Site icon BnBoi.Com

বালুচর – জসীম উদ্দীন

বালুচর - জসীম উদ্দীন

আর একদিন আসিও বন্ধু

আর একদিন আসিও বন্ধু-আসিও এ বালুচরে,
বাহুতে বাঁধিয়া বিজলীর লতা রাঙা মুখে চাঁদ ভরে।
তটিনী বাজাবে পদ-কিঙ্কিণী, পাখিরা দোলবে ছায়া,
সাদা মেঘ তব সোনার অঙ্গে মাখাবে মোমের মায়া।
আসিও সজনি, এই বালুচলে, আঁকা-বাঁকা পথখানি;
এধারে ওধারে ধান ক্ষেত তারে লয়ে করে টানাটানি।
কখনো সে গেছে ওধারে বাঁকিয়া কখনো এধারে আসি,
এরে ওরে লয়ে জড়াজড়ি করে ছড়ায় ধুলার হাসি।
এহ পথ দিয়ে আসিও সজনি, প্রভাতে ও সন্ধ্যায়,
দিগন্ত জোড়া ধানের ক্ষেতের গন্ধ মাখিয়া গায়।
চরের বাতাস বাতাস করিয়া শীতল করিছে যারে,
সেই পথে তুমি চরণ ফেলিয়া আসিও এ নদী পারে।

আর একদিন আসিও সজনি, এ মোর কামনাখানি,
মুখ বালুচরে আখর এঁকেছি নখরে নখর হানি।
লিখিয়াছি তাহা পাখির পাখায় মোর নিঃশ্বাস ঘায়ে,
আর লিখিয়াছি দুর গগনের কনক মেঘের ছায়ে।
সেই সব তুমি পড়িয়া পড়িয়া অলস অবশ কায়,
এইখানে এসে থামিও বন্ধু মোর বেনুবন-ছায়া।
এই বেনুবন মোর সাথে সাথে কাঁদিয়াছে বহুরাতি,
পাতায় পাতায় জড়াজড়ি করি উতল পবনে মাতি।
এইখানে সখি। সাক্ষ্য হইয়া রাতের প্রহরগুলি,
কত যে কঠোর বেদনা আমার তোমারে বলিবে খুলি।

রাত-জাগা পাখি কহিবে তোমারে, আমার বে-ঘুম রাতি,
কাটিতে কাটিতে কি করে নিবেছে একে একে সব বাতি।
সেইখানে তুমি বসিও সজনি।মনে না রাখিও ডর,
সেদিন আমার যত কথা সখি। এই মুক মাটি তলে,
মোর সাথে সাথে ঘুমায়ে রহিবে মহা-মৃত্যুর কোলে।

এই নদী তটে বরষ বরষ ফুলের মহোৎসবে;
আসিবে যাহারা তাহাদের মাঝে মোর নাম নাহি রবে।
সেদিন কাহারো পড়িবে না মনে, অভাগা গাঁয়ের কবি,
জীবনের কোন কনক বেলায় দেখেছিল কার ছবি।
ফুলের মালায় কে লিখিল তারে গোরের নিমন্ত্রণ,
কে দিল তাহারে ধুপের ধোঁয়ায় নিদারুণ হুতাশণ।

সেদিন কাহারো পড়িবে না মনে কথা এই অভাগার,
জনিবে না কেউ কত বড় আশা জীবনে আছিল তার।
ধরণীর বুকে প্রদীপ রাখি সে, আকাশের ডাক দিত-
মাটির কলসে জল ভরে সে যে তটিনীরে বুকে নিত।
এত বড় আশা কি করে ভাঙিল, কি করে জীবন ভোরে,
রঙ-কুহেলির সোনার স্বপন ভাঙিল সিঁধেল চোরে।
এসব সেদিন স্মরিবে না কেহ, দুঃখ নাহিক তায় ;
যে গেল তাহারে ফিরায়ে আনিতে পিছু-ডাকে নাহি হায়।
যে দুখে আমার জীবন দহিল সে দুখের স্মৃতি রাখি,
সবার মাঝারে রহিব যে বেঁচে, এর চেয়ে নাই ফাঁকি।

