তোমার দেশে যাব আমি পল্লী-দুলাল ভাইগো সোনার,
সেথায় পথে ফেলতে চরণ লাগবে পরশ এই মাটি-মার!
ডাকব সেথা পাখির ডাকে, ভাব করিব শাখীর সনে,
অজান ফুলের রূপ দেখিয়া মানব তারে বিয়ের কনে;
চলতে পথে ময়না কাঁটায় উত্তরীয় জড়িয়ে যাবে,
অঢেল মাটির হোঁচট লেগে আঁচল হতে ফুল ছড়াবে।
পল্লী-দুলাল, যাব আমি-যাব আমি তোমার দেশে,
তোমার কাঁধে হাত রাখিয়া-ফিরবো মোরা উদাস বেশে।
বনের পাতার ফাঁকে ফাঁকে দেখব মোরা সাঁঝ বাগানে,
ফুল ফুটেছে হাজার রঙের মেঘ তুলিকার নিখুঁত টানে।
গাছের শাখা দুলিয়ে আমি পাড়ব সে ফুল মনের আশে,
উত্তরীয় ছড়িয়ে তুমি দাঁড়িয়ে থেকো বনের পাশে।
যে ঘাটেতে ভরবে কলস গাঁয়ের বিভোল পল্লীবালা,
সেই ঘাটেরি এক ধারেতে আসবো রেখে ফুলের মালা;
দীঘির জলে ঘট বুড়াতে পথে পাওয়া মালাখানি,
কুড়িয়ে নিয়ে ভাববে ইহা রাখিয়া গেছে কেউ না জানি।
চেনে না তার হাতের মালা হয়তবা সে পরবে গলে,
আমরা দুজন থাকব বসে ঢেউ দোলা সেই দীঘির কোলে।
চার পাশেতে বনের সারি এলিয়ে শাখার কুন্তল-ভার,
দীঘির জলে ঢেউ গণিবে ফুল শুঁকিবে পদ্ম-পাতার।
বনের মাঝে ডাকবে ডাহুক, ফিরবে ঘুুঘু আপন বাসে,
দিনের পিদিম ঢুলবে ঘুমে রাত-জাগা কোন্ ফুলের বাসে।
চার ধারেতে বন জুড়িয়া রাতের আঁধার বাঁধবে বেড়া,
সেই কুহেলীর কালো কারায় দীঘির জলও পড়বে ঘেরা।
সেই আঁধারে পাখায় ধরে চামচিকারা উচ্চে উঠি,
দিকে দিকে দিগনে-রে ছড়িয়ে দেবে মুঠি মুঠি।
তখন সেথা থাকবে না কেউ, সুদূর বনের গহন কোণে,
কানাকুয়া ডাকবে শুধু পহরের পর পহর গণে।
সেই নিরালার বুকটি চিরে পল্লী দুলাল আমরা দুজন,
পল্লীমায়ের রূপটি যে কি, করব মোরা তার অন্বেষণ।
রাখালের রাজগী
রাখালের রাজা! আমাদের ফেলি কোথা গেলে ভাই চলে,
বুক হতে খুলি সোনা লতাগুলি কেন পায়ে দলে?
জানিতেই যদি পথের কুসুম পথেই হইবে বাসি,
কেন তারে ভাই! গলে পরেছিলে এতখানি ভালবাসি?
আমাদের দিন কেটে যাবে যদি গলেতে কাজের ফাঁসি
কেন শিখাইলে ধেনু চরাইতে বাজায়ে বাঁশের বাঁশী?
খেলিবার মাঠ লাঙল বাজায়ে চষিতেই যদি হবে,
গাঁয়ের রাখাল ডাকিয়া সেথায় রাজা হলে কেন তবে?
তুমি চলে গেছ, শুধু কি আমরা তোমারি কাঙাল ভাই!
হারায়েছি গান, গোচরণ মাঠ, বাঁশের বাঁশরী তাই।
সোজাসুজি আজ উধাও চলিতে কোথা সে উধাও মাঠ,
গোখুর ধূলোয় চাঁদোয়া-টাঙানো কোথা সে গাঁয়ের বাট?
চরণ ফেলিতে চরণ চলে না শস্য-খেতের মানা,
খেলিবার মাঠে বড় জমকালো মিলেছে পাটের থানা।
গেঁয়ো শাখী আজ লুটায়ে পড়িছে কাঁচা পাকা ফল-ভারে,
তলে তলে তার মাঠের রাখাল হাট মিলাইতে নারে।
চষা মাঠে আজ লাঙল চলিতে জাগে না ভাটীর গান
সারা দিন খেটে অন্ন কুড়াই, তবু তাতে অকুলান।
ধানের গোলার গর্বেতে আজি ভরে না চাষীর বুক,
টিনের ঘরের আট-চালা বেঁধে রোদে জ্বলে পায় সুখ।
বাছের নায়েতে ছই দিয়ে চাষী পাটের বেপার করে,
দাবাড়ের গরু হালের খেতে যে জোয়াল বহিয়া মরে।
হেমন্ত নদী ঢেউ খেলেনাক সারীর গানের সুরে,
গরু-দৌড়ের মাঠখানি চাষী লাঙলেতে দেছে ফুঁড়ে।
মনে পড়ে ঘর ছোনের ছাউনি, বেড়িয়া চালের বাতা,
কৃষাণ বধূর বুকখানি যেন লাউ এর লতায় পাতা।
তারি পাশে পাশে প্রতি সন্ধ্যায় মাটির প্রদীপ ধরি
কুমারী মেয়েরা আশিস মাগিত গ্রাম-দেবতারে স্মরি।
আজকে সেখানে জ্বলে না প্রদীপ, বাজে না মাঠের গান,
ঘুমলী রাতের প্রহর গণিয়া জাগে না বিরহী প্রাণ।
শূনো বাড়িগুলো রয়েছে দাঁড়ায়ে, ফাটলে ফাটলে তার,
বুনো লতাগুলো জড়ায়ে জড়ায়ে গেঁথেছে বিরহ-হার।
উকুন যাহার গায়ে মারা যায়- থন থন করে তাজা,
এমন গরুরে পালিয়া কৃষাণ নিজেরে বনে না রাজা!
