সারা জীবন দিল আলো সূর্য গ্রহ চাঁদ
তোমার আশীৰ্বাদ, হে প্ৰভু, তোমার আশীৰ্বাদ৷।
এ হচ্ছে রহস্যীকরণ, সূৰ্য গ্রহ চাঁদ কারো আশীৰ্বাদ নয়, এগুলো এক বিশাল মহাজাগতিক দুর্ঘটনার ফল (এর স্থূল রূপও পাওয়া যায়, রবীন্দ্রনাথের শিল্পীসুন্দর স্তব নজরুলের হাতে হয়ে উঠেছে এমন স্থূল : এই সুন্দর ফুল সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি/(খোদা) তোমার মেহেরবানি)। পুরোনো বাইবেল-এর ‘গীতসংহিতা’র ১৯-সংখ্যক সঙ্গীতের শুরুর দুই পংক্তি এমন :
আকাশমণ্ডল প্রচার করে ঈশ্বরের গৌরব,
আর ভূলোক প্রকাশ করে তাঁর হস্তকর্ম। –
রাজা ডেভিড বা অন্য কেউ যিনি এ-গান লিখেছিলেন, তার কাছে আকাশমণ্ডলকে খুবই বিশুদ্ধ পবিত্র ব্যাপার মনে হয়েছিলো, যা চারপাশের মাটি পাথর জলের জগত থেকে অনেক পরিশুদ্ধ। ওই গীতরচয়িতা আকাশমণ্ডল দেখে বিস্মিত হয়েছেন, কিন্তু তিনি যেমন সূর্য কী নক্ষত্র কী বোঝেন নি, তেমনি তাদের অকল্পনীয় বিশালত্ব সম্পর্কেও তাঁর কোনো ধারণা ছিলো না। তার কাছে সূৰ্য আর নক্ষত্র ছিলো ভিন্ন ব্যাপার, এবং অত্যন্ত ক্ষুদ্র; মহাকাল ও মহাজগতের অনন্ততা ও অনন্ততা অসীমতা সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিলো না, ধারণা করার শক্তিও দেখা দেয় নি। তাঁর বিস্ময়ের পর তিন হাজার বছর কেটে গেছে, বহু কিছুর সাথে চাঁদ তারা সূর্যও হারিয়েছে মহিমা; আমরা এখন জানি ওগুলো কী। আকাশমণ্ডল কোনো বিশুদ্ধ পবিত্ৰ স্থান নয়, তার সদস্যরাও কারো গৌরব প্ৰকাশ বা প্রচার করে। না; এবং আমরা, আমাদের পৃথিবীও আকাশমণ্ডলেরই সদস্য, আমরাও ভ্রমণ ক’রে চলছি। সূর্যের চারদিকে—মহাজগতে। হেরাইনবাৰ্গ, বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী ও প্রথম তিন মিনিট ও চূড়ান্ত তত্ত্বের স্বপ্ন-এর লেখক, বলেছেন, “আমাদের চারপাশের পাথরগুলো যতোটুকু ঈশ্বরের গৌরব প্রচার করে নক্ষত্রগুলো তার থেকে একটুও কম বা একটুও বেশি প্রচার করে না ঈশ্বরের গৌরব।” এগুলোর সাথে কোনো সম্পর্ক নেই ঈশ্বরের, কোনো দেবতার; আর সূর্যগ্ৰহ চাঁদ আলো বাতাস মেঘ বৃষ্টি কোনো প্রভুর আশীর্বাদ নয়। কিন্তু বাইবেলের গীতিকার ও একালের সঙ্গীতকার লিখেছেন একই গান, যা সুন্দর লাগে, কিন্তু মহাজগতের প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশ করে না; সব কিছুকে ঢেকে দেয় রহস্যে।
রবীন্দ্রনাথ অবশ্য প্রথাগত বিশ্বাসী ছিলেন না, প্রথাগত গ্রন্থনির্ভর ধাৰ্মিকদের মতাে তিনি নিশ্চিত ছিলেন না। চরম পরিণতি সম্পর্কে। যদিও মৃত্যুই চরম পরিণতি, তিনি জানতেন, তবু আরো কিছু আশা তার ছিলো; সন্দেহও ছিলো। যা তিনি এতো আদর্শায়িত ক’রে দেখেছেন, তা মৃত্যুতে শেষ হয়ে যাওয়ার মতো এতোই নিরর্থক, এটা ভাবা কষ্টকর ছিলো তার কাছে। একটি ব্যাকুল গানে তিনি প্রশ্ন করেছেন :
পথের শেষ কোথায়, শেষ কোথায়, কী আছে শেষে!
এত কামনা, এত সাধনা কোথায় মেশে?