তুমিও আমারে ভেবো না সেদিন, আমার দুঃখ ভার।
এতটুকু ব্যথা নাহি আনে যেন কোনদিন মনে কার।
এ মোর জীবনে তোমার হাতের পেয়েছিনু অবহেলা,
এই গৌরব রহিল আমার ভরিতে জীবন ভেলা।
তুমি দিয়াছিলে আমারে আঘাত, তারি মহা-মহিমায়
সবার আঘাত দলিয়া এসেছি এ মোর চরণ ঘায়।
তোমারে আমার লেগেছিল ভাল, আর সব ভাল তাই।
আমার জীবনে এতটুকু দাগ কেহ কভু আঁকে নাই।
তোমার নিকটে পেয়েছিনু ব্যথা তারি গেীরব ভরে,
আর সব ব্যথা খড়কুটা সম ছিঁড়িয়াছি নখে ধরে।

তুমি দিয়েছিলে ক্ষুধা,
অবহেলে তাই ছাড়িয়া এসেছি জগতের যত সুধা।
এ জীবনে মোর এই গৌরব, তোমারে যে পাই নাই,
আর কারো কাছে না পাওয়ার ব্যথা সহিতে হয়নি তাই।
তোমার নিকটে কণিকা না পেয়ে আমি হয়েছিনু ধনী-
আমার কুটীরে ছড়াছড়ি যেত রতন মানিক মণি।

তাই আজ শুভখনে-
মোর পরে তব যত অন্যায় আনিও না কভু মনে।
আমারে যে ব্যথা দিয়েছিলে তুমি, তাতে নাহি মোর দুখ,
তুমি সুখে ছিলে, মোর সাথে রবে সেই স্মরণের সুখ।
আর একদিন আসিও সজনি। মোর কন্ঠের ডাক।
যতদিন তুমি না আসিবে যেন নাহি হয় নির্ব্বাক।
এ মোর কামনা পাখি হয়ে যেন এই বালুচরে ফেরে,
যেন বাজ হয়ে গগনে গগনে মেঘের বসন ছেঁড়ে।
এই কথা আমি ভরে রেখে যাই খর-তটিনীর জলে,
যেন দুই কুল ভাঙিয়া সে চলে আপনার কল্লোলে।
আর একদিন আসিও সজনি। এ আমার অভিশাপ।
যত দিন যাবে পলে পলে এর বাড়িবে ভীষণ তাপ।
এই বাসনার ইন্ধন জ্বালি সাজালেম যেই হোম,
কাল-নটেশের চরণের তালে জ্বলে যেন নির্স্মম।
যেন তারি দাহ সপ্ত আকাশ ভেদিয়া উপরে ধায়,
চন্দ্র-সুর্য মুরছিয়া পড়ে তারি নিশ্বাস ঘায়।
যেন সে বহ্নি শত ফণা মেলি করে বিষ উদগার,
তারি দাহ হতে তুমি যেন কভু নাহি পাও উদ্ধার।
যতদিনে তুমি এই বালুচলে নাহি আস পুন ফিরে,
আজি এই কথা লিখে রেখে যাই বালুকার বুকে চিলে।

উড়ানীর চর

উড়ানীর চর ধূলায় ধূসর
যোজন জুড়ি,
জলের উপরে ভাসিছে ধবল
বালুর পুরী।

ঝাঁকে বসে পাখি ঝাঁকে উড়ে যায়
শিথিল শেফালি উড়াইয়া বায়;
কিসের মায়ায় বাতাসের গায়
পালক পাতি;
মহা কলতানে বালুয়ার গানে
বেড়ায় মাতি।

উড়ানীর চরে কৃষাণ-বধূর
খড়ের ঘর,
ঢাকাই সীমের উড়িছে আঁচল
মাথার পর।

জাঙলা ভরিয়া লাউ এর লতায়
লক্ষ্মী সে যেন দুলিছে দোলায়;
ফাল্গুনের হাওয়া কলার পাতায়,
নাচিছে ঘুরি;
উড়ানী চরের বুকের আঁচল
কৃষাণ-পুরি।

উড়ানীর চর উড়ে যেতে চায়
হাওয়ার টানে;
চারিধারে জল করে ছল ছল
কি মায়া জানে।

ফাগুনের রোদ উড়াইয়া ধূলি,
বুকের বসন নিতে চায় খুলি;
পদ ধরি জল কলগান তুলি,
নূপুর নাড়ে;
উড়ানীর চর চিক্ চিক্ করে
বালুর হারে।

