-দোলে,
রোগ-পান্ডুর অসাড় দেহ যে পড়িতে চাহিছে ঢলে।
আজিকে নতুন জল-কল্লোল শুনিতে পেয়েছে তারা,
সহসা অঙ্গে হিল্লোলি ওঠে উধাও গতির ধারা!
কে যেন ঘোষিছে তাহাদের কানে সহস্র দিক হতে,
ভাঙ্ ভাঙ্ কারা ভাঙ্ ভাঙ্ পাড় উদ্দাম জলস্রোতে।
জলের কন্যা জল-পথ দিয়ে যায়,
বকের ছানারা পাখার আড়াল রচিছে তাহার গায়।
দুইধারে ঘন কেয়ার কুঞ্জ ছড়ায় সুবাস-রেণু
মাতাল বাতাস রহিয়া রহিয়া চুমিছে বনের বেনু।
তটে তটে কাঁদে শূন্য কলসী, কুটীরের দীপ ডাকে,
আঙিনার বেলী মাটিতে লুটায়, কে কুড়ায়ে লবে তাকে?
তারাবি
তারাবি নামাজ পড়িতে যাইব মোল্লাবাড়িতে আজ,
মেনাজদ্দীন, কলিমদ্দীন, আয় তোরা করি সাজ।
চালের বাতায় গোঁজা ছিল সেই পুরাতন জুতা জোড়া,
ধুলাবালু আর রোদ লেগে তাহা হইয়াছে পাঁচ মোড়া।
তাহারি মধ্যে অবাধ্য এই চরণ দুখানি ঠেলে,
চল দেখি ভাই খলিলদ্দীন, লুন্ঠন-বাতি জ্বেলে।
ঢৈলারে ডাক, লস্কর কোথা, কিনুরে খবর দাও।
মোল্লাবাড়িতে একত্র হব মিলি আজ সার গাঁও।