হায় হায় পতি, তুমি ত জান না কি নিঠুর তার মন ;
সাজুর বেদনা সকলেই শোনে, শোনে না সে একজন |
গাছের পাতারা ঝড়ে পরে পথে, পশুপাখি কাঁদে বনে,
পাড়া প্রতিবেশী নিতি নিতি এসে কেঁদে যায় তারি সনে |
হায় রে বধির, তোর কানে আজ যায় না সাজুর কথা ;
কোথা গেলে সাজু জুড়াইবে এই বুক ভরা ব্যথা |
হায় হায় পতি, তুমি ত ছাড়িয়া রয়েছ দূরের দেশে,
আমার জীবন কি করে কাটিবে কয়ে যাও কাছে এসে !
দেখে যাও তুমি দেখে যাও পতি তোমার লাই-এর লতা,
পাতাগুলি তার উনিয়া পড়েছে লয়ে কি দারুণ ব্যথা |
হালের খেতেতে মন টিকিত না আধা কাজ ফেলি বাকি,
আমারে দেখিতে বাড়ি যে আসিতে করি কতরূপ ফাঁকি |
সেই মোরে ছেড়ে কি করে কাটাও দীর্ঘ বরষ মাস,
বলিতে বলিতে ব্যথার দহনে থেমে আসে যেন শ্বাস |
নক্সী-কাঁথাটি বিছাইয়া সাজু সারারাত আঁকে ছবি,
ও যেন তাহার গোপন ব্যথার বিরহিয়া এক কবি |
অনেক সুখের দুঃখের স্মৃতি ওরি বুকে আছে লেখা,
তার জীবনের ইতিহাসখানি কহিছে রেখায় রেখা |
এই কাঁথা যবে আরম্ভ করে তখন সে একদিন,
কৃষাণীর ঘরে আদরিনী মেয়ে সারা গায়ে সুখ-চিন |
স্বামী বসে তার বাঁশী বাজায়েছে, সিলাই করেছে সেজে ;
গুন গুন করে গান কভু রাঙা ঠোঁটেতে উঠেছে বেজে |
সেই কাঁথা আজো মেলিয়াছে সাজু যদিও সেদিন নাই,
সোনার স্বপন আজিকে তাহার পুড়িয়া হয়েছে ছাই |
খুব ধরে ধরে আঁকিল যে সাজু রূপার বিদায় ছবি,
খানিক যাইয়া ফিরে ফিরে আসা, আঁকিল সে তার সবি |
আঁকিল কাঁথায়—আলু থালু বেশে চাহিয়া কৃষাণ-নারী,
দেখিছে তাহার স্বামী তারে যায় জনমের মত ছাড়ি |
আঁকিতে আঁকিতে চোখে জল আসে, চাহনি যে যায় ধুয়ে,
বুকে কর হানি, কাঁথার উপরে পড়িল যে সাজু শুয়ে |
এমনি করিয়া বহুদিন যায়, মানুষে যত না সহে,
তার চেয়ে সাজু অসহ্য ব্যথা আপনার বুকে বহে |
তারপর শেষে এমনি হইল, বেদনার ঘায়ে ঘায়ে,
এমন সোনার তনুখানি তার ভাঙিল ঝরিয়া-বায়ে |
কি যে দারুণ রোগেতে ধরিল, উঠিতে পারে না আর ;
শিয়রে বসিয়া দুঃখিনী জননী মুছিল নয়ন-ধার |
হায় অভাগীর একটি মানিক ! খোদা তুমি ফিরে চাও,
এরে যদি নিবে তার আগে তুমি মায়েরে লইয়া যাও !
ফিরে চাও তুমি আল্লা রসুল ! রহমান তব নাম,
দুনিয়ায় আর কহিবে না কেহ তারে যদি হও বাম !
মেয়ে কয়, “মাগো ! তোমার বেদনা আমি সব জানি,
তার চেয়ে যেগো অসহ্য ব্যথা ভাঙে মোর বুকখানি !
সোনা মা আমার ! চক্ষু মুছিয়া কথা শোন, খাও মাথা,
ঘরের মেঝেয় মেলে ধর দেখি আমার নক্সী-কাঁথা !