উড়ানীর চরে ছাড়-পাওয়া রোদ
সাঁঝের বেলা-
বালু লয়ে তার মাখামাখি করি
জমায় খেলা।

কৃষানী কি বসি সাঁঝের বেলায়
মিহি চাল ঝাড়ে মেঘের কুলায়,
ফাগের মতন কুঁড়া উঠে যায়
আলোক ধারে;
কচি ঘাসে তারা জড়াজড়ি করে
গাঙের পারে।

উড়নীর চরে তৃণের অধরে
রাতের রানী,
আঁধারের ঢেউ ছোঁয়াইয়া যায়
কি মায়া টানি।

বিরতী কৃষাণ বাজাইয়া বাঁশী,
কাল-রাতে মাখে কাল-ব্যথারাশি;
থেকে থেকে চর শিহরিয়া ওঠে,
বালুকা উড়ে;
উড়ানীর চর ব্যথায় ঘুমায়
বাঁশীর সুরে।

কাল সে আসিবে

কালকে সে নাকি আসিবে মোদের ওপারের বালুচরে,
এ পারের ঢেউ ওপারে লাগিছে বুঝি তাই মনে করে।
বুঝি তাই মনে করে,
বাউল বাতাস টানাটানি করে বালুর আঁচল ধরে।
কাল সে আসিবে, মুখখানি তার নতুন চরের মত,
চখা আর চখী নরম ডানায় মুছায়ে দিয়েছে কত।
চরের চাষীর ধানের খেতের মতই তাহার গা,
কোথাবা হলুদ, আব্ছা হলুদ, কোথাবা হলুদ না।

কাল সে আসিবে, হাসিয়া হাসিয়া রাঙা মুখখানি ভরি,
এপারে আমার পাতার কুটিরে আমি কি বা আজ করি!
কাল সে আসিবে, ওই বালুচরে, ওপারে আমার ঘর,
তাজ পরে নদী-ঘাটের ডিঙা কাঁপে নদীটির পর।
কাল সে আসিবে, নোঙর ছিঁড়িল, দুলিছে নায়ের পাল,
কারে হারায়েছি, কারে যেন আমি দেখি নাই কতকাল।
ওপারেতে চর বালু লয়ে খেলে, উড়ায় বালুর রথ,
ওখানে সে কাল দুটি রাঙা পায়ে ভাঙিয়া যাইবে পথ।
কাল সে আসিবে ওই বালুচরে, আমি কি আবার হায়,
আসমান-তারা শাড়ীখানি আজ উড়াব সারাটি গায়?
রামলক্ষ্মণ শঙ্খ দুগাছি পরিব আবার হাতে,
খোঁপায় জড়াব কিংশুক-কলি, কাজল চোখের পাতে;
গলায় কি আজ পরিতে হইবে পদ্ম-রাগের মালা,
কানাড়া ছান্দে বাঁধিব কি বেনী কপালে সিঁদুর জ্বালা?
কাল সে আসিবে, মিছাই ছিঁড়িছি আঁধারের কালো কেশ,
আজকের রাত পথ ভুলে বুঝি হারাল ঊষার দেশ।

এই বালুচরে আসিবে সে কাল, তরে রাঙা মুখে ভরি,
অফুট ঊষার সোনার কমল আসিবে সোহাগে ধরি।
সে আসিবে কাল, গলায় পরিয়া কুসুম ফুলের হার,
দুখানি নূপুর মুখর হইবে চরণে জড়ায়ে তার।
মাথায় বাঁধিবে দুধালীর লতা কচি সীমপাতা কানে,
বেণুর অধর চুমিয়া চুমিয়া মুখর করিবে গানে।
কাল সে আসিবে, রাই সরিষাল হলদী কোটার শাড়ী,
মটর কনেরে সাথে করে যেন খুলে দেখে নাড়ি নাড়ি।

