Site icon BnBoi.Com

ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে – জসীম উদ্দীন

ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে - জসীম উদ্দীন

গীতারা কোথায় গেল

গীতারা কোথায় গেলো,
আহা সেই পুতুলের মতো রাঙা টুকটুকে মেয়ে।
দেখলে তাহারে মায়া মমতার ধারা বয়ে যায়
সারা বুকখানি ছেয়ে,
আদরি তাহারে কথা না ফুরায়
কথার কুসুম আকাশে বাতাসে উঠে বেয়ে,
দেখলে তাহারে ছাড়ায় ছড়ায় ছড়ায় যে মন
গড়ায় ধরণী ছেয়ে।
ওদের গ্রামের চারিদিক বেড়ি ঘিরেছে দস্যুদল,
ঘরে ঘরে তারা আগুন জ্বালায়ে ফুকারে অগ্নিকল।
সেই কচি মেয়ে কোলে তুলে নিতে কোল যে জুড়িয়ে যেত,
কে মারিল তারে ? মানুষ কি পারে নিষ্ঠুর হতে এত।
অফুট কুসুম কে দলেছে পায়ে? কথার সে বুলবুলি,
কোন নিষ্ঠুর বধেছে তাহারে গলায় আঙ্গুল তুলি ?

সে বন-হরিণী নিষ্ঠুর হতে পালাবার লাগি
হেথায় হোথায় কত না ঘুরেছে হায়।
সারা গাঁও করি উথাল পাথাল বাণ-বিদ্ধ যে করিয়াছে ব্যাধ তায়।
আহারে আমার ছোট গীতামণি,
তোর তরে আজ কেঁদে ফিরি সবখানে,
মোর ক্রদন নিঠুর দেশের সীমানা পেরিয়ে
পারিবে কি যেতে কোন দরদীয় কানে।

ধামরাই রথ

ধামরাই রথ, কোন অতীতের বৃদ্ধ সুত্রধর,
কতকাল ধরে গড়েছিল এরে করি অতি মনোহর।
সূক্ষ্ম হাতের বাটালি ধরিয়া কঠিন কাঠেরে কাটি,
কত পরী আর লতাপাতা ফুল গড়েছিল পরিপাটি।
রথের সামনে যুগল অশ্ব, সেই কত কাল হতে,
ছুটিয়া চলেছে আজিও তাহারা আসে নাই কোন মতে।

তারপর এলো নিপুণ পটুয়া, সূক্ষ্ম তুলির ঘায়,
স্বর্গ হতে কত দেবদেবী আনিয়া রথের গায়।
রঙের রেখার মায়ায় বাঁধিয়া চির জনমের তরে,
মহা সান্ত্বনা গড়িয়া রেখেছে ভঙ্গুর ধরা পরে।

কৃষ্ণ চলেছে মথুরার পথে, গোপীরা রথের তলে,
পড়িয়া কহিছে, যেওনা বন্ধু মোদের ছাড়িয়া চলে।
অভাগিনী রাধা, আহা তার ব্যথা যুগ যুগ পার হয়ে,
অঝোরে ঝরিছে গ্রাম্য পোটোর কয়েকটি রেখা লয়ে।

সীতারে হরিয়া নেছে দশানন, নারীর নির্যাতন
সারা দেশ ভরি হৃদয়ে হৃদয়ে জ্বালায়েছে হুতাশন।
রাম-লক্ষ্মণ সুগ্রীব আর নর বানরের দল,
দশমুন্ড সে রাবণে বধিয়া বহালো লহুর ঢল।
বস্ত্র হরণে দ্রৌপদী কাঁদে, এ অপমানের দাদ,
লইবারে সাজে দেশে দেশে বীর করিয়া ভীষণ নাদ।
কত বীর দিল আত্ম-আহুতী, ভগ্ন শঙ্খ শাঁখা।
বোঝায় বোঝায় পড়িয়া কত যে নারীর বিলাপ মাথা।
শ্মশান ঘাটা যে রহিয়া রহিয়া মায়েদের ক্রদনে,
শিখায় শিখায় জ্বলিছে নির্বিছে নব নব ইন্ধনে।