এর কাতরতা আমাকে মুগ্ধ করে, সুর আলোড়িত করে; কিন্তু এমন প্রশ্ন আমি করবো না। মোহগ্ৰস্ত নই। আমি, আমি সৎ থাকতে চাই, সিসিফাসের মতো মেনে নিতে চাই জীবনের নিরর্থকতা, এবং অস্বীকারও করতে চাই নিরর্থকতাকে। কিছুতেই বিভ্রান্ত হ’তে চাই না, মোহের কাছে সমর্পণ করতে চাই না নিজেকে; আমি জানি পথের শেষ মৃত্যুতে, সব কামনা ও সাধনার শেষে রয়েছে নির্বিকার মাটি ও ক্ষুধার্তা আগুন, কিন্তু আমি ভেঙে পড়তে চাই না। রূপময় জীবনের শেষে মানুষের এই পরিণতিকে এক অপূর্ব কবিতায় পরিণত করেছিলেন জীবনানন্দ। মৃত্যুর আগে তো আমরা অজস্র রূপ আর রসের ভেতর দিয়ে চলেছি; নির্জন খড়ের মাঠে পৌষের সন্ধ্যায় আমরা হেঁটেছি, মাঠের পারে কুয়াশার ফুল ছড়িয়ে চলছে নদীর নরম নারী; দেখেছি অন্ধকারে আকন্দ ধুন্দুল জোনাকিতে ভ’রে গেছে, দেখেছি। বুনোহাঁস গুলির আঘাত এড়ায়ে উড়ে যাচ্ছে দিগন্তের নাম নীল জ্যোৎস্নার ভেতরে, আলো আর বুলবুলিকে খেলা করতে দেখেছি হিজলের জানালায়, আমরা দেখেছি প্রতিদিন ভোর আসে ধানের গুচ্ছের মতো সবুজ সহজ। কিন্তু এই রূপময় জীবনের পরে কী, আর কী বুঝতে চাই আমরা? জীবনানন্দ হাহাকার ক’রে ওঠেন নি, মেনে নিয়েছেন সুন্দর নিরর্থকতাকে :
আমরা মৃত্যুর আগে কি বুঝিতে চাই আর? জানি না কি আহা,
সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মত এসে জাগে
ধূসর মৃত্যুর মুখ;-একদিন পৃথিবীতে স্বপ্ন ছিল-সোনা ছিল যাহা
নিরুত্তর শান্তি পায়;-যেন কোন মায়াবীর প্রয়োজনে লাগে।
কি বুঝিতে চাই আর?…রৌদ্র নিভে গেলে পাখি-পাখালীর ডাক
শুনি নি কি? প্রান্তরের কুয়াশায় দেখি নি কি উড়ে গেছে কাক!
রবীন্দ্রনাথে শুনতে পাই ‘এত কামনা’র হাহাকার, জীবনানন্দে কামনা আরো রূপময়-সব রাঙা কামনা-কিন্তু হাহাকার নেই, এর শেষে জেগে আছে নিরর্থক দেয়ালের মতাে ধূসর মৃত্যুর মুখ। যতাে স্বপ্ন যতাে সােনা ছিলো জীবনে, তা যেনো কোনো যাদুকরের খেলার সামগ্ৰী। জীবনানন্দ আর বুঝতে চান নি, বোঝার কিছু নেই বলে; শেষে শুধু মুগ্ধ করেছেন দুটি অধরা চিত্ৰকল্প দিয়ে, যে-দুটি শুধু ঢেউ তুলে চলে স্থির জলে-রৌদ্র নিভে গেলে পাখি-পাখালীর ডাক/ শুনি নি কি? প্রান্তরের কুয়াশায় দেখি নি কি উড়ে গেছে কাক!
বিশ্বাসীদের সব কিছু দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বাসের ভিত্তির ওপর, তবে ওই ভিত্তিটা। দাঁড়ানো শূন্যতার ওপর। তারা ওই শূন্যতার দিকে তাকাতে চান না। বিশ্বাসীরা সাধারণত ভীত ও লুব্ধ মানুষ, তাদের ভেতরে ভয় ও লোভ একসাথে কাজ করে, শূন্যতাকে ভয় পেয়ে তারা স্বর্গের কল্পিত পূর্ণতাকে আঁকড়ে ধরে। রবীন্দ্রনাথ ওই ধরনের বিশ্বাসী ছিলেন না, তাহলে তিনি ধর্মপ্রবর্তক হতেন, কবি হতেন না। রবীন্দ্রনাথ শেষ জীবনে একবার তাকিয়েছিলেন তার বিশ্বাসের ভিত্তিটির দিকে। তার যে এই গভীর সর্বব্যাপী বিশ্বাস, তা কি উঠে এসেছিলো তার নিজের ভেতর থেকে? যাকে তিনি সত্য আর পরম ব’লে মেনেছিলেন, তা কি তার একান্ত আপন সত্য উপলব্ধি? যে-সুন্দর নিঠুরের কাছে তিনি সমর্পণ করেছিলেন নিজেকে, যার চরণস্কুলার তলে মাথা নত রাখতে ভালোবাসতেন তিনি, যার ইচ্ছে তিনি পূর্ণ দেখতে চাইতেন নিজের জীবনে, যার অঙ্গদ সুন্দর কিন্তু খড়গ আরো মনোহর মনে হতো তার, সুখে না থেকে যার কোলে থাকতে চাইতেন। তিনি, যার সাথে নিত্য বিরোধ তাঁর সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিলো, যার সম্মুখে তিনি দাঁড়াতে চাইতেন প্রতিদিন, তাকে কি তিনি পেয়েছিলেন নিজে? না কি পেয়েছিলেন প্ৰথা থেকে? বিশ্বাস কয়েক হাজার বছর ধরে সবাই পাচ্ছে প্রথা থেকে, তিনিও তাই পেয়েছিলেন। পত্ৰিপুট-এর পনেরো সংখ্যক কবিতায়, যে-কবিতাটির নাম দিতে পারি ব্রাত্য’, তিনি স্বীকার করেছেন আসল সত্য। তিনি বলেছেন :