কৃষানী কি বসি সাঁঝের বেলায়
মিহি চাল ঝাড়ে মেঘের কুলায়,
ফাগের মতন কুঁড়া উঠে যায়
আলোক ধারে;
কচি ঘাসে তারা জড়াজড়ি করে
গাঙের পারে।
উড়নীর চরে তৃণের অধরে
রাতের রানী,
আঁধারের ঢেউ ছোঁয়াইয়া যায়
কি মায়া টানি।
বিরতী কৃষাণ বাজাইয়া বাঁশী,
কাল-রাতে মাখে কাল-ব্যথারাশি;
থেকে থেকে চর শিহরিয়া ওঠে,
বালুকা উড়ে;
উড়ানীর চর ব্যথায় ঘুমায়
বাঁশীর সুরে।
কাল সে আসিবে
কালকে সে নাকি আসিবে মোদের ওপারের বালুচরে,
এ পারের ঢেউ ওপারে লাগিছে বুঝি তাই মনে করে।
বুঝি তাই মনে করে,
বাউল বাতাস টানাটানি করে বালুর আঁচল ধরে।
কাল সে আসিবে, মুখখানি তার নতুন চরের মত,
চখা আর চখী নরম ডানায় মুছায়ে দিয়েছে কত।
চরের চাষীর ধানের খেতের মতই তাহার গা,
কোথাবা হলুদ, আব্ছা হলুদ, কোথাবা হলুদ না।
কাল সে আসিবে, হাসিয়া হাসিয়া রাঙা মুখখানি ভরি,
এপারে আমার পাতার কুটিরে আমি কি বা আজ করি!
কাল সে আসিবে, ওই বালুচরে, ওপারে আমার ঘর,
তাজ পরে নদী-ঘাটের ডিঙা কাঁপে নদীটির পর।
কাল সে আসিবে, নোঙর ছিঁড়িল, দুলিছে নায়ের পাল,
কারে হারায়েছি, কারে যেন আমি দেখি নাই কতকাল।
ওপারেতে চর বালু লয়ে খেলে, উড়ায় বালুর রথ,
ওখানে সে কাল দুটি রাঙা পায়ে ভাঙিয়া যাইবে পথ।
কাল সে আসিবে ওই বালুচরে, আমি কি আবার হায়,
আসমান-তারা শাড়ীখানি আজ উড়াব সারাটি গায়?
রামলক্ষ্মণ শঙ্খ দুগাছি পরিব আবার হাতে,
খোঁপায় জড়াব কিংশুক-কলি, কাজল চোখের পাতে;
গলায় কি আজ পরিতে হইবে পদ্ম-রাগের মালা,
কানাড়া ছান্দে বাঁধিব কি বেনী কপালে সিঁদুর জ্বালা?
কাল সে আসিবে, মিছাই ছিঁড়িছি আঁধারের কালো কেশ,
আজকের রাত পথ ভুলে বুঝি হারাল ঊষার দেশ।
এই বালুচরে আসিবে সে কাল, তরে রাঙা মুখে ভরি,
অফুট ঊষার সোনার কমল আসিবে সোহাগে ধরি।
সে আসিবে কাল, গলায় পরিয়া কুসুম ফুলের হার,
দুখানি নূপুর মুখর হইবে চরণে জড়ায়ে তার।
মাথায় বাঁধিবে দুধালীর লতা কচি সীমপাতা কানে,
বেণুর অধর চুমিয়া চুমিয়া মুখর করিবে গানে।
কাল সে আসিবে, রাই সরিষাল হলদী কোটার শাড়ী,
মটর কনেরে সাথে করে যেন খুলে দেখে নাড়ি নাড়ি।
কাল সে আসিবে ওই বালুচরে, ধারে তার এই নদী,
তারি কূলে মোর ভাঙা কুঁড়ে ঘর, বহুদূরে নয় যদি;
তবু কি তাহার সময় হইবে হেথায় চরণ ধরি,
মোর কুঁড়ে ঘর দিয়ে যাবে হায়, মণি-মানিকেতে ভরি।
সে কি ওই চরে দাঁড়ায়ে দেখিবে বরষার তরুগুলি,
শীতের তাপসী কারে বা স্মরিছে আভরণ গার খুলি?