একদল মরে, আর দল পড়ে ঝাপায়ে শক্র মাঝে,
আকাশ ধরণী সাজিল সে-দিন রক্তাশ্বর সাজে।
তারপর সেই দুর্যধনের সবংশ নিধনিয়া,
ধর্ম রাজ্য প্রতিষ্ঠিত যে হলো সারা দেশ নিয়া।
এই ছবিগুলি রথের কাঠের লিলায়িত রেখা হতে,
কালে কালে তাহা রুপায়িত হতো জীবন দানের ব্রতে।
নারীরা জানিত, এমনি ছেলেরা সাজিবে যুদ্ধ সাজে,
নারী-নির্যাতন-কারীদের মহানিধনের কাজে।

বছরে দু-বার বসিত হেথায় রথ-যাত্রার মেলা,
কত যে দোকান পসারী আসিত কত সার্কাস খেলা।
কোথাও গাজীর গানের আসরে খোলের মধুর সুরে।
কত যে বাদশা বাদশাজাদীরা হেথায় যাইত ঘুরে।
শ্রোতাদের মনে জাগায়ে তুলিত কত মহিমার কথা,
কত আদর্শ নীতির ন্যায়ের গাঁথিয়া সুরের লতা।
পুতুলের মত ছেলেরা মেয়েরা পুতুল লইয়া হাতে।
খুশীর কুসুম ছড়ায়ে চলিত বাপ ভাইদের সাথে।
কোন যাদুকর গড়েছিল রথ তুচ্ছ কি কাঠ নিয়া,
কি মায়া তাহাতে মেখে দিয়েছিল নিজ হৃদি নিঙাড়িয়া।
তাহারি মায়ায় বছর বছর কোটী কোটী লোক আসি,
রথের সামনে দোলায়ে যাইত প্রীতির প্রদীপ হাসি।

পাকিস্তানের রক্ষাকারীরা পরিয়া নীতির বেশ,
এই রথখানি আগুনে পোড়ায়ে করিল ভস্মশেষ।
শিল্পী হাতের মহা সান্ত্বনা যুগের যুগের তরে,
একটি নিমেষে শেষ করে গেল এসে কোন বর্বরে।

বঙ্গ-বন্ধু

(১৯৭১ সনের ১৬ই মার্চে লিখিত )

মুজিবর রহমান।
ওই নাম যেন বিসুভিয়াসের অগ্নি-উগারী বান।
বঙ্গদেশের এ প্রান্ত হতে সকল প্রান্ত ছেয়ে,
জ্বালায় জ্বলিছে মহা-কালানল ঝঞঝা-অশনি বেয়ে ।
বিগত দিনের যত অন্যায় অবিচার ভরা-মার।
হৃদয়ে হৃদয়ে সঞ্চিত হয়ে সহ্যে অঙ্গার ;
দিনে দিনে হয়ে বর্ধিত স্ফীত শত মজলুম বুকে,
দগ্ধিত হয়ে শত লেলিহান ছিল প্রকাশের মুখে ;
তাহাই যেন বা প্রমূর্ত হয়ে জ্বলন্ত শিখা ধরি
ওই নামে আজ অশনি দাপটে ফিরিছে ধরণী ভরি।

মুজিবর রহমান।
তব অশ্বেরে মোদের রক্তে করায়েছি পূত-স্নান।
পীড়িত-জনের নিশ্বাস তারে দিয়েছে চলার গতি,
বুলেটে নিহত শহীদেরা তার অঙ্গে দিয়েছে জ্যেতি।
দুর্ভিক্ষের দানব তাহারে অদম্য বল,
জঠরে জঠরে অনাহার-জ্বালা করে তারে চঞ্চল।
শত ক্ষতে লেখা অমর কাব্য হাসপাতালের ঘরে,
মুর্হুমুহু যে ধবনিত হইছে তোমার পথের পরে।
মায়ের বুকের ভায়ের বুকের বোনের বুকের জ্বালা,
তব সম্মুখ পথে পথে আজ দেখায়ে চলিছে আলা।
জীবন দানের প্রতিজ্ঞা লয়ে লক্ষ সেনানী পাছে,
তোমার হুকুম তামিলের লাগি সাথে তব চলিয়াছে।
রাজভয় আর কারাশৃঙ্কল হেলায় করেছ জয়।
ফাঁসির মঞ্চে-মহত্ব তব কখনো হয়নি ক্ষয়।
বাঙলাদেশের মুকুটবিহীন তুমি প্রমুর্ত রাজ,
প্রতি বাঙালীর হৃদয়ে হৃদয়ে তোমার তক্ত-তাজ।
তোমার একটি আঙ্গুল হেলনে অচল যে সরকার।
অফিসে অফিসে তালা লেগে গেছে-স্তব্ধ হুকুমদার।