একটু আমারে ধর দেখি মাগো, সূঁচ সুতা দাও হাতে,
শেষ ছবি খানা এঁকে দেখি যদি কোন সুখ হয় তাতে |”
পাণ্ডুর হাতে সূঁচ লয়ে সাজু আঁকে খুব ধীরে ধীরে,
আঁকিয়া আঁকিয়া আঁখিজল মুছে দেখে কত ফিরে ফিরে |
কাঁথার উপরে আঁকিল যে সাজু তাহার কবরখানি,
তারি কাছে এক গেঁয়ো রাখালের ছবিখানি দিল টানি ;
রাত আন্ধার কবরের পাশে বসি বিরহী বেশে,
অঝোরে বাজায় বাঁশের বাঁশীটি বুক যায় জলে ভেসে |
মনের মতন আঁকি এই ছবি দেখে বার বার করি,
দুটি পোড়া চোখ বারবার শুধু অশ্রুতে উঠে ভরি |
দেখিয়া দেখিয়া ক্লান্ত হইয়া কহিল মায়েরে ডাকি,
“সোনা মা আমার! সত্যিই যদি তোরে দিয়ে যাই ফাঁকি ;
এই কাঁথাখানি বিছাইয়া দিও আমার কবর পরে,
ভোরের শিশির কাঁদিয়া কাঁদিয়া এরি বুকে যাবে ঝরে !
সে যদি গো আর ফিরে আসে কভু, তার নয়নের জল,
জানি জানি মোর কবরের মাটি ভিজাইবে অবিরল |
হয়ত আমার কবরের ঘুম ভেঙে যাবে মাগো তাতে,
হয়ত তাহারে কাঁদাইতে আমি জাগিব অনেক রাতে |
এ ব্যথা সে মাগো কেমনে সহিবে, বোলো তারে ভালো করে,
তার আঁখি জল ফেলে যেন এই নক্সী-কাঁথার পরে |
মোর যত ব্যথা, মোর যত কাঁদা এরি বুকে লিখে যাই,
আমি গেলে মোর কবরের গায়ে এরে মেলে দিও তাই !
মোর ব্যথা সাথে তার ব্যথাখানি দেখে যেন মিল করে,
জনমের মত সব কাঁদা আমি লিখে গেনু কাঁথা ভরে |”
বলিতে বলিতে আর যে পারে না, জড়াইয়া আসে কথা,
অচেতন হয়ে পড়িল যে সাজু লয়ে কি দারুণ ব্যথা |
কানের কাছেতে মুখ লয়ে মাতা ডাক ছাড়ি কেঁদে কয়,
“সাজু সাজু ! তুই মোরে ছেড়ে যাবি এই তোর মনে লয় ?”
“আল্লা রসুল ! আল্লা রসুল !” বুড়ী বলে হাত তুলে,
“দীন দুঃখীর শেষ কান্না এ, আজিকে যেয়ো না ভুলে !”
দুই হাতে বুড়ী জড়াইতে চায় আঁধার রাতের কালি,
উতলা বাতাস ধীরে ধীরে বয়ে যায়, সব খালি ! সব খালি !!
“সোনা সাজুরে, মুখ তুলে চাও, বলে যাও আজ মোরে,
তোমারে ছাড়িয়া কি করে যে দিন কাটিবে একেলা ঘরে !”
দুখিনী মায়ের কান্নায় আজি খোদার আরশ কাঁপে,
রাতের আঁধার জড়াজড়ি করে উতল হাওয়ার দাপে |
******************
জালুয়া = জেলে
কশী কাঁথার মাঠ – ১৪
চৌদ্দ
উইড়া যায়রে হংস পক্ষি পইড়া রয়রে ছায়া ;
দেশের মানুষ দেশে যাইব—কে করিবে মায়া |
— মুর্শিদা গান
আজো এই গাঁও অঝোরে চাহিয়া ওই গাঁওটির পানে,
নীরবে বসিয়া কোন্ কথা যেন কহিতেছে কানে কানে |
মধ্যে অথই শুনো মাঠখানি ফাটলে ফাটলে ফাটি,
ফাগুনের রোদে শুকাইছে যেন কি ব্যথারে মূক মাটি!
নিঠুর চাষীরা বুক হতে তার ধানের বসনখানি,
কোন্ সে বিরল পল্লীর ঘরে নিয়ে গেছে হায় টানি !