হয়ত দেখিবে, হয় দেখিবে না;
কাল সে আসিবে চরে,
এপারে আমার ভাঙা ঘরখানি, আমি থাকি সেই ঘরে।
কাল সে আসিয়াছিল
কাল সে আসিয়াছিল ওপারের বালুচরে,
এতখানি পথ হেঁটে এসেছিল কি জানি কি মনে করে।
কাশের পাতায় আঁচড় লেগেছে তাহার কোমল গায়,
দুটি রাঙা পায়ে আঘাত লেগেছে কঠিন পথের ঘায়।
সারা গাও বেয়ে ঘাম ঝরিতেছে, আলসে অবশ তনু,
আমার দুয়ারে দাঁড়াল আসিয়া দেখিয়া অবাক হনু।
দেখিলাম তারে- যার লাগি একা আশা-পথ চেয়ে থাকি,
এই বালুচরে মাথা কুটে কুটে ফুকারিয়া যারে ডাকি।
দেখিলাম তারে- যার লাগিএই উদাস ঝাউ-এর বন,
বরষ বরষ মোর গলা ধরি করিয়াছে ক্রন্দন।
দেখিলাম তারে, তবু কেন হায় বলিতে নারিনু ডাকি,
কোন অপরাধে আমার ললাটে দিলে এত ব্যথা আঁকি!
বলিতে নারিনু, ওগো পরবাসী, দেখিতে এলে কি তাই,
আগুন জ্বেলেছ যেই ঘন-বনে সেকি পুড়ে হল ছাই!
এলে কি দেখিতে-দূর হতে যারে হেনেছিলে বিষ-বাণ,
সে বন বিহগী বেঁচে আছে কিবা জীবনের অবসান!
বলিতে নারিনু, নিঠুর পথিক, কেন এলে মিছামিছি
অলস চরণ, অবশ দেহটি, সারা গায়ে ঘাম, ছি ছি!
এতখানি পথ হাঁটিয়া এসেছে কত না কষ্ট সহি,
তারি কাছে মোর দুখের কাহিনী কেমন করিয়া কহি!
নয়নের জল মুছিয়া ফেলিনু, মুখে মাখিলাম হাসি,
কহিলাম, বুঝি পূর্বের সুরুয সাঁঝেতে উদিল আসি!
আঁচলে তাহারে বাতাস করিণু চরণ দুখানি ধূয়ে,
মাথার কেশেতে মুছাইয়া দিয়ে বসিলাম কাছে নুয়ে!
কহিলাম-বড় ভাগ্য আমার, আজিকার দিনখানি,
এমনি করিয়া রাখাযায় নাকি দুই হাতে যদি টানি!
রবির চলার পথ,
আজিকার তরে ভুলিতে পারে না অস্ত পারের পথ?
কৌটায় ভরে সিঁদুর ত রাখি, আজিকার দিন হায়,
এমনি করিয়া কৌটার মাঝে ভরে কি রাখা না যায়!
এই দিনটিরে মাথায় কেশেতে বেঁধে রাখা যায়নাকি!
মিছেমিছি কত বকিয়া গেলাম ছাই পাশ থাকি থাকি।
শুনে সে কেবল হাসি-মুখে তার আরও মাখাইল হাসি,
সেই রাঙা মুখে- যে মুখেরে আমি এত করে ভালবাসি।
মুখেতে মাখিল হাসি,
সোনা দেহখানি নাড়া দিয়ে গেল বুঝি হাওয়া ফুল-বাসী!
কাল এসেছিল এই বালুচরে আর মোর কুঁড়ে ঘরে-
তার পাশে চলে ছোট্ট নদীটি দুইখানি তীর ধরে।
সেই দুই তীরে রবি-শস্যেতে দিগন্ত গেছে ভরি-
রাই সরিষার জড়াজড়ি করে ফুলের আঁচল ধরি।
তারি এক তীরে বাঁকা পথখানি, দীঘল বালুর লেখা,
সেই পথ দিয়ে এসেছিল কাল আঁকিয়া পায়ের রেখা।
কাল এসেছিল, চখা আর চখী এ ওরে আদর করি,
পাখা নেড়েছিল, তারি ঢেউ লাগি নদী উঠেছিল নড়ি।
তারি ঢেউ বুঝি ভেসে এসেছিল আমার পাতার ঘরে-
বহুদিন পরে পেয়েছিনু তারে শুধু কালিকার তরে।
কালিকার দিন, মেরু- কুহেলির অনন্ত আঁধিয়ারে
শুধু একখানা আলোক- কমল ফুটেছিল এক ধারে।
মহা-সাগরের দিগন্ত-জোড়া ফেন-লহরীর পরে
প্রদীপ-তরনী ভেসে এসেছিল বুঝি এ ব্যথার ঝড়ে!
কালকে তাহারে পেয়েছিনু আমি, হায়, হায়, কত-কাল,
যারে ভাবি এই শূনো বালুচরে চিতায় দিয়েছি জ্বাল;
সেই তারে হায়, দেখিয়া নারিনু খুলিয়া দেখাতে আমি
এই জীবনের যত হাহাকার উঠিয়াছে দিন-যামী, –
যে আগুনে আমি জ্বলিয়া মরেছি, সে-দাবদাহন আনি
কোন্ প্রাণে আমি নারী হয়ে সেই ফুলের তনুতে হানি!