এই বাঙলায় শুনেছি আমরা সকল করিয়া ত্যাগ,
সন্ন্যাসী বেশে দেশ-বন্ধুর শান্ত-মধুর ডাক।
শুনেছি আমরা গান্ধীর বাণী-জীবন করিয়া দান,
মিলাতে পারেনি প্রেম-বন্ধনে হিন্দু-মুসলমান।
তারা যা পারেনি তুমি তা করেছ, ধর্মে ধর্মে আর,
জাতিতে জাতিতে ভুলিয়াছে ভেদ সন্তান বাঙলার।

সেনাবাহিনীর অশ্বে চড়িয়া দম্ভ-স্ফীত ত্রাস,
কামান গোলার বুলেটের জোরে হানে বিষাক্ত শ্বাস।
তোমার হুকুমে তুচ্ছ করিয়া শাসন ত্রাসন ভয়,
আমরা বাঙালীর মৃত্যুর পথে চলেছি আনিতে জয়।

ধন্য এ কবি ধন্য এ যুগে রয়েছে জীবন লয়ে,
সম্মুখে তার মহাগৌরবে ইতিহাস চলে বয়ে।
ভুলিব না সেই মহিমার দিন, ভাষার আন্দোলনে ।
বুরেটের ভয় তুচ্ছ করিয়া ছেলেরা দাঁড়াল রণে ।
বরকত আর জব্বার আর সালাম পথের মাঝে,
পড়ে বলে গেলো, “আমরা চলিনু ভাইরা আসিও পাছে।”
উত্তর তার দিয়েছে বাঙালী, জানুয়ারী সত্তরে,
ঘরের বাহির হইল ছেলেরা বুলেটের মহা-ঝড়ে।
পথে পথে তারা লিখিল লেখন বুকের রক্ত দিয়ে,
লক্ষ লক্ষ ছুটিল বাঙালী সেই বাণী ফুকারিয়ে।
মরিবার সে কি উন্মাদনা যে, ভয় পালাইল ভয়ে,
পাগলের মত ছোট নর-নারী মৃত্যুরে হাতে লয়ে।
আরো একদিন ধন্য হইনু সে মহাদৃশ্য হেরি,
দিকে দিগনে- বাজিল যেদিন বাঙালীর জয়ভেরী।
মহাহুঙ্কারে কংস-কারার ভাঙিয়া পাষাণ দ্বার,
বঙ্গ-বঙ্গ শেখ মুজিবেরে করিয়া আনিল বার।
আরো একদিন ধন্য হইব, ধন-ধান্যেতে ভরা,
জ্ঞানে-গরিমায় হাসিবে এদেশ সীমিত-বসুন্ধরা।
মাঠের পাত্রে ফসলেরা আসি ঋতুর বসনে শোভি,
বরণে সুবাসে আঁকিয়া যাইবে নকসী-কাঁথার ছবি।
মানুষ মানুষ রহিবে না ভেদ, সকলে সকলকার,
এক সাথে ভাগ করিয়া খাইবে সম্পদ যত মার।
পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নদীর রুপালীর তার পরে,
পরাণ ভুলানো ভাটিয়ালী সুর বাজিবে বিশ্বভরে।
আম-কাঁঠালের ছায়ায় শীতল কুটিরগুলির তলে,
সুখ যে আসিয়া গড়াগড়ি করি খেলাইবে কুতুহলে।

আরো একদিন ধন্য হইব চির-নির্ভীকভাবে,
আমাদরে জাতি নেতার পাগড়ি ধরিয়া জবাব চাবে,
“কোন অধিকারে জাতির স্বার্থ করিয়াছ বিক্রয়?”
আমার এদেশ হয় যেন সদা সেইরুপ নির্ভয়।

Exit mobile version