কাল সে আসিবে ওই বালুচরে, ধারে তার এই নদী,
তারি কূলে মোর ভাঙা কুঁড়ে ঘর, বহুদূরে নয় যদি;
তবু কি তাহার সময় হইবে হেথায় চরণ ধরি,
মোর কুঁড়ে ঘর দিয়ে যাবে হায়, মণি-মানিকেতে ভরি।
সে কি ওই চরে দাঁড়ায়ে দেখিবে বরষার তরুগুলি,
শীতের তাপসী কারে বা স্মরিছে আভরণ গার খুলি?
হয়ত দেখিবে, হয় দেখিবে না;
কাল সে আসিবে চরে,
এপারে আমার ভাঙা ঘরখানি, আমি থাকি সেই ঘরে।

কাল সে আসিয়াছিল

কাল সে আসিয়াছিল ওপারের বালুচরে,
এতখানি পথ হেঁটে এসেছিল কি জানি কি মনে করে।
কাশের পাতায় আঁচড় লেগেছে তাহার কোমল গায়,
দুটি রাঙা পায়ে আঘাত লেগেছে কঠিন পথের ঘায়।
সারা গাও বেয়ে ঘাম ঝরিতেছে, আলসে অবশ তনু,
আমার দুয়ারে দাঁড়াল আসিয়া দেখিয়া অবাক হনু।

দেখিলাম তারে- যার লাগি একা আশা-পথ চেয়ে থাকি,
এই বালুচরে মাথা কুটে কুটে ফুকারিয়া যারে ডাকি।
দেখিলাম তারে- যার লাগিএই উদাস ঝাউ-এর বন,
বরষ বরষ মোর গলা ধরি করিয়াছে ক্রন্দন।
দেখিলাম তারে, তবু কেন হায় বলিতে নারিনু ডাকি,
কোন অপরাধে আমার ললাটে দিলে এত ব্যথা আঁকি!
বলিতে নারিনু, ওগো পরবাসী, দেখিতে এলে কি তাই,
আগুন জ্বেলেছ যেই ঘন-বনে সেকি পুড়ে হল ছাই!
এলে কি দেখিতে-দূর হতে যারে হেনেছিলে বিষ-বাণ,
সে বন বিহগী বেঁচে আছে কিবা জীবনের অবসান!
বলিতে নারিনু, নিঠুর পথিক, কেন এলে মিছামিছি
অলস চরণ, অবশ দেহটি, সারা গায়ে ঘাম, ছি ছি!
এতখানি পথ হাঁটিয়া এসেছে কত না কষ্ট সহি,
তারি কাছে মোর দুখের কাহিনী কেমন করিয়া কহি!

নয়নের জল মুছিয়া ফেলিনু, মুখে মাখিলাম হাসি,
কহিলাম, বুঝি পূর্বের সুরুয সাঁঝেতে উদিল আসি!
আঁচলে তাহারে বাতাস করিণু চরণ দুখানি ধূয়ে,
মাথার কেশেতে মুছাইয়া দিয়ে বসিলাম কাছে নুয়ে!
কহিলাম-বড় ভাগ্য আমার, আজিকার দিনখানি,
এমনি করিয়া রাখাযায় নাকি দুই হাতে যদি টানি!

রবির চলার পথ,
আজিকার তরে ভুলিতে পারে না অস্ত পারের পথ?
কৌটায় ভরে সিঁদুর ত রাখি, আজিকার দিন হায়,
এমনি করিয়া কৌটার মাঝে ভরে কি রাখা না যায়!
এই দিনটিরে মাথায় কেশেতে বেঁধে রাখা যায়নাকি!
মিছেমিছি কত বকিয়া গেলাম ছাই পাশ থাকি থাকি।
শুনে সে কেবল হাসি-মুখে তার আরও মাখাইল হাসি,
সেই রাঙা মুখে- যে মুখেরে আমি এত করে ভালবাসি।

মুখেতে মাখিল হাসি,
সোনা দেহখানি নাড়া দিয়ে গেল বুঝি হাওয়া ফুল-বাসী!
কাল এসেছিল এই বালুচরে আর মোর কুঁড়ে ঘরে-
তার পাশে চলে ছোট্ট নদীটি দুইখানি তীর ধরে।
সেই দুই তীরে রবি-শস্যেতে দিগন্ত গেছে ভরি-
রাই সরিষার জড়াজড়ি করে ফুলের আঁচল ধরি।
তারি এক তীরে বাঁকা পথখানি, দীঘল বালুর লেখা,
সেই পথ দিয়ে এসেছিল কাল আঁকিয়া পায়ের রেখা।
কাল এসেছিল, চখা আর চখী এ ওরে আদর করি,
পাখা নেড়েছিল, তারি ঢেউ লাগি নদী উঠেছিল নড়ি।
তারি ঢেউ বুঝি ভেসে এসেছিল আমার পাতার ঘরে-
বহুদিন পরে পেয়েছিনু তারে শুধু কালিকার তরে।