ধানের গোলার গর্ব ভুলেছে, ভুলেছে গায়ের বল,
চক্ষু বুজিয়া খুঁজিছে কোথায় টাকা বানানোর কল।
সারাদিন ভরি শুধু কাজ কাজ আরও চাই আরও-আরও-
ক্ষুধিত মানুষ ছুটিছে উধাও, তৃষ্ণা মেটে না কারও।
পেটে নাই ভাত, মুখে নাই হাসি, রোগে হাড়খানা সার,
প্রেত-পুরি যেন নামিয়া এসেছে বাহিয়া নরক-দ্বার।
হাজার কৃষাণ কাঁদিছে অঝোরে কোথা তুমি মহারাজ?
ব্রজের আকাশ ফাড়িয়া ফাড়িয়া হাঁকিছে বিরহ-বাজ।
আমরা তোমারে রাজা করেছিনু পাতার মুকুট গড়ে,
ছিঁড়ে ফেলে তাহা মণির মুকুট পরিলে কেমন করে?
বাঁশরী বাজায়ে শাসন করেছ মানুষ-পশুর দল,
সুর শুনে তার উজান বহিত কালো যমুনার জল।
কোন প্রাণে সেই বাঁশের বাঁশরী ভেঙে এলি গেঁয়ো বাটে?
কার লোভে তুই রাজা হলি ভাই! মথুরার রাজপাটে?
বাঁশীর শাসন হেলায় সয়েছি, বুনো ফলে দিছি কর,
অসির শাসন কি দিয়ে সহিব, বেচিয়াছি বাড়ি ঘর;
হালের গরুরে নিলামে দিয়েও মিটাতে পারিনি ভুখ,
আধখানা ফলে পেট ভরে যেত- ভেবে ভেবে হয় দুখ;
এত পেয়ে তোর সাধমেটেনাক, দুনিয়া জুড়িয়া ক্ষুধা,
আমরা রাখাল মাঠের কাঙাল যোগাইব তারি সুধা!
শোনরে কানাই! পষ্ট কহিছি, সহিব না মোরা আর,
সীমার বাহিরে সীমা আছে যদি, ধৈর্যেরো আছে বার।
ভাবিয়াছ ওই অসির শাসনে মোরা হয়ে জড়সড়,
নিজের ক্ষুধার অন্ন আনিয়া চরণে করিব জড়?
বাঁশীর শাসন মেনেছি বলিয়া অসিও মানিতে হবে!
শুরু দেয়া-ডাকে কাজরী গেয়েছি, ঝড়েও গাহিব তবে?
বাঁশীর শাসন বুকে যেয়ে লাগে, নত হয়ে আসে শির,
অসির শাসনে মরাদেরো মাঝে জেগে ওঠে শত বীর।
ভাবিয়াছ, মোরা গাঁয়ের রাখাল, নাই কোন হাতিয়ার,
যে লাঙল পারে মাটিরে ফাড়িতে, ভাঙিতেও পারে ঘাড়।
ঝড়ের সঙ্গে লড়িয়াছি মোরা, বাদলের সাথে যুঝি,
বর্ষার সাথে মিতালী পাতায়ে সোনা ধান করি পুঁজি।
* * *
তবুও সেখানে প্রদীপ জ্বালাই ঘন আঁধারের কোলে,
আঁকড়িয়া আছি পল্লীর মাটি কোন্ ক্ষমতার বলে!
জনমিয়া যারা দুখের নদীতে শিখিয়াছে দিতে পাড়ি,
অসির শাসন তরিবে তাহারা যাক না দুদিন চারি।
পষ্ট করিয়া কহিছি কানাই, এখন সময় আছে,
গাঁয়ে ফিরে চল, নতুবা তোমায় কাঁদিতে হইবে পাছে।
জনম-দুখিনী পল্লী-যশোদা আশায় রয়েচে বাঁচি,
পাতায় পাতায় লতায় লতায় লতিয়ে স্নেহের সাজি।
হিয়াখানি তার হানা-বাড়ি সম ফাটলে ফাটলে কাঁদি
বক্ষে লয়েছে তোমারি বিরহ বনের লতায় বাঁধি।