শিকের উপর দুলছে আজো খেলার হাঁড়িগুলি,
দাঁড়কাকটি বসে আছে সেথায় ঠোকর তুলি।
চড়ুইভাতির চুলোগুলি তেমনি আছে পড়ে,
এখানটিতে খেলবে না আর আগের মতন করে।
পোষা বিড়াল কেন যে তার সঙ্গ নাহি ছাড়ে,
যদিও বুকে পিষছে তারে স্নেহের অত্যাচারে।
* * *
* * *
পূর্ণিমারা এসেছে আজ শহর কলিকাতা,
অনেক খোঁজাখুঁজির পরে পেলেম তাদের পাতা।
শ্যামবাজারের বামধারেতে অন্ধগলির কোণে,
একতলা এক বন্ধ ঘরে থাকে অনেক জনে।
জানলা দিয়ে বয় না বাতাস, সারাটি ঘর ভরে,
ভ্যাঁপসামত গন্ধে সদাই দম আটকে ধরে।
ভাই-বোনেতে কদিন আগে জলবসন্ত হতে
ভাল হয়ে উঠেছে আজ এই তো কোনো মতে।
চোখ দুটি তার কোটরাগত, ফুলের মত মুখে
হাসির প্রদীপ জ্বলে না আর শিশুকালের সুখে।
কোথায় তাহার খেলাঘরটি, কোথায় খোলা মাঠ!
বাবলাশাখায় বাতাস যেথায় করতো ছড়া পাঠ।
বন্ধগলির অন্ধ কোণের কয়েদখানার ঘরে,
কোন্ দোষের সে বন্ধ হয় কোন্ অপরাদ করে?
কোন দস্যু করল হরণ আলো- বাতাস তার,
কে হরিল খেলার পুতুল নাচের নূপুর পার
কে হরিল ঝুমঝুমি তার শিশুহাতের থেকে,
ঊষার গায়ে কে দিলরে মেঘের কালি মেখে?
কোথায় আমার রাজার কুমার! শুয়ে মায়ের কোলে,
তোমার কি ঘুম ভাঙবে না এই শিশু-চোখের জলে।
শান্ত্রী সিপাই লয়ে এসো সপ্তা-ডিঙা করে,
আকাশ-বাতাস কেঁপে উঠুক জয়ডঙ্কার স্বরে।
ভাঙতে হবে বন্ধগলি, রুদ্ধ ঘরের দ্বার-
ভাঙতে হবে লক্ষযুগের অন্ধ কারাগার।
এমন নগর গড়বে তুমি সকল কোণেই তার,
সমান হয়ে উদাস বাতাস বইবে অনিবার।
চন্দ্র-রবির সোনার প্রদীপ জ্বলবে সবার ঘরে,
সকল ঘরের পূর্ণিমাদের হাসিমুখের তরে।
সেই আলো কেউ বন্ধ করে রাখতে যদি চায়,
তাহার সাথে যুদ্ধ মোদের সকল দুনিয়ায়!
মা ও খোকন
মা বলিছে, খোকন আমার! যাদু আমার মানিক আমার!
উদয়তারা খোকন আমার! ঝিলিক মিলিক সাগর-ফেনার!
ফিনকি হাসি ক্ষণিকজ্বলা বিজলী-মালার খোকন আমার!
খোকন আমার দুলকি হাসি, ফুলকি হাসি জোছনা ধারার।
তোমায় আমি দোলার উপর দুলিয়ে দিয়ে যাই যে দুলে, –
যাই যে দুলে, সকল ভুলে, রাঙা মেঘের পালটি তুলে,
দেই তোমারে দোলায় দুলে।
খোকন তখন লাফিয়ে উঠে
সাইকেলেতে যায় যে ছুটে,
বল খেলিয়ে খেলার মাঠে সবার তারিফ লয় যে লুটে।
মা বলিছে, খোকন আমার! মানিক আমার!
এতটুকুন দস্যি আমার! লক্ষ্মী আমার!
হলদে রঙের পক্ষী আমার!
তোমায় আমি পোষ মানাব বুকের খাঁচায় ভরে
তোমায় আমি মিষ্টি দেব, তোমায় আমি লজেন্স দেব,
তোমায় আমি দুধ খাওয়াব সোনার ঝিনুক ভরে!
খোকন তখন লাফিয়ে উঠে, রান্না ঘরে যায় যে ছুটে,
কলাই ভাজা চিবোয় সে যে পূর্ন দুটি মুঠো।
মা বলিছে, খোকন আমার! যাদু আমার! মানিক আমার!
ঈদের চাঁদের হাসি আমার! কেমন করে রাখি তোরে
বুকের মাঝে ধরে?
এতটুকুন আদর আমার! দূর্বা শিষের শিশির আমার!
মেঘের বুকের বিজলী আমার!
সকল সময় পরাণ যে মোর হারাই হারাই করে;
এত করে আদর করি ভরসা না পাই
তোরে আমার বুকের মাঝে ধরে।
পাল-পাড়াতে কলেরাতে, মরছে লোকে দিনে রাতে,
বোস পাড়াতে বসন্ত আজ দিচ্ছে বড়ই হানা,
আমরা মাথার দিব্যি লাগে ঘরটি ছেড়ে-
যাসনে কোথাও ভুলি মায়ের মানা।
খোকন তখন লাফিয়ে উঠে, ওষুধ লয়ে যায় যে ছুটে,
পাল-পাড়াতে দিনে রাতে রোগীর সেবা করে;
মরণ-মুখো রোগী তখন অবাক হয়ে চেয়ে দেখে
ফেরেস্তা কে বসে আছে তার শিয়রের পরে।
মুখের পানে চাইলে, তাহার রোগের জ্বালা।
যায় যে দূরে সরে।
মা বলিছে, খোকন আমার! সোনা আমার!
হীরে-মতির টুকরো আমার! টিয়ে পাখির বাচ্চা আমার!
তোরে লয়ে মন যে আমার এমন ওমন কেমন যেন করে।
পুতুল খেলার পুতুল আমার! বকুল ফুলের মালা আমার!
তোরে আদর করে আমার পরাণ নাহি ভরে।
ও পাড়াতে ওই যে ওধার, ঘরে আগুন লাগছে কাহার,
আজকে ঘরের হোসনেরে বার,
আমার মাথায় হাত দিয়ে আজ বল ত শপথ করে।
খোকন তখন লাফিয়ে উঠে, ক্ষিপ্ত হয়ে যায় যে ছুটে,
জ্বলন্ত সেই আগুন পানে সবার সাথে জুটে।
দাউ দাউ দাউ আগুন ছোটে, কুন্ডলী যে পাকিয়ে ওঠে;
ওই যে কুঁড়ে, ঘরের তলে, শিশু মুখের কাঁদন ঝলে,
চীৎকারিয়ে উঠছে মাতা আঁকড়িয়ে তায় ধরে।
জ্বলছে আগুন মাথার পরে কে তাহাদের রক্ষা করে।
মুহূর্তে যে সকল কাঁদন যাবে নীরব হয়ে;
সেই লেলিহা আগুন পরে খোকা মোদের লাফিয়ে পড়ে,
একটু পরে বাইরে আসে তাদের বুকে করে।
মা যে তখন খোকারে তার বুকের মাঝে ধরে,
বলে আমার সোনা মানিক! লক্ষ্মী মানিক!
ঘুমো দেখি আমার বুকের ঘরে।
খোকা বলে, মাগো আমার সোনা মানিক।
সকল শ্রানি- জুড়াব আজ তোমার কোলের পরে।