কালিকার দিন, মেরু- কুহেলির অনন্ত আঁধিয়ারে
শুধু একখানা আলোক- কমল ফুটেছিল এক ধারে।
মহা-সাগরের দিগন্ত-জোড়া ফেন-লহরীর পরে
প্রদীপ-তরনী ভেসে এসেছিল বুঝি এ ব্যথার ঝড়ে!
কালকে তাহারে পেয়েছিনু আমি, হায়, হায়, কত-কাল,
যারে ভাবি এই শূনো বালুচরে চিতায় দিয়েছি জ্বাল;
সেই তারে হায়, দেখিয়া নারিনু খুলিয়া দেখাতে আমি
এই জীবনের যত হাহাকার উঠিয়াছে দিন-যামী, –
যে আগুনে আমি জ্বলিয়া মরেছি, সে-দাবদাহন আনি
কোন্ প্রাণে আমি নারী হয়ে সেই ফুলের তনুতে হানি!

শুধু কহিলাম-পরাণ বন্ধু! তুমি এলে মোর ঘরে,
আমি ত জানিনে কি করে যে আজ তোমারে আদর করে!
বুকে যে তোমারে রাখিব বন্ধু, বুকেতে শ্মাশান জ্বলে;
নয়নে রাখিব! হায়রে অভাগা, ভাসিয়া যাইবে জলে!
কপালে রাখিব! এ ধরার গাঁয়ে আমার কপাল পোড়া;
মনে যে রাখিব! ভেঙে গেছে সে যে কভু নারে লাগে জোড়া!
সে কেবল শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে চাহিল আমার পানে;
ও যেন আরেক দেশের মানুষ, বোঝে না ইহার মানে।

সামনে বসায়ে দেখিলাম তারে, দেখিলাম সেই মুখ।
ভাবিলাম ওই সুমেরু হইতে কি করে যে আসে দুখ।
দেখিতে দেখিতে সকাল কাটিল, দুপুরের উঁচু বেলা,
পশ্চিম দেশে গড়ায়ে পড়িল মেঘেতে আঁকিয়া খেলা।
বালুচর হতে বিদায় মাগিল নতুন বকের সারি,
পাখায় পাখায় আকাশের বুকে শেফালীর ফুল নাড়ি।

সে মোরে কহিল“দিন চলে গেল, আমি তবে আজ আসি?
-যার রাঙা মুখ ফুলের মতন, তাতে মাখা মিঠে হাসি।
সে মোরে কহিল, একটি কথায় ভাঙিল স্বপন মোর,
ভাঙিল তাহার সোনার চুড়াটি, ভাঙিল সকল দোর।
সে মোরে কহিল, “শোন তাপসিনি। আজকের মত তবে,
বিদায় হইনু, আবার আসিব মোর খুশী হবে যবে।”
হাসিয়াই তারে কহিলাম, “সখা বিদায় সমস্কার”
অভাগিনী আমি রুষিতে নারিনু নয়ন জলের ধার।
খানিক যাইয়া ফিরিয়া চাহিল, কহিল আমারে, “নারি।
কোন কিছু কয়ে ব্যথা দেছি তোমা, কেন চোখে তব বারি?”
আমি কহিলাম, “সুন্দর সখা, আমার নয়ন ধার-
পাইয়াও যেগো পাইবে তোমারে ভাষা এই বেদনার।’

“ আমি কি নিঠুর?” সে মোরে শুধাল, আমি কহিলাম, “নয়।
ফুলেরো আঘাত গায়ে লাগে যার, কে তারে নিঠুর কয়?
গলায় যাহারে মালা দেই নাক হয়ত মালার ভারে,
তাহার কোমল ফুলের অঙ্গে কোন ব্যথা দিতে পারে ।

ছুঁইনা যাহারে ভয়ে,
ও দেহ-তরুর অফুট কুসুম যদি পড়ে হায় খয়ে।
সে মোরে দিয়েছে এই এত জ্বালা এ-কথা ভাবিব যবে
রোজ-কেয়ামত ভেঙে পড়ে যেন আমার মাথায় তবে।”
“তবে কেন কাঁদ? হায় তাপসিনি।জীবনের ভোরখানি,
কার হেলা পেয়ে আজিকে এনেছ মরণের দেশে টানি।”
আমি কহিলাম-“সোনার বন্ধু এ-মোর ললট-লেখা
কেউ পারিবে না মুছাইয়া দিতে ইহার গভীর রেখা।

মাথার পসরাখানি,
মাথায় লইয়া চলিতে হইবে সমুখে চরণ টানি।
এ-জীবনে কেউ দোসর হবে না, নিবে না করিয়া ভাগ,
এই বুক ভরি জমায়েছি যত তীব্র বিষের দাগ।

তবু বলি সখা। কেন কাঁদি আমি, তোমারে দেখিয়া মোর,
কেন বয়ে যায় শাঙনের ধারা ভাঙিয়া নয়ন দোর।
আমি কাঁদি সখা, তুমি কেন হেথা মানুষ হইয়া এলে-
বিধির গড়া ত সবই পাওয়া যায়, মানুষের নাহি মেলে।
আকাশ গড়েছে শ্যাম-ঘন-নীল, দুধের নবনী মেঘে-
সন্ধ্যা সকাল প্রতিদিন যায় নব নব রুপ মেখে;
যত দুরে যাই তত দুরে পাই, কেউ নাহি করে মানা,
কেউ নাহি পারে কাড়িয়া লইতে মাথার আকাশখানা।
বিধাতা গড়েছে সুন্দর ধরা, কাননে কুসুম-কলি,
কোলে কোলে তার পাখি গাহে গান, গুঞ্জরে মধু অলি।
বাতাস চলেছে ফুল কুড়াইয়া পাখায় জড়ায়ে ঘ্রাণ-
যারে পায় তারে বিলাইয়া যায় ফুল-সখীদের দান।

তটিনী চলেছে গাহি-
তার জলে আজ সম-অধিকার, কারো কোন ব্যধা নাহি।
শুধু মানুষের পায়না মানুষ, নাহি কারো অধিকার,
মানুষ সবারে পাইল এভাবে। মানুষ হল না কার।
কেন তুমি সখা। মানুষ হইলে, অতটুকু দেহ ভরি,
বিশ্ব-জোড়া এ রুপ-পিপাসারে কেন রাখিয়াছ ধরি।
আমি কাঁদি সখা। কেন তুমি নাহি আকাশের মত হলে-
যেখানে যেতাম তোমারে পেতাম.দেখিতাম নানা ছলে।

আকাশের তলে ঘর

যারা বাঁধিয়াছে তাদের তৃষ্ণা অমনি বিপুলতর।
তুমি কেন সখা। কানন হলে না, ফুলের সোহাগ পরি-
রঙিন তোমার দেহ-নীপখানি পুলকে উঠিত ভরি।
বাউল বাতাসে ভাসিয়া যেতাম তোমার ফুলের বনে,
অনন্ত-তুষ্ণা মিটায়ে দিতাম অনন্ত-পাওয়া সনে।
কেন তুমি সখা। মানুষ হইলে। সীমারে বরণ করি-
অসীম ক্ষুধারে সীমার বেড়ার বাহিরে রেখেছ ধরি।
তুমি কেন সখা! এমন হলে না-যত দুরে যাইতাম
আকাশের মত যত দুরে চাহি তোমারেই পাইতাম।

আমি অনন্ত, আমি যে অসীম, অনন্ত মোর ক্ষুধা-
বিপুল এ-দেশে ভাসিয়েছ তুমি একটু সীমার সুধা।

হায় রে মানুষ হায়।

কেমন করিয়া পাব তারে, যারে ধরা ছোঁয়া নাহি যায়।
আমি কাঁদি কেন সুন্দর সখা।তোমারে বলিব খুলি।
এই বেদনায়, কেন তুমি এলে মানুষ হইয়া ভুলি?
যে মানুষ এই ধরারে দেখিছে নীতির চশমা পরি,
যার যাহা পায় তাই লয় সে যে পালায় ওজন করি।
জগৎ জুড়িয়া পাতিয়াছে যারা মনুসংসিতা বই-
আমি কাঁদি সখা! আর কিছু নও তুমি সে মানুষ বই।

জগতের মজা ভারি-

চোখ বেঁধে যারা ধরারে দেখিল তাহাদেরি নাম জারি।
বাহিরে হাসিছে নীতির জগৎ, তাহার আড়ালে বসি,
কাঁদে উভরায় উলঙ্গ নর পরি শাসনের রসি।
সে বলে যে আমি না ভাল মন্দ, আমি নর-নারায়ণ,
মহা-শক্তিরে বাঁধিয়া রেখেছে সংস্কার বন্ধন।
আমি কাঁদি সখা। আমার মাঝারে আছে সে আমার আমি,
মোর সুখে-দুখে মন্দ-ভালোয় সুনাম-কুনামে নামী ;
এ-জগতে কেউ চাহিল না তারে ; এ-মোর পসরাখানি,
যারে দিতে যাই, সেই ফিরে চায় হেলায় নয়ন টানি।

জগতের হাটে তাই
সে মোর আমারে খন্ড করিয়া দোকানে বিকায়ে যাই।
কেউ হাসি চায়, কেউ ভালবাসা, কেউ চায় মিঠে-কথা,
কেউ নিতে চায় নয়নের জল কেউ চায় এর ব্যথা।
শস্যের ক্ষেতে একেলা কৃষাণ বীজ ছড়াইয়া যাই-
কোথা পাপ কোথা পুণ্য ছড়ানু, কোন কিছু মনে নাই।
আমি কাঁদি সখা। হাটে-বেচা সেই খন্ড আমারে লয়ে,
যারে ভালবাসি-তাহার পূজায় কেমনে আনিব বয়ে।
হায় হায় সখা। তুমি কেন হলে হাটের দোকানদার-
খন্ড করিয়া চাহ যারে তুমি পূর্ণ চাহনা তার?

সব কথা মোর শুনে সে কেবল কহিল একটু হাসি-
“মোর যত কথা কব একদিন, আজকের মত আসি?”
পায়ে পায়ে পায়ে যতদুর গেল, নিমেষ রহিনু চেয়ে ;
সন্ধ্যা-তিমিরে কলস ডুবাল সাঁঝের রঙিন মেয়ে।
শূন্য চরের মাতাল বাতাস রাতের কুহেলি-কেশ
নাড়িয়া নাড়িয়া হয়রাণ হয়ে ফিরিল ঊষার দেশ।

কত দিন গেল, কত রাত এলো ঋতুর বসন পরি,
চলে কাল-নটী বরণে বরণে বরষের পথ ধরি।
আজো বসে আছি এই বালুচরে, দুহাত বাড়ায়ে ডাকি
কাল যে আসিল এই বালুচরে, আর সে আসিবে নাকি?

প্রতিদান

আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা, আমি বাঁধি তার ঘর,
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।
যে মোরে করিল পথের বিবাগী, –
পথে পথে আমি ফিরি তার লাগি।
দীঘল রজনী তার তরে জাগি ঘুম যে হরেছে মোর ;
আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর।

আমার এ কুল ভাঙিয়াছে যেবা আমি তার কুল বাঁধি,
যে গেছে বুকেতে আঘাত হানিয়া তার লাগি আমি কাঁদি;
সে মোরে দিয়েছে বিষে ভরা বাণ,
আমি দেই তারে বুকভরা গান;
কাঁটা পেয়ে তারে ফুল করি দান সারাটি জনম ভর,
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।

মোর বুকে যেবা কবর বেঁধেছে আমি তার বুক ভরি,
রঙিন ফুলের সোহাগ-জড়ান ফুল-মালঞ্চ ধরি ।
যে মুখে সে কহে নিঠুরিয়া বার্ণী,
আমি লয়ে সখি, তারি মুখখানি,
কত ঠাঁই হতে কত কি যে আনি, সাজাই নিরন্তর,
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।

 

Exit